অভিনেতা, আবৃত্তিকার, কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন
অভিনেতা, আবৃত্তিকার, কবি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় ২০ চরিত্র

৬০ বছরের বেশি অভিনয়জীবন, তিন শতাধিক চলচ্চিত্র, তারপরও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বললেই চলে আসে সত্যজিৎ রায়ের নাম। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে সেকালের তপন সিংহ, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে হালের শিবপ্রসাদ–নন্দিতা—সবার সঙ্গেই কাজ করেছেন সৌমিত্র, জন্ম দিয়েছেন অনেক স্মরণীয় চরিত্রের। কিন্তু সত্যজিতের চরিত্রগুলোর ডামাডোলে হারিয়ে গেছে সেসব চরিত্র। শেষ বয়সে লেখক অমিতাভ নাগের সঙ্গে মিলে সারা জীবনের কাজ থেকে প্রিয় ২০টি চরিত্রের একটা তালিকা করেছিলেন সৌমিত্র। তার মধ্য আটটা ছিল সত্যজিতের চরিত্র (অপুর সংসার–এর ‘অপু’, সমাপ্তির ‘অমূল্য’, অভিযান–এর ‘নরসিং’, চারুলতার ‘অমল’, অরণ্যের দিনরাত্রির ‘অসীম’, অশনি সংকেত–এর ‘গঙ্গাচরণ’, সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথ–এর ‘ফেলুদা’ আর ঘরে বাইরের ‘সন্দীপ’)। বাকি ১২টি চরিত্র ছিল অন্য পরিচালকদের সৃষ্টি। সত্যজিতের চরিত্রগুলোর সঙ্গে তো আমরা কমবেশি পরিচিত। সত্যজিতের বাইরের সেই ১২টি চরিত্র নিয়ে সৌমিত্রের প্রথম প্রয়াণবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

১৯৬১ সালে ঝিন্দের বন্দী নামে যে ছবি মুক্তি পেল, সেটি দেখে দর্শক অবাক। এই ছবিতেই প্রথম খলচরিত্র করলেন সৌমিত্র। ‘ময়ূরবাহন’ সুদর্শন ও লম্পট এক যুবক। এত দিন নায়ক অপু হিসেবে যিনি দর্শকের মনে গেঁথে ছিলেন, আচমকা তপন সিংহ তাঁকে নিয়ে এলেন ভিলেন করে।

নিম্নমধ্যবিত্ত তরুণ ‘অজয়’–এর চটজলদি ধনী হতে চাওয়ার গল্প আকাশ কুসুম। ১৯৬৫ সালে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর সত্যজিৎ রায় আর এই ছবির পরিচালক মৃণাল সেনের মধ্যে তিক্ত পত্রযুদ্ধ হয়েছিল।

ট্রেনে সুটকেস বদল হয়ে গেল। আর তার সূত্র ধরেই নায়িক–নায়িকার পরিচয় ও প্রণয়। সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য থেকে নিত্যানন্দ দত্তর ছবি বাক্স বদল (১৯৭০)। ছবিতে মানসিক রোগের চিকিৎসক ‘প্রতুল ভট্টাচার্য’র চরিত্রটি করেছেন সৌমিত্র।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘অপুর সংসার’–এ

‘হয়তো তোমারই জন্য’ ও ‘জীবনে কি পাব না’—মান্না দের কণ্ঠের গান দুটো যাঁরা শুনেছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো জানেন না, এগুলো তিন ভুবনের পারের (১৯৬৯) গান। আশুতোষ বন্দোপ্যাধ্যায়ের এই ছবির নায়ক ‘সুবীর/মন্টু’ রকের ভবঘুরে এক রোমিও, যে উচ্চশিক্ষিত এক মেয়ের প্রেমে পড়ে।

তরুণ বয়সে মেয়েদের হোস্টেল ঘিরে যেমন ছেলেদের একধরনের কৌতূহল থাকে, তেমনি মেয়েদেরও থাকে ছেলেদের হোস্টেল ঘিরে। দুই হোস্টেলের তরুণ–তরুণীদের মধ্যে চলা লড়াই আর মজার সব ঘটনা নিয়ে দীনেন গুপ্তর ছবি বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩)। ছবিতে ছেলেদের হোস্টেলের নেতা ‘শ্যামসুন্দর’ হয়েছেন সৌমিত্র।

বাংলা চলচ্চিত্রের তিন পুরোধা সত্যজিৎ, মৃণাল ও ঋত্বিক। প্রথম দুইজনের সঙ্গে কাজ করেছেন, বাকি ছিল ঋত্বিক ঘটক। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প অবলম্বনে সংসার সীমান্তে ছবি করা হবে, অভিনয়ে সৌমিত্র, পরিচালনায় ঋত্বিক। ঋত্বিকের ছবিটি করা হয়নি, ১৯৭৫ সালে করলেন তরুণ মজুমদার। ছবির চোর ‘অঘোর’ চরিত্রটি দর্শকের মতো, সৌমিত্ররও পছন্দ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে পলাশ বন্দোপাধ্যায়ের ছবি অগ্রদানী (১৯৮৩)। এখানে অগ্রদানী ব্রাহ্মণ ‘পূণ্য চক্রবর্তী’র চরিত্রে মর্মস্পর্শী অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র।

১৯৮৪ সালে মুক্তি পেল সরোজ দের কোনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় সাঁতারু হিসেবে অংশ নেওয়া এক মেয়ের গল্প। এই যুদ্ধে মেয়েটির সবচেয়ে বড় সঙ্গী তার কোচ ‘ক্ষিতীশ সিংহ’ ওরফে সৌমিত্র।

একটা খুন দেখে ফেলেন এক ‘অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক’। আতঙ্ক (১৯৮৬) ছবিতে মাস্টারমশায় চরিত্রে খুনীর পরিচয় জানার পরও প্রকাশ করতে না পারার অসহায়তা আশ্চর্য কুশলতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন সৌমিত্র। তপন সিংহের আরেক ছবি হুইলচেয়ার-এ (১৯৯৪) শারীরিক প্রতিবন্ধী ‘ড. মিত্র’ চরিত্রটি ঠিকঠাক তুলতে কয়েক মাস হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেছিলেন এই অভিনেতা।

`অশনি সংকেত` ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও ববিতা

রাজা মিত্রর একটি জীবন-এ (১৯৮৮) বঙ্গীয় শব্দকোষ প্রণেতা ‘হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’–এর আদলে তৈরি গুরুদাস ভট্টাচার্যের চরিত্রটিতে তরুণ থেকে বৃদ্ধ কয়েক বয়সের অভিধানকারকে জীবন্ত করে তোলেন সৌমিত্র।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অবলম্বনে গৌতম ঘোষের ছবি দেখা (২০০১), যেখানে খিটখিটে ও প্রায় অন্ধ হয়ে যাওয়া কবি ‘শশীভূষণ’ চরিত্র করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

সূত্র: অমিতাভ নাগের বিয়ন্ড অপু: ২০ ফেবারিট ফিল্ম রোলস অব সৌমিত্র চ্যাটার্জি, হার্পার কলিন্স ইন্ডিয়া