নাটকের স্ক্রিপ্ট হচ্ছে নাটকের নকশা। ভালো কিছু বানাতে দরকার ভালো হাতের নকশা। ভালো দালান বানাতে লাগে ভালো আর্কিটেক্টের নকশা। জাহাজ বানাতে লাগে নিখুঁত নকশা, গাড়ি বানাতে লাগে, বাড়ি বানাতে লাগে, যুদ্ধের চৌকস নকশা লাগে। ভালো ও সুন্দর কিছুর জন্যই দরকার পাকা হাতের নকশা। নাটকের স্ক্রিপ্টও তাই।
যখন শুধু বিটিভি ছিল, বাড়ির দর্শক আগ্রহ নিয়ে নাটক দেখত। এত নাটকের মধ্যেও মানুষের মনে দাগ কেটে আছে ‘ইডিয়ট’, ‘দুরবিন দিয়ে দেখুন’, ‘বাবার কলম কোথায়’, ‘সংশপ্তক’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘অয়োময়’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’। বিটিভির অন্য নাটকগুলো বিটিভিতেই হয়েছে, প্রযোজক একই ছিলেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীও এক। পার্থক্যটা গড়ে দিয়েছে স্ক্রিপ্ট। রেগে কেউ বলতেই পারেন, তাহলে কি প্রযোজক বা অভিনয়শিল্পীদের কৃতিত্ব নেই? অবশ্যই আছে। ভালো স্ক্রিপ্ট পেলে ডিরেক্টর, অভিনয়শিল্পীদের শিল্পের ক্ষুধা চাগাড় দিয়ে ওঠে। সম্মিলিত চেষ্টায় নাটকটি হয়ে ওঠে দর্শনীয়। অনেকটা ফুটবল খেলার মতো। ভালো মাঠ পেলে টোটাল ফুটবলে উজাড় করে খেলে সবাই। দর্শক হুমড়ি খায় সেই খেলা দেখতে।
টিভি নাটক আর চলচ্চিত্রের ব্যাকরণে পার্থক্য আছে। বিষয়টা প্রথম আমাকে বলেন কিংবদন্তি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ। এক বইমেলায় তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয় পর্বটা মজার। প্রসঙ্গ যখন এলই, বলি।
হুমায়ূন আহমেদ তখন ভয়াবহ জনপ্রিয় লেখক-নাট্যকার। ভক্তদের হাত থেকে বাঁচাতে বইমেলা থেকে পুলিশ কর্ডনে বের করতে হয়। জনপ্রিয় বলে দেশের বেশির ভাগ লেখক তাঁকে হিংসা করেন। আমি করি না। গোটা দুয়েক বই বের হওয়ায় আমিও তখন নতুন লেখক। পছন্দের লেখক হুমায়ূন আহমেদকে একটা বই উৎসর্গ করলাম। নাম ‘বই বেচা-রা’। বইটা তাঁকে পৌঁছানো দরকার। বইমেলার এক স্টলে প্রচণ্ড ভিড়। ভেতরে হুমায়ূন স্যার বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। ভিড় ঠেলে স্টলের একজনকে বইটা দিলাম স্যারকে দিতে। অটোগ্রাফরত হুমায়ূন আহমেদ আমার বই হাতে নিয়েই বিরক্তির সঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘এইটা তো আমার বই না!’ মুখ থুবড়ে পড়ল আমার ‘বই বেচা-রা’। স্টলের ছেলেটাকে বললাম, ‘বলেন, তাঁকে এটা উৎসর্গ করা হয়েছে।’ এবার তিনি বইটা হাতে নিলেন, দেখলেন, সামনে তাকালেন। অটোগ্রাফ থেমে গেল। হিংসার রাজ্যে কে এই গবেট লেখক তাঁকে বই উৎসর্গ করেছে? মাথা উঁচু করে বললেন, ‘কে?’ ভিড় থেকে হাত তুলে বললাম, ‘স্যার আমি।’ সস্নেহে আমাকে ভেতরে ডেকে পাশে বসালেন। পাশে গুলতেকিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন বসা। গল্প জুড়ে দিলেন। ততক্ষণে বাইরের অটোগ্রাফ শিকারিদের হই-হল্লা-চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। ‘এই পিচ্চি ক্যাঠা’-জাতীয় শব্দ কানে আসামাত্রই উঠতে চাইলাম। স্যার আমাকে তাঁর নতুন কয়েকটি বই উপহার দিয়ে বললেন, ‘আর কী চাও? যা চাবে, তা-ই পাবে।’ বললাম, ‘আমাকে নাটক লেখার নিয়মকানুন শেখাবেন। আর কিছু চাই না, অনেক দিয়েছেন স্যার, থ্যাংক্যু।’ তিনি সম্মতির মাথা নাড়লেন, ফোন নম্বর দিলেন, শুক্রবার বাসায় যেতে বললেন।
