গত ২১ নভেম্বর। রাজধানীর মিরপুরে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিআরআই এর অফিসে জড়ো হন শহরের ১৫ জন রিকশাওয়ালা, পর্দায় নিজেদের জীবন দেখার জন্য। রিকশাওয়ালাদের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে ছয় পর্বের সিরিজ। নাম ‘রিশকাওয়ালা’।
‘ঘামের দাম পেয়ে গেছি’
‘রিশকাওয়ালা’ সিরিজে যে ছয়জন রিকশাচালকের জীবনের গল্প উঠে এসেছে, তাঁদের একজন নীলচাঁদ সরদার। পর্দায় নিজেকে দেখলেন। অন্যদেরও দেখলেন। দেখলেন আরও কত কিছু। সবই তাঁর মতো মানুষদের জীবন ঘিরে। তারপর যখন তাঁকে কিছু বলতে সামনে ডাকা হলো, তখন অনেকক্ষণ তাঁর মুখে কোনো ‘রা’ নেই। এক মিনিট ধরে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। তারপর হঠাৎ কিছু বলার আশা ছেড়ে দিয়ে হু হু করে কান্না শুরু করলেন। কান্না যে তীব্র ছোঁয়াচে, সেদিন উপস্থিত সবাই টের পেয়েছে। নীলচাঁদের কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসান আশরাফ। শিক্ষকের কাছে গিয়ে কান্না আটকে রাখতে পারলেন না এই সিরিজের পরিচালক আরিফুর রহমান। কান্না গিলে ফেলতে পারেননি উপস্থিত কেউ। এই সিরিজের স্বজন আহমেদ পরিচালককে বললেন, ‘এত দিনের সব কষ্ট সার্থক। সব ঘামের দাম পেয়ে গেছি।’
যে অশ্রু জীবনযুদ্ধের স্বীকৃতির
অনেকক্ষণ পর রিকশাচালক নীলচাঁদ জানান, তিনি গ্যারেজে ফিরে মাঝেমধ্যে টিভি দেখেন। টিভির সেই পর্দা কখনো নিচে থাকে না। এমন দূরত্বে রাখা হয়, যাতে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। সেদিন রিকশাচালকেরা নিজেদের পর্দায় দেখেছেন নায়কের মতো, মাথা উঁচু করে। জীবন যে তাঁদের এত সম্মান এনে দেবে, কখনো ভাবেননি। এই অশ্রু তাই সম্মানের। এই অশ্রু ঢাকা শহরের ১০ লাখের বেশি রিকশাচালকের ভাসমান জীবনযুদ্ধের স্বীকৃতির।
‘রিশকাওয়ালা’র গল্প
এই সিরিজের পরিচালক আরিফুর রহমান পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে। তাঁর শিক্ষক হাসান আশরাফ একদিন তাঁকে ডেকে রিকশার নগরী ঢাকা শহরের রিকশাচালকের ওপর সিরিজ নির্মাণের পরামর্শ দেন। উদ্দেশ্য মূলধারার উন্নয়নের সঙ্গে তাঁদের কোথাও না কোথাও যুক্ত করা। ফ্লাইওভারের নিচের মানুষগুলোকেও তুলে আনা। এই শহরের ২ কোটি মানুষ যাতায়াতের জন্য প্রতিদিন এই মানুষগুলোর ওপর নির্ভর করে। বছরের গোড়া থেকে শুরু হয় গবেষণা। শেষে ৫০ জন রিকশাচালকের জীবন লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর পরিকল্পনাগুলো জড়ো করে তৈরি হলো অ্যানিমেশন। চলল ডেমো শুটিং। শেষে সব সমস্যা শেষে শুরু হয় শুটিং।
ছয় পর্বে যা আছে
নীলচাঁদের দুঃখ, পুলিশের সার্জেন্ট নাকি ‘প্রাইভেট ওয়ালাদে’র কিছুই বলেন না। রিকশাচালক দেখলেই বলে ‘হ্যাটাও’। অন্যদিকে উপস্থাপক জয়ী আবার রিকশাওয়ালা রফিক ভাইকেই বানালেন প্যাসেঞ্জার। রিকশাওয়ালাদের নিয়ে গান শোনালেন। রফিক ভাইও কম যান না, তিনি জয়ীকে দিলেন ১০ টাকা। রিকশাচালক রেজাউল করিম গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছেন পালিয়ে, প্রেমিকার হাত ধরে। তারপর বিয়ে করে সংসার। রিকশা চালিয়েই সেটা চলে। তিনি যে সুখে আছেন, তা তাঁর গালভরা হাসি বলে দেয়। রিকশাচালক রোমানার গল্প আবার ভিন্ন। তিনি প্রেম করেন না, কারণ কোনো ছেলেকেই বিশ্বাস করেন না। ছেলেরা নাকি প্রেমিকাকে মিথ্যা বলে। তাই প্রেমের প্রস্তাব পেলেও তা ছুড়ে ফেলে রিকশা নিয়ে চলছেন অজানা গন্তব্যে। আর সেই টাকায় পড়াশোনা শিখছে তাঁর ভাইবোন।
