হারিয়ে গেছেন তাঁরা, আর খুঁজে পাব না

চলতি বছর ২ জানুয়ারি ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করে নিজেকে ভক্ত-শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেন বরেণ্য শিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে বসে নিজের তোলা ছবিটি পোস্ট করেন। ছবির ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও…তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’ ক্যাপশনের সঙ্গে ইমোজি হিসেবে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। ছবিটি পোস্ট করার পরই ফেসবুক বন্ধু ও ভক্তরা তাঁকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানান। কিন্তু কে জানত, মাত্র ২০ দিন পরে তাঁর ছবির ক্যাপশন কাঁদাবে ভক্ত-শ্রোতাসহ দেশবাসীকে।

চলচ্চিত্র, শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই এ বছর হারিয়ে গেছেন সবার মাঝ থেকে। তাঁদের অনুপস্থিতি দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁদের হারানোর শোক হৃদয়ে নিয়ে বরণ করতে হবে নতুন বছরকে। অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীকে কাঁদিয়ে এ বছর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যারা, তাঁদের কথা জেনে নিতে পারি আজ।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
সুরকার, সংগীত পরিচালক ও সংগীতশিল্পী
বছরের শুরুতেই হারাতে হয় বাংলা গানের প্রখ্যাত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে। গত ২২ জানুয়ারি ৬৩ বছর বয়সে রাজধানীর বাড্ডায় নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন এ বরেণ্য সংগীতশিল্পী। গত শতকের ৭০ দশকের শেষ থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাংলাদেশ চলচ্চিত্রসহ সংগীতে সক্রিয় ছিলেন।

শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

শাহনাজ রহমতউল্লাহ
সংগীতশিল্পী
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে হারানোর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই চলে যান দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া শাহনাজ রহমতউল্লাহ। ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’—এ রকম অসংখ্য কালজয়ী গানের এই কণ্ঠশিল্পী পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এ বছর ২৩ মার্চ।

টেলি সামাদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

টেলি সামাদ
অভিনেতা
অনেক দিন নিভৃতে ছিলেন। ঢাকার চলচ্চিত্রের শক্তিশালী ও জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা টেলি সামাদ চলে যান এ বছর ৭ এপ্রিল রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪। তিনি হৃদ্‌রোগ, ব্লাড ক্যানসার ও বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন।

সালেহ আহমেদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সালেহ আহমেদ
অভিনেতা
স্বাধীনতা পদক পাওয়া মঞ্চ ও টেলিভিশনের শক্তিমান অভিনেতা সালেহ আহমেদ ২৪ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা অসুখে ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। ১৯৯১ সালে হুমায়ূন আহমেদের নাটক ও চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। টিভিতে ধারাবাহিক নাটক ‘অয়োময়’ আর চলচ্চিত্রে ‘আগুনের পরশমণি’র মাধ্যমে অভিনয় জগতে তিনি পা রেখেছিলেন।

আনিসুর রহমান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আনিসুর রহমান
অভিনেতা
গত এপ্রিল মাসে চলে যান চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা আনিসুর রহমান আনিস। ৭৮ বছর বয়সে রাজধানীতে এ বছর ২৯ এপ্রিল শহরের টিকাটুলির অভয় দাস লেনের নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন। তিনি দুই মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।

সুবীর নন্দী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

সুবীর নন্দী
সংগীতশিল্পী
গত ৭ মে বাংলাদেশ সময় ভোররাত সাড়ে চারটার দিকে মারা যান বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৬৬ বছর বয়সী সুবীর নন্দী দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে ভুগছিলেন। তাঁর হার্টে বাইপাস অপারেশন করা হয়। কিডনি জটিলতা ছিল প্রকট।

