দরজা খোলো মাকে দেখব, ছেলের আকুতি! গাড়িতে সীমানার মরদেহ

প্রয়াত অভিনেত্রী সীমানার দুই ছেলে
ছবি: মনজুরুল আলম

চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে দুপুর ১২টায় লাশবাহী গাড়িতে অভিনেত্রী সীমানার লাশ এল। আশপাশে তখন নীরবতা। কেউ কেউ ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেলেন লাশবাহী গাড়ির কাছে। পাশেই মাইক্রোফোনে ঘোষণা করা হচ্ছে জানাজা আদায় করার কথা। এমন সময় ভিন্ন এক দৃশ্য চোখে পড়ল। ৯ বছরের একটি শিশু দৌড়ে চলে এল লাশবাহী গাড়ির কাছে। এসেই জোরে তালা নাড়তে শুরু করল। বলতে শুরু করল, ‘দরজা খোলো, মাকে দেখব।’ বোঝা গেল, শিশুটি সদ্য প্রয়াত অভিনেত্রী সীমানার ছেলে। তার নাম শ্রেষ্ঠ। মাকে দেখার জন্য ছোট্ট শ্রেষ্ঠর আকুলতা আশপাশের সবাইকে আবেগাপ্লুত করে।

বাবা গায়ক পারভেজ সন্তানকে বুঝিয়ে চ্যানেল আই ভবনের ভেতরে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু মা যে গাড়িতে। ওকে মায়ের কাছ থেকে দূরে নেওয়ার সাধ্য কার। কিছুক্ষণ পর দৌড়ে আবার চলে লাশবাহী গাড়িটির কাছে। জোরে জোরে তালায় ধাক্কা মারতে শুরু করল। শিশুটি তখন বলছিল, ‘এখানে মা আছে। দরজা খোলো, দরজা খোলো। এখানে মা রয়েছে, আম্মু তোমাকে দেখব। খোলো খোলো, দরজা খোলো।’ পরে দৌড়ে চলে গেল চালকের আসনের কাছে। সেখানে কেউ নেই। চালককে আর দরজা খোলার অনুরোধ করা হলো না শিশুটির।

মডেল-অভিনেত্রী রিশতা লাবণী সীমানা

মন খারাপ করে আরও কিছু সময় গাড়ির পাশেই ঘুরতে থাকে সীমানার শিশুসন্তান। পাশের একজনকে অনুরোধ করে দরজা খুলতে। তিনি বাধ্য হয়েই তালা খোলার অভিনয় করে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। কারণ, আরও পরে লাশ নামানো হবে। মাকে দেখতে না পেয়ে শ্রেষ্ঠ চলে গেল ভেতরে। নির্মাতা ও অভিনেতা সালাহউদ্দিন লাভলুসহ বেশ কয়েকজন কলাকুশলী ও সংবাদকর্মী এ দৃশ্য দেখছিলেন। পাশ থেকে একজন বললেন, ‘আহা রে, এত ছোট বয়সেই মা শব্দটা শিশুর জীবন থেকে চলে গেল। হয়তো বুঝতে পারছে, আজই মাকে শেষবার দেখার সুযোগ।’

কতবার মায়ের সঙ্গে শেরপুরে নানাবাড়িতে ঘুরতে যাওয়া হয়েছে। সেই নানাবাড়িতে মায়ের সঙ্গে আজই শেষ যাওয়া। শেরপুরের নকলায় এই অভিনেত্রীদের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে। দুপুর ১২টার পরে জানাজা হয়। চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে কথা হয় শিশুটির সঙ্গে। এ সময় শ্রেষ্ঠ এই প্রতিবেদককে বলে, ‘মা আমাকে হাজার হাজার ভালোবাসা দিত। আর মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে ক্যাডেট কলেজে পড়াবে। কিন্তু মা তো এখন নেই। মা মারা গেছে, আমার ভালো লাগছে না।’

প্রয়াত অভিনেত্রী সীমানার দুই ছেলে। ছবি: মনজুরুল আলম

মায়ের মারা যাওয়াটা এখনো বোঝেনি শিশুটি। সে মনে করছে, মা ফিরে আসবেন। আবার আদর করবেন, গান শোনাবেন, একসঙ্গে খেতে নিয়ে যাবেন। মায়ের সঙ্গে বাইরে খেতে যেত। যেভাবে আগে ঘুরতে যেত। শিশুটি আরও বলতে থাকে, ‘আল্লাহ, তুমি আমার মাকে সুস্থ করে দিয়ো। তুমি আমার মাকে জান্নাতে নিয়ে যেয়ো। আমার মায়ের জন্য সবাই দোয়া করবেন। মা অসুস্থ। আমি মাকে অনেক ভালোবাসি।’
তখন পাশেই কাঁদছিলেন সীমানার বাবা। মেয়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তিনি। কথা বলতেই পারলেন না। পাশ থেকে সীমানার মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমার মেয়েকে তোমরা এনে দাও। আমার ভালো মেয়েটা চলে গেল। কোথা থেকে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝলাম না। কত কিছু নিয়ে কত ইচ্ছা ছিল মেয়ের। কিছুই করা হলো না। আমার মেয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’ এ সময় সীমানার সহকর্মীদের উদ্দেশে এই অভিনেত্রীর ছোট ভাই এজাজ বিন আলী বলেন, ‘আমার বোন যদি তার কোনো সহকর্মী কারও কাছে কোনো ভুল করে থাকে, আপনারা ক্ষমা করে দেবেন।’

চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু

জানাজা শেষে এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সালাহউদ্দিন লাভলুর। তিনি বলেন, ‘এভাবে মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। ওর শুরুটা হয়েছিল আমার হাত ধরে। আমার নাটকে অভিনয় করেই প্রশংসিত হয়েছিল। শুরু থেকেই সে সম্ভাবনাময়ী অভিনেত্রী ছিল। কয় দিন আগেই হঠাৎ ফোন দেয়। জানাল অভিনয় করতে চায়। সেদিনের কথা আমার এখনো মনে রয়েছে। আমাকে বলল, “লাভলু ভাই, আপনার হাত ধরে শুরু করেছিলাম। এবার বিরতির পর আপনার হাত ধরে ফিরতে চাই।” এর মধ্যে আজ সকালে শুনি মেয়েটি আর নেই।’

অভিনেত্রী সীমানা লাক্স–চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মিডিয়ায় পথচলা শুরু করেন। সেই চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে জানাজা পড়ানো হয়। এখান থেকে সরাসরি তাঁকে শেরপুরে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হবে। সেখানে আরেকবার জানাজা পড়ানো শেষে দাফন করা হবে। মায়ের লাশ যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছে, তখন সীমানার দুই ছেলে মেতে উঠেছে খেলায়। সীমানার বড় ছেলে শ্রেষ্ঠ ছোট ভাই স্বর্গের হাতে তুলে দিচ্ছে খাবার। দুই শিশুর খাবার ভাগাভাগি করে নেওয়ার সেই দৃশ্য সবাইকে ছুঁয়ে যায়। মায়ের লাশ নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে নানাবাড়ির পথে। এটাই মায়ের সঙ্গে শেষ যাওয়া, সেদিকে কোনো খেয়াল নেই দুই শিশুর।

জানাজা শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় শেরপুরের উদ্দেশ্যে। ছবি: প্রথম আলো