একটাই ইচ্ছা ছিল তাঁর। ছয়টা মাস বেঁচে থাকবেন। দেখবেন কাছের মানুষদের। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ হলো না তাঁর। শনিবার পৌষের সকালে চলেই গেলেন তিনি। কঠিন বাস্তবতা মেনে তাঁকে বিদায় জানাবেন প্রিয়জনেরা। রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মরদেহে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিকেলে বনানীতে দাফন করা হবে বর্ষীয়ান অভিনেতা আবদুল কাদেরকে। পুত্রবধূ জাহিদা ইসলাম জেমি প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আজ শনিবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন অভিনেতা আবদুল কাদের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তিনি স্ত্রী এবং এক ছেলে ও মেয়েকে রেখে গেছেন।
হাসপাতাল থেকে আবদুল কাদেরকে নেওয়া হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে গোসল করানোসহ দাফনের জন্য প্রস্তুত করানো হচ্ছে। এখান থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে মিরপুর ডিওএইচএসের বাসায়। বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মরদেহে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। এরপর বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
শনিবার আবদুল কাদেরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিনোদন জগতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর ছবি দিয়ে শোক প্রকাশ করে স্মৃতিচারণা করেন অনেকেই। আবদুল কাদেরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক প্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদসহ অনেকেই।
উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ ডিসেম্বর চেন্নাইয়ে নেওয়া হয় আবদুল কাদেরকে। সেখানকার হাসপাতালে পরীক্ষার পর ১৫ ডিসেম্বর তাঁর ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন, ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে না।
গত রোববার সন্ধ্যায় অভিনেতাকে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন ২১ ডিসেম্বর তাঁর শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। গত বৃহস্পতিবার কিছুটা ভালো ছিলেন আবদুল কাদের। করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে পরিবারের কেউ হাসপাতালে ছিলেন না। বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে হঠাৎ এই অভিনেতার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকেরা করোনা ইউনিট থেকে তাঁকে হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করেছেন। সেখানেই আজ সকালে না–ফেরার দেশে চলে যান।
আবদুল কাদের কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকে ‘বদি’ চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল আলোচনায় আসেন। এ ছাড়া জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র পরিচিত মুখ তিনি। হাস্যরসাত্মক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ছোট পর্দায় তিনি তুমুল জনপ্রিয়। নাটক, চলচ্চিত্রের পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্রেও দেখা গেছে তাঁকে। থিয়েটারেও সরব ছিলেন তিনি।
অভিনেতা আবদুল কাদের ১৯৫১ সালে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল আর মায়ের নাম আনোয়ারা খাতুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন আবদুল কাদের। কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। তিনি অর্থনীতিতে সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন।
বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরির পর ১৯৭৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক কোম্পানি ‘বাটা’তে চাকরি করেন। সেখানে ছিলেন ৩৫ বছর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে আবদুল কাদেরের প্রথম নাটকে অভিনয়। ১৯৭২-৭৪, পরপর তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুহসীন হল ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
থিয়েটারের প্রায় ৩০টি প্রযোজনার এক হাজারের বেশি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘তোমরাই’, ‘স্পর্ধা’, ‘দুই বোন’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’।
১৯৮২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসবে বাংলাদেশের নাটক থিয়েটারের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এ অভিনয়। এ ছাড়া দেশের বাইরে জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, দিল্লি, দুবাই এবং দেশের প্রায় সব কটি জেলায় আমন্ত্রিত হয়ে অভিনয় করেছেন। টেলিভিশনে দুই হাজারের বেশি নাটকে অভিনয় করেছেন কাদের। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মাটির কোলে’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘সবুজ সাথী’, ‘তিন টেক্কা’, ‘যুবরাজ’, ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’, ‘প্যাকেজ সংবাদ’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘কুসুম কুসুম ভালোবাসা’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘আমাদের ছোট নদী’, ‘দুলাভাই’, ‘অজ্ঞান পার্টি’, ‘মোবারকের ঈদ’, ‘বহুরূপী’, ‘এই মেকআপ’, ‘ঢুলি বাড়ি’, ‘সাত গোয়েন্দা’, ‘এক জনমে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘খান বাহাদুরের তিন ছেলে’ ইত্যাদি। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের কাজও করেছেন এ সফল অভিনেতা।