মমতাজউদদীন আহমদ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মমতাজউদদীন আহমদ
অভিনেতা
বহু গুণের মানুষ ছিলেন অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ। চাইলেই অনেক বিশেষণ লেখা যায় তাঁর নামের আগে। নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, শিক্ষাবিদ বা লেখক। যখন যা করেছেন, মমতা দিয়ে, নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন। সফলও হয়েছেন। হয়েছেন অনুসরণীয়। নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক মমতাজউদ্দীন আহমদ দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি এক অঙ্কের নাটক লেখায় বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। মমতাজউদদীন আহমদ শিক্ষক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও মঞ্চনাটকের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক পান। এ বছর ২ জুন না–ফেরার দেশে চলে যান তিনি।

বাবর। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বাবর
অভিনেতা
চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালক বাবর মারা যান গত ৬ আগস্ট।। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। খলনায়ক চরিত্রেই অভিনয় করতেন তিনি। তবে চলচ্চিত্রে বাবর প্রথম অভিনয় করেন নায়ক চরিত্রে। বাবরের অভিষেক ঘটেছিল আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘বাংলার মুখ’ চলচ্চিত্রে। খলনায়ক হিসেবে যাত্রা শুরু হয় নায়করাজ রাজ্জাক প্রযোজিত ও জহিরুল হক পরিচালিত ‘রংবাজ’ চলচ্চিত্র দিয়ে। তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।

হুমায়ুন সাধু। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

হুমায়ুন সাধু
অভিনেতা
প্রকৃতির খেয়ালে তাঁর শরীরে স্বাভাবিক গড়ন ছিল না। তুলনামূলকভাবে খর্বাকার ছিলেন। এতে অবশ্য থেমে থাকেনি জয়যাত্রা। কোনো বাধাবিপত্তি তিনি আমলে নেননি কখনো। অসংখ্য নাটক, টেলিছবি, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করেছেন। কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি তিনি পরিচালনা করেছেন। হাসিখুশি মানুষটার শিল্পজীবন বেশ চলছিল। এই মানুষকেও হারাতে হয়েছে এ বছর। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৫ অক্টোবর তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

মাহফুজুর রহমান খান। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

মাহফুজুর রহমান খান
চিত্রগ্রাহক
১০ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান ৬ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। মাহফুজুর রহমান খান ছিলেন প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক আবদুল লতিফ বাচ্চুর শিষ্য। তাঁর অধীনে সহকারী চিত্রগ্রাহক হিসেবে ১৯৭০ সালে ‘দর্পচূর্ণ’ ও ১৯৭১ সালে ‘স্বরলিপি’ চলচ্চিত্রে কাজ করেন।

পৃথ্বীরাজ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

পৃথ্বীরাজ
সংগীতশিল্পী
তরুণ সংগীতশিল্পী পৃথ্বীরাজের নিজ প্রতিষ্ঠান ছিল জিলাপি স্টুডিও। স্টুডিওটি গড়ার সময় তিনি বলেছেন, ‘জিলাপি নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। এখানে ঢুকে ঘরটা ঠান্ডা করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসব। ছবি দেখব, গান শুনব। এখান থেকে অন্য রকম সাউন্ড তৈরি হবে। এটা একান্তই আমার নিজের জগৎ। এই ঘরটাতেই কাজ করতে করতে যদি চলে যাই, তা হবে আমার জন্য অনেক শান্তির।’ ২০১১ সালে নিজের স্টুডিওতে বসে কিছু না ভেবেই বলেছিলেন পৃথ্বীরাজ। তাঁর সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে বড় অসময়ে, এই জিলাপি স্টুডিওতে কাজ করতে করতে ১৫ ডিসেম্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি চলে গেছেন না–ফেরার দেশে।

বাসুদেব ঘোষ। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বাসুদেব ঘোষ
সুরকার ও সংগীত পরিচালক
বছরের একদম শেষ দিকে আবারও শোকের ছায়া নেমে আসে সংগীতাঙ্গনে। সুরকার-সংগীত পরিচালক বাসুদেব ঘোষ মারা গেছেন। ২৯ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে নিজ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে দ্রুত রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১১টার দিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।