আলী যাকেরের মৃত্যু এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি
আলী যাকেরের মৃত্যু এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি

আলী যাকের স্মরণে কেরামত মওলা

হে বন্ধু, বিদায়

নক্ষত্রপতনের শব্দ ভেসে আসে চারদিক থেকে। এই করোনোর মৃত্যু-মহামারি-মহাকালে পৃথিবীজুড়ে নেমে এসেছে অদ্ভুত এক আঁধার। ক্রমে পৃথিবী পরিণত হয়েছে এক মলিন মৃত্যুর জনপদে। আচমকা দমকা বাতাসের মতো কানে ভেসে আসছে শোকবার্তা। বিগত কয়েক মাসে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছে অগণিত চেনামুখ। হঠাৎ করে ভালো মানুষগুলো পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জামিলুর রেজা চৌধুরী, মোস্তফা কামাল সৈয়দ থেকে শুরু করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সর্বশেষ হারালাম প্রাণের অধিক প্রিয়জন বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকেরকে। আমাদের সবার প্রিয় ছোটলুকে।

আলী যাকের

এমন প্রিয়জন হারানোর কষ্ট-শোক-বেদনায় বিহ্বল হয়ে আছি। মৃত্যু অবধারিত, মৃত্যু সুনিশ্চিত। পার্থিব জীবন শেষে সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়। কিন্তু সব মৃত্যু সমানভাবে হৃদয়কে আন্দোলিত করে না। সব মৃত্যু সমানভাবে কাঁদায় না। ভাবায় না। সব মৃত্যুর ক্ষতিও সমান নয় পৃথিবীর কাছে। আলী যাকেরের মৃত্যু এ দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিছুদিন ধরে মন তাই নিবিড় বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মনে পড়ছে জীবনানন্দের সেই লাইন, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।’ ভাবি, আরেক আলী যাকের আর কখনো কী আসবে এই পৃথিবীতে? মঞ্চ কাঁপাবে, হাসাবে, কাঁদাবে; যার অভিনয়ের বিমুগ্ধতায় ঘোরগ্রস্ত হয়ে থাকবেন অভিভূত দর্শক।

আলী যাকের আমার বন্ধু ছিল। বহুমাত্রিক পরিচয় তার। সে এ দেশের বিজ্ঞাপন অঙ্গনের প্রথম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনে আজকের যে উৎকর্ষ, সেটা তারই অবদান। এ ছাড়া সে একই সঙ্গে ছিল অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক, লেখক, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি। টেলিভিশন ও মঞ্চনাটকে সমান জনপ্রিয় এক মুখ। আলী যাকের খুব ভালো ক্রিকেট খেলত। আমাদের প্রথম পরিচয়ও ওই ক্রিকেটের সূত্র ধরে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে। ও থাকত গেন্ডারিয়ায়। আমি শান্তিনগর। ও খেলত গেন্ডারিয়া ক্রিকেট ক্লাবে। সেখান থেকে এল শান্তিনগর ক্রিকেট ক্লাবে। ওই সময়ে আমিও যুক্ত ছিলাম ওই ক্লাবে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছিলেন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট, মোজাফফর হোসেন পল্টু সেক্রেটারি।

কেরামত মওলা

তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরবর্তী সময়ে সে পরিচয় নানাভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তখনো অভিনয়ের সঙ্গে সেভাবে জড়ায়নি ও। খেলাধুলায় বেশি মগ্ন ছিল। হঠাৎ করে যখন নাটকের মঞ্চে চলে এল, একটু অবাকই হলাম। আমি টেলিভিশনের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আসাদুজ্জামান নূর ও সারা যাকেরের মাধ্যমে ‘সিসিমপুর’ নামের একটা শিশুতোষ অনুষ্ঠানে তার অফিসে কাজ করতে যাই। তখন আমাদের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। মানুষ আলী যাকেরকে দেখে দিন দিন আমি মুগ্ধ হয়েছি।

আমার ‘বস’ হওয়া সত্ত্বেও সে আমাকে ডেকে তার রুমে চা খাওয়াত। আমাদের তুমি-তুমি সম্পর্ক ছিল। কখনো ও বলেনি যে ‘বস’ বলে ডাকতে হবে। একজন উদার, নিরহংকার ও ভদ্র মানুষ ছিল সে।