স্টল থেকে বেরোনোর সময় ভিড় থেকে ‘পুঁই পুঁই’ সিটি আর ‘ওই গেলি’-জাতীয় বিভিন্ন শব্দ কানে এল।
শুক্রবার হুমায়ূন স্যারের ধানমন্ডির ‘গুলতেকিন’ নামের বাসায় গেলাম। শার্ট গায়ে লুঙ্গি পরে ডাইনিং টেবিলে লিখছেন তিনি। অপেক্ষা করছিলেন। নুহাশ খেলছে, শীলা মিটিমিটি হাসছে। সুন্দরী শীলার মিটিমিটি হাসির উত্তরে পাল্টা হাসি দিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম কাগজ-কলম নিয়ে।
‘হিসু’ দিয়ে নাটক আর চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্টের পার্থক্য বললেন হুমায়ূন স্যার। বললেন, ‘ধরো হিসু। একজন লোক টয়লেটে ঢুকে হিসু করে ফ্ল্যাশ করে বেরিয়ে এল। এটা চলচ্চিত্রে দেখানো যাবে, কিন্তু টিভি নাটকে দেখানো যাবে না।’ বললাম, ‘তা কী করে হয় স্যার? সবাই ওটা দেখে ফেলবে না?’ বললেন, ‘দেখবে কেন? কমোড দেখানো যাবে, ফ্ল্যাশ করার শব্দ শোনানো যাবে, কিন্তু ক্যামেরা ধরতে হবে এমন অ্যাঙ্গেলে, যাতে ওটা দেখা না যায়।’
স্ক্রিপ্ট বেসিক শিখলাম স্যারের কাছে।
শুরু করে দিলাম স্ক্রিপ্ট লেখা। গল্পকার হিসেবে আমার সাবজেক্ট ছিল হিউমার, নাটকের সাবজেক্ট কমেডি। দর্শক মজা পেল। অভিনয়শিল্পীরাও। প্রযোজকেরা হ্যান্ডসাম টাকা দিয়ে স্ক্রিপ্ট নিয়ে যায়।
এই শতকের প্রথম দিকে দেশে উঁচুমানের কয়েকজন পেশাদার স্ক্রিপ্ট রাইটার উদয় হয়েছিলেন। নন্দিত হয়েছিলেন। হয়েছিলেন জনপ্রিয়ও।
গত এক দশকে দেশে বহু টিভি চ্যানেল হয়েছে। প্রচুর টিভি নাটক-সিরিয়াল হচ্ছে। কিন্তু দেশের টিভি নাটকের দর্শক বাড়েনি। দর্শক ঝুঁকেছে ইন্ডিয়ার জি বাংলা, স্টার জলসার টিভি সিরিয়ালের দিকে। এর কারণ হচ্ছে ধরে রাখার মতো স্ক্রিপ্ট। কেউ রেগে আমাকে ‘এন ইডিয়ট’ বললে আমি ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর কথা বলব। এর স্ক্রিপ্ট পড়ে আমির খান এত মুগ্ধ হন যে বিনা পয়সায় এতে অভিনয় করার কথা বলে দেন। যদিও তাঁকে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক অফার করা হয়েছিল। তবে শর্ত জুড়ে দেন, যা প্রফিট হবে, ফিফটি ফিফটি। ‘সই’, বলল প্রযোজক। আমির খান ‘থ্রি ইডিয়টস’ থেকেই কয়েক শ কোটি রুপি কামিয়েছেন।
