এক ইত্যাদি ছাড়া আর কোনো ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের নাম এখন খুব একটা শোনা যায় না। ৩০ বছর ধরে টেলিভিশনের পর্দায় অনুষ্ঠানটি দেখছেন দর্শকেরা। অথচ নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ইত্যাদি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি শুভেচ্ছা এবং আজকাল নিয়েও আলোচনা হতো। একই সময়ে বহুরূপী নামেও একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো বিটিভিতে। দেশের টেলিভিশনে একাধিক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হলেও সেই অর্থে দর্শকের আগ্রহ ইত্যাদি ছাড়া অন্য কেউ খুব একটা পূরণ করতে পারছে না। বছরের দুই ঈদে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হিসেবে আনন্দ মেলা প্রচারিত হলেও এটিকে ঘিরে দর্শকের কাছে আগের সেই আবেদন নেই। তবে আনজাম মাসুদ বলছেন, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের দর্শকপ্রিয়তা মোটেও কমেনি, দর্শক কমে গেছে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ টেলিভিশন জন্মলগ্ন থেকে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার করত। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের উপস্থাপনায় ‘সপ্তবর্ণা’ ও ‘চতুরঙ্গ’, এরপর ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’, আনিসুল হকের ‘অন্তরালে’ ছিল উল্লেখযোগ্য। আনন্দ মেলা একেক সময় একেকজন উপস্থাপনা করতেন। এই তালিকায় দেখে গেছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আবেদ খান, জুয়েল আইচ, আফজাল হোসেন, সানজিদা আখতারদের নাম।
বর্তমানে দেশের টেলিভিশনে ইত্যাদি, পরিবর্তন, স্মাইল শো—এই তিনটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। বিশেষ দিবস কিংবা উৎসবে পাঁচফোড়ন ও আনন্দ মেলা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানও প্রচার করে টেলিভিশন।
১৯৯৬ সালের শেষ দিকে আনজাম মাসুদ আজকাল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। কয়েক বছর পর তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আজ কাল পরশু নামে নতুন আরেকটি অনুষ্ঠান শুরু করেন। দুই বছর ধরে করছেন পরিবর্তন। তিনি বলেন, ‘এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আজকাল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের তুলনায় এক শ ভাগের এক ভাগও দর্শক প্রতিক্রিয়া পাই না। আগে শুধু একটা চ্যানেল থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে বিটিভিই দেখত। প্রতি শুক্রবার অপেক্ষা করত কখন ইত্যাদি, শুভেচ্ছা আর আজকাল দেখানো হবে। এখন মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে, সময়ও বদলে গেছে। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে গ্রামে বসেও একজন মানুষ পৃথিবীর সব চ্যানেল দেখছেন। রিমোট হাতে নিলেই এক শ চ্যানেল পেয়ে যাচ্ছেন। বিশ্বাস করি, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা আছে। সমাজের জন্য প্রয়োজনও। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাচ-গানের ফাঁকে সমাজের অনেক অসংগতি তুলে ধরা যায় খুব সুন্দরভাবে। তাই এ ধরনের অনুষ্ঠান যত হবে তত ভালো।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপস্থাপক বললেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সেই দর্শক এখন আর নেই। অনেকের ধারণা, বাংলাদেশ টেলিভিশন এখন আর কেউ দেখে না। এখনকার অনুষ্ঠানে আঙ্গিকগত পরিবর্তন দরকার। অন্যথায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের দর্শক আরও কমবে।
কেউ কেউ বলছেন, একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে খরচ আছে! অনেক শিল্পী থাকেন। নাটিকা থাকে, গান-নাচে অংশ নেন তাঁরা। চার ক্যামেরায় কাজ হয়। সব মিলিয়ে যে বাজেট দাঁড়ায়, তা অনেক চ্যানেলের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব হয় না। শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজেট উঠিয়ে আনা কষ্টকর।
ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দর্শকপ্রিয়তা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘আগে যাঁরা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন, তাঁরা ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। উপস্থাপনার কাজটা তাঁরা পেশা হিসেবে করতেন না, বরং এটা ছিল তাঁদের প্যাশন। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁদের কেউ এ কাজ করতেন না। তাঁদের একটা ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল ছিল।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মনে করেন, এখনো অনেক ভালো অনুষ্ঠান হয়, কিন্তু চ্যানেল বেশি হওয়ায় বেশির ভাগ লোক সেটা জানতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনের উচিত ভালো অনুষ্ঠানগুলো বেশি বেশি পুনরাবৃত্তি করা।’
৫২ বছর ধরে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতা নওয়াজীশ আলী খানের। বর্তমানে তিনি গ্লোবাল টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান জনপ্রিয় না হওয়ার প্রধান অন্তরায় বিষয়–বৈচিত্র্যের অভাব। প্রায় একই রকম বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
সফল উপস্থাপক হানিফ সংকেতের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।