মঞ্চে আলী যাকের

ধীরে ধীরে যাকেরের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হয়েছে। একদিকে ওর বিজ্ঞাপন সংস্থা এশিয়াটিক ত্রি সিক্সটির কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের জন্য বিখ্যাত বিদেশি নাটকের বাংলায় রূপান্তর আর নাটক নির্দেশনায় ব্যস্ততা বেড়েছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছি একজন আলী যাকেরের উত্থান। মঞ্চনাটক, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন ও বিজ্ঞাপন সংস্থা—সর্বত্রই তখন ওর বিচরণ। এর মধ্যে সে অনেকগুলো নাটক করেছে মঞ্চে, যা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর মধ্যে আছে ‘বাকী ইতিহাস’, ‘শাহজাহান’, ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘অচলায়তন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘নূরলদিনের সারাজীবন’ ইত্যাদি। তার সব নাটকই মানুষকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু এর মধ্যেও যে নাটক দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমি দারুণ মুগ্ধ হয়েছি তার নাম ‘দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা’। আমি নিজে একজন অভিনেতা হওয়ার পরও মনে হয়েছে, এই নাটক আমাকে করতে দিলে আমি হয়তো এত ভালো করতে পারব না।

ব্রেটল ব্রেশটের ‘দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি’ অবলম্বনে ‘গ্যালিলিও’ নামে অনুবাদ নাটকে নামচরিত্র ‘গ্যালিলিও’ হিসেবে অভিনয়ের জন্য একসময় তো ওকে ‘বাংলার গ্যালিলিও’ হিসেবে অখ্যায়িত করা হতো।

দুই সন্তান ইরেশ ও শ্রিয়াকে নিয়ে আলী যাকের

জনপ্রিয়তা পেয়েছে শেকস্‌পিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে অভিনয় করে। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ রবিবার’ টিভি নাটকে বড় চাচা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সে সাধারণ মানুষের কাছে সত্যিকার অর্থে একজন ‘বড় চাচা’ হয়ে উঠল। একই লেখকের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের ‘মামা’ চরিত্রের জন্যও সে বিখ্যাত ছিল। এভাবে প্রতিটি নাটককে সে স্বতন্ত্র জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। বাংলাদেশে নাটকগুলোকে যখনই লোকে দেখবে, তখনই তার কথা মনে করবে। মঞ্চনাটক প্রতিদিন মরে, প্রতিদিন জন্মায়। প্রতিবার নাটকগুলো মঞ্চায়িত হওয়ার সময় যখন অন্য কেউ চরিত্রগুলো করবে, তখন অবশ্যই আলী যাকেরকে শ্রদ্ধাসহ স্মরণ করবে। এখানেই তার চিরদিন বেঁচে থাকার মহত্ত্ব। এটাই মঞ্চের বিশেষত্ব।
আলী যাকেরের সঙ্গে একই চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয়েরও সুযোগ ঘটেছে আমার। এটা আমার জন্য অত্যন্ত গর্বের। যা এখন আমার জন্য দুর্লভ স্মৃতি। আমরা একত্রে অভিনয় করেছি হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকে, মোরশেদুল ইসলামের ‘বৃষ্টি’ এবং তানভীর মোকাম্মেলের ‘নদীর নাম মধুমতী’ ও ‘রাবেয়া’ চলচ্চিত্রে।

এ ছাড়া তার ছেলের সঙ্গে হাসানুল হক মিনুর পরিচালিত ‘তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা’ নামের টিভি নাটকেও আমরা একত্রে অভিনয় করি। যখন একজন ভালো বন্ধু চলে যায়, তখন চারদিকে অন্ধকার মনে হয়।

গ্যালিলিও নাটকে আলী যাকের

অনেক প্রিয়জন হারানো মেনে নিলেও আলী যাকেরকে হারিয়ে আক্ষরিক অর্থেই গভীরভাবে শোকাহত হয়েছি। মাঝেমধ্যে টেলিফোনে আমাদের আলাপ হতো। এই বয়সেও আলাপচারিতায় অনেক কিছু শেখার ছিল। মৃত্যু মানুষের নশ্বর শরীরকে থামিয়ে দিলেও কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ অবিনশ্বর হয়ে থেকে যায়। যে জীবন কর্মময়, যে জীবন দাগ রেখে যায় পৃথিবীর বুকে, সে জীবনকে মানুষ স্মরণ করে বিনম্র শ্রদ্ধায়। করোনার এই প্রকোপ একদিন থেমে যাবে। মানুষ আবার ফিরবে স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু যাঁদের হারালাম, ভয়ংকর ভাইরাস যেসব অসামান্য মানুষের পথচলা থামিয়ে দিল চিরতরে, সময় তাঁদের স্মরণ করবেই। ইতিহাসও তা–ই বলে। আলী যাকেরও আমাদের মধ্যে থাকবে একজন বহুমাত্রিক শক্তিশালী কিংবদন্তি অভিনেতা ও একজন ভালো মানুষ হয়ে। বন্ধু তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। হে বন্ধু বিদায়।