হারতে হারতে জিতেও হারতে হলো আফরোজাকে

অভিনেত্রী আফরোজা। ছবি: সংগৃহীত
অভিনেত্রী আফরোজা। ছবি: সংগৃহীত

ভেবেই নিয়েছিলেন জীবনের শুরুতেই হেরে গিয়েছেন। ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যখন জীবন নিয়ে রঙিন এক স্বপ্ন মনে দানা বাঁধছেন, তখন বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পরিবারের মতে বিয়ে। তারপরও বাধা অতিক্রম করে তিনি পড়াশোনা করেছেন। এরপর স্বামী ছেড়ে চলে যান। বিচ্ছেদ হয়। চারপাশে সবকিছু তখন ঘোলাটে দেখতে থাকেন। এভাবে বারবার হারতে বসেছেন অভিনেত্রী আফরোজা।

একাকী দুই সন্তান নিয়ে স্রোতের বিপরীতে লড়তে শুরু করেন। যেন ‘হার’ শব্দটা জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। যে কারণেই হয়তো প্রতিবারই হারতে হারতে জিতে গিয়েছেন। সেভাবে কদিন আগেও চেয়েছিলেন বিজয়ী হয়ে ফিরতে। সহকর্মীদের শুনিয়েছিলেন, ক্যানসার থেকে সেরে আবার তিনি অভিনয় ফিরবেন। তা আর হলো না। বহুবার জীবনের কাছে হারতে হারতে জিতেও যাওয়া অভিনেত্রী আফরোজাকে আজ মৃত্যুর কাছে হারতে হলো। সকাল ছয়টায় তিনি প্রয়াত হয়েছেন।

ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কয়েকবার কথা হয় এই অভিনেত্রীর সঙ্গে। প্রতিবারই তিনি বলতেন, নিয়তির হাতেই সব ছেড়ে দিয়েছেন। আর বাকিটা তিনি চেষ্টা করছেন। তবে কথা শেষে বলতেন, যখন শুধুই অভিনয় করার কথা, সেই সময়েই তিনি শয্যায়। জীবনে এত দূর আসতে তাঁকে তত দিনে বহু কাঠখড় পেরোতে হয়েছে। সেগুলো কখনোই ভুলতেন না। এসবই নাকি তাঁকে অনুপ্রাণিত করত।
অল্প বয়সে মা হওয়ার পরে দুই সন্তান নিয়ে অনেকটাই অথই সাগরে পড়ে যান। তিনি চাইতেন, নিজের মতো করে সন্তানদের মানুষ করতে। কাঁধে বড় দায়িত্ব নিয়ে চাকরি নেন। সেই আয় দিয়েই সন্তানদের বড় করতে শুরু করেন। সিঙ্গেল মা হয়ে চারপাশের মানুষের কথা কখনোই কানে নেননি। তিনি যেমন ছিলেন স্বাধীনচেতা, তেমনি সন্তানদের স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছেন।

আফরোজা একসময় চাকরির পাশাপাশি অভিনয়ে যুক্ত হন। সেই অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা বাড়তে থাকে। একসঙ্গে অভিনয় ও চাকরি করে তিনি ছিলেন ক্লান্ত। বুঝতে থাকেন এটাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। একসময় চাকরি ছেড়ে অভিনয়ই নিয়মিত হন। অভিনয় তাঁর জীবনের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে।

এই নিয়ে প্রয়াত এই অভিনেত্রী প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, ‘চাকরি ছেড়ে দিই। সিঙ্গেল মা হিসেবে অনেক দিন ধরে সংগ্রাম করেছি। মনে হলো, একসঙ্গে চাকরি আর অভিনয় সম্ভব নয়। বিশ্রামের দরকার আছে। আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিই, শুধু অভিনয়টাই করে যাব। খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারলেই আমি খুশি ছিলাম। আর ভাবছিলাম, আমার জীবনের বড় পাওয়া ছেলেদের মানুষ করেছি। এর বাইরে আমার কখনোই কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। শুধু ইচ্ছা ছিল, নিজের মতো করে একটু বাঁচা। নিজের পরিচয়ে বাঁচা।’