হলিউডের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুভি ‘গানস অব নাভারন’-এর একটি দৃশ্যে অভিনেতা অ্যান্টনি কুইন সুন্দরী গুপ্তচর মেয়েকে লং ড্রাইভে নিয়ে যখন ননস্টপ বকবক করছে, মেয়েটি থামিয়ে দিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আই লাভ ইউ।’ থেমে থতমত অ্যান্টনি কুইন মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘আই লাভ ইউ টু!’ যেন মেয়েটি অ্যান্টনি কুইনের কাছে চালতার আচার চেয়েছে, আর অ্যান্টনির বুকপকেটে এক পোঁটলা ছিল, সে তা দিয়ে দিয়েছে। হো হো করে হেসে উঠল দর্শক। এই যে বকবকের মাঝখানে মধ্যবয়সী দুজনের সিরিয়াস ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া-নেওয়ার মজার ছোট্ট দুটি ডায়ালগ, এটা পাকা স্ক্রিপ্ট রাইটার ছাড়া অসম্ভব।
আবার বিটিভিতে আসি। যাঁরাই হুমায়ুন আহমেদের নাটক বানাতেন, তাঁরাই হুমায়ুন স্যারকে শুটিংয়ের সময় পাশে রাখতেন। এই বিটিভির ডিরেক্টর বা প্রযোজকেরা কিন্তু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু তাঁরা বুঝতেন, একজন জাত লেখক যখন কোনো চরিত্র লেখেন, তিনি তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, সংলাপের ধরন কল্পনা করেই লেখেন।
‘কোথায় যাচ্ছ?’ আর ‘যাচ্ছ কোথায়?’—এই দুই সংলাপের বলার ধরনই পালটে দিতে পারে একটি দৃশ্যের আবহ। এটা যিনি লেখেন, তিনিই সবচেয়ে ভালো বোঝেন।
স্ক্রিপ্ট ছাড়া কোনো মঞ্চ অভিনেতাকে মঞ্চনাটক করতে বলেন তো? সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকেই বলেন। তিনি সেলিব্রিটি অভিনেতাও। দেখি করেন কি না।
মঞ্চনাটকে অভিনয়শিল্পী ডায়ালগ ভুলে গেলে মঞ্চের আড়াল থেকে একজন তা ধরিয়ে দেন। তাঁর সামনে স্ক্রিপ্ট থাকে। একে প্রম্পটার বলে। যাত্রাপালাতে তো প্রম্পটার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিচু গলায় স্ক্রিপ্ট পড়তে থাকেন, আর তা শুনে শুনে অভিনয়শিল্পীরা উঁচু গলায় ডায়ালগ দেন। এই যাত্রাপালাগুলো কিন্তু রাতের পর রাত জেগে মানুষ দেখত। বলবেন, তখন বিনোদনের কিছু ছিল না, তাই দেখত। তাহলে শুনে রাখেন, ‘সুলতান সুলেমান’ হচ্ছে সেই যাত্রাপালারই আধুনিক প্রযুক্তির ডিজিটাল রূপ। এখনো বলবেন, বিনোদনের অন্য কিছু নেই?
আমাকে হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলেও স্বীকার করব না, জি বাংলা বা স্টার জলসার নির্মাতাদের মতো দক্ষ নির্মাতা আমাদের নেই। ওদের অভিনেত্রীদের চেয়ে আমাদের অভিনেত্রীরা কোনো অংশে কম সুন্দরী? তাহলে মানুষ জি বাংলা, স্টার জলসার সিরিয়ালে ঝুঁকছে কেন? ওই যে বললাম, সিচুয়েশন, সংলাপ। মানে, পাকা হাতের স্ক্রিপ্ট।
কতগুলো বিকৃত শরীর বা ভেংচি কাটা মুখ দিয়ে দর্শক হাসাতে গেলে দর্শক হাসবে না, মানুষ হাসবে। ভালো হাতের স্ক্রিপ্ট ছাড়া অখাদ্য বানালে দর্শক খাবে কেন? অনেকে বাজেটকে দুষছেন। এটা ঠিক, আমাদের নাটকের বাজেট খুব কমে গেছে। এরপরও কথা থাকে। মজার রেসিপির লাউ-চিংড়ি, টমেটো চাট, বেগুন ভর্তা, আলুর দম বা টাকি মাছের ভর্তা বানাতে খুব বেশি টাকা লাগে? আমরা তো দামি রেস্তোরাঁয় বেশি দাম দিয়ে তা মজা করে খাই। রহস্যটা কোথায়? রেসিপিতে।
রেসিপিটাই আসল। আর ওটাই স্ক্রিপ্ট। খাবারে যেমন রেসিপি, নাটকে তেমন স্ক্রিপ্ট।
ভালো রেসিপি হলে সে খাবার মানুষ খাবেই। ভালো স্ক্রিপ্টেই হবে ভালো নাটক!