যাঁদের হাতে নির্মিত হয় এই সিরিজ
‘রিশকাওয়ালা’ সিরিজের উপস্থাপক শারমিন জয়ী, সাদিয়া আফরিন, আরিফুর রহমান। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী চিবল সাংমা ও নীলিমা দোলা—তাঁরা শেয়ার করেছেন তাঁদের জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা। যে ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে রিকশাওয়ালারা। প্রজেক্টটি তত্ত্বাবধান করেছেন হাসান আশরাফ। প্রযোজনা করেছেন বিজন ইমতিয়াজ ও ডাচ প্রযোজক রোল্যান্ড পোস্টমা। সহযোগিতায় ছিলেন সৌমিত্র পার্থ, স্বজন আহমেদ, সম্রাট স্যাম, সোহাগ চৌধুরি, নাহিদ মাসুদসহ আরও অনেকে। আর ছিলেন এই শহরের কয়েকজন রিকশাওয়ালা।
শেষ হইয়াও হইল না শেষ
পরিচালক আরিফুর রহমান সন্ধ্যায় ‘রিশকাওয়ালা’র শুটিং শেষ করে বাড়ি ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে রাতে রওনা দেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে বুসান এশিয়ান ফিল্ম স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উড়াল দেন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। সেখানে ছয় সপ্তাহের জিএমএম প্রোগ্রামে রেজওয়ান শাহরিয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অংশ নেন। এর মধ্যেই চলেছে ‘রিশকাওয়ালা’র সম্পাদনার কাজ। দেশে ফিরে জেট লেগ কাটতে না কাটতেই পরপর দুই দিন প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। কোথায় দেখা যাবে এই সিরিজ, সেটি নিয়ে মিটিং করলেন। আজ রোববার বিকেলে যাবেন ভারত। সেখানে ‘রিশকাওয়ালা’র প্রমোশনাল গান রেকর্ড করবেন। গান গাইবেন অর্ক মুখার্জি। তাঁকে যখন এই সিরিজটি পাঠানো হলো, তিনি কেবল রোমানার পর্বটি দেখেছেন সাতবার। দেখে তাঁর মুগ্ধতা জানিয়েছেন। আর এই সিরিজের জন্য গান গাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। গাইবেন ‘সাইকেলের দুই দিকে চাকা, মইধ্যে ফাঁকা...’।
রিকশাওয়ালাদের জীবন যেমন
যতজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাঁদের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি রিকশাওয়ালার পরিবার থাকে গ্রামে। তাঁরা ছিলেন কৃষক। ফসলের ঠিকঠাক দাম না পাওয়ায় শহরে এসে রিকশা চালান। একবার যিনি রিকশার প্যাডেলে পা রাখেন, তিনি আর এই পেশা ছাড়তে পারেন না। কেন? তাঁদের ভাষায়, ‘রিকশা না চালাইলে হাত–পা চাবায়, কামড়ায়। মনের ভেতরেও অস্থিরতা হয়।’ আর কাঁচা টাকার প্রতি আকর্ষণ তো আছেই। রাতে গ্যারেজে ফিরে খাবার খান, টিভি দেখেন, আড্ডা দেন। কিছুদিন রিকশা চালিয়ে তাঁরা গ্রামে যান, পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে। ফসলের মৌসুমে কৃষিকাজ করেন। সব মিলিয়ে, জীবন একেবারে খারাপ লাগে না তাঁদের।