তাঁর এই চাওয়ার মধ্যে দুই সন্তান বড় হতে থাকেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন অর্থনৈতিকভাবে তেমন টানাপোড়েন ছিল না। কারণ, সন্তানেরাও পড়াশোনা করে চাকরিতে যুক্ত হতে থাকেন। তিনি নিয়মিত হন অভিনয়ে। পুরো সময় শুধু অভিনয় নিয়েই ভাবতে থাকেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল অভিনয়ে নিজের ভালো একটি জায়গা তৈরি করা। সেই সুযোগগুলোও তাঁকে ধরা দিচ্ছিল। জীবনের সবকিছু যখন একটু গুছিয়ে আসছিল, ঠিক তখনই তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। ক্যানসার ধরা পড়ার পরে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে অভিনেত্রী আফরোজা আর কোনো শুটিংয়ে অংশ নিতে পারেননি। তাঁর আয় থেমে গেছে। তার পর থেকে চিকিৎসা খরচ বেড়েছে বহুগুণ।

আফসোস ছিল অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি এত দিন ধরে অভিনয় করি, কিন্তু সেই অর্থে পার্শ্বচরিত্রের বাইরে আরও ভালো চরিত্র আমার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাইনি। এই নিয়ে আমি সব সময় আমার গুরু মামুনুর রশীদের কথা মেনে চলি। তিনি বলেছিলেন, “লিফট ধরে কখনো ওপরে ওঠার চেষ্টা করবে না। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠো, অনেক দিন টিকে থাকতে পারবা।”’

তিনি আরও জানিয়েছিলেন, ‘ক্যারিয়ার নিয়ে আরও ভালো জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, সচ্ছল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য সাপোর্ট করেনি। আমার ইচ্ছা, সুস্থ হয়ে কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করব। যে কাজগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।’

মাসখানেক আগেও অভিনেতা কচি খন্দকারের সঙ্গে কথা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে কচি খন্দকার জানান, তাঁর নতুন কোনো কাজ মানেই আফরোজা হোসাইন থাকবেনই। নাটক ‘বাঙি টেলিভিশন’, ‘দুধভাত’সহ প্রায় সব কাজে অবধারিতভাবে এই অভিনেত্রীর চরিত্র থাকত। এবার তিনি শুরু করেছেন নতুন ধারাবাহিক নাটক ‘তেল ছাড়া পরোটা’র শুটিং। সেই খবর পেয়েছিলেন আফরোজা।
কচি খন্দকার বলেন, ‘আফরোজা আপার সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো। বুঝতে পারছিলাম তাঁর দিনগুলো শেষ। কিন্তু এর মাঝেই আপা বলতেন, সুস্থ হয়ে আবার কাজ শুরু করতে চান। এত কিছুর পরও তাঁর ক্লান্তি নেই। তিনি মনোবল হারাচ্ছেন না। জীবন নিয়ে লড়াই–সংগ্রাম করেও তাঁর মধ্যে অদম্য এক স্পৃহা। যার মূলে থাকত সহজ–সরল এক চাওয়া। অভিনেত্রী হিসেবে নিজের একটা জায়গা তৈরি করা। মানুষ যেন তাঁকে অভিনেত্রী হিসেবে মনে রাখে, চেনে, সেই জায়গায় তিনি যেতে চেয়েছিলেন। কাজের মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকতে চাইতেন।’

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর জরায়ু ক্যানসার ধরা পড়ে। সেই থেকে বন্ধ ছিল প্রিয় শুটিং। দ্রুতই জরায়ুর ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে থাকেন। ঢাকায় কেমোথেরাপি নেওয়ার পর তিনি ভারতেও একাধিকবার চিকিৎসা নিয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগেও তিনি ঢাকার ইবনে সিনায় চিকিৎসা নেন। কিন্তু খরচ কোনোভাবেই কুলাতে পারছিলেন না। অনেকেই সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন।

অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসান জানান, আজ মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এই অভিনেত্রীকে দাফন করা হবে। এই অভিনেত্রীর জন্ম ৮ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সাল।