দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলায় ডাবিং করা বিদেশি ধারাবাহিক প্রচারের কারণে অনেক পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলী কাজ হারাচ্ছেন। পিক টাইমে এসব ধারাবাহিক প্রচারের কারণে ভালো মানের দেশীয় অনুষ্ঠান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন দর্শক—এমনটাই মনে করছেন অভিনয়শিল্পীদের সংগঠনের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম। বাংলায় ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়াল প্রচারকারী টেলিভিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব মোটেও মানতে রাজি নন। দীপ্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা সুবর্ণা পারভীন মনে করছেন, ‘টেলিভিশন চ্যানেলে বিদেশি ধারাবাহিক ডাবিং করে প্রচারের উপযোগী করার পেছনে কাজ করছেন দুই শতাধিক শিল্পী ও কলাকুশলী। তাঁরা সবাই বাংলাদেশেরই। আমি তো বলব, আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশি ধারাবাহিকের মাঝামাঝি সময়টাতে দেশের ধারাবাহিক নাটকও প্রচার করছি।’
দীপ্ত টেলিভিশনে সুলতান সুলেমান, ফাতমাগুল ও শার্লক হোমস প্রচারিত হচ্ছে। এর বাইরে চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, এনটিভি, জিটিভি, মাছরাঙা টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে যথাক্রমে ইউনুস, জান্নাত, পালক আকাশে ওড়ে, ছিবি মারুফ চান, আলিফ লায়লা এবং দ্য লিরিস ও হারকিউলিস। চ্যানেল আই ও এনটিভি ছাড়া বাকি সব কটি চ্যানেল পিক টাইমে এসব ধারাবাহিক প্রচার করছে।
দুই বছর আগে বিদেশি ভাষায় ডাবিং করা ধারাবাহিকগুলো বন্ধে আন্দোলন করেছিল ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন (এফটিপিও)। যোগাযোগ করা হলে ডিরেক্টরস গিল্ডের সাবেক সভাপতি ও এফটিপিওর সদস্যসচিব গাজী রাকায়েত বলেন, ‘আমরা একটা নীতিমালা তৈরি করে সরকারকে দিয়েছিলাম। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে একটি কমিটিও করা হয়েছে। সবার একটা সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে, বিদেশি ভাষার সিরিয়াল আসাতে কোনো সমস্যা নেই, অবশ্যই সঠিক অনুমোদনের মাধ্যমে প্রচার করতে হবে।’
গাজী রাকায়েত জানান, তথ্যসচিব, বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো) ও টেলিভিশন নাটকের চারটি সংগঠনের নেতারা বিদেশি ধারাবাহিকের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে এসব প্রচারের ব্যাপারে একটা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরির প্রস্তুতি চলছে।
দেশের বাইরে থেকে কোনো অনুষ্ঠান আমদানির ক্ষেত্রে কোন শ্রেণির দর্শককে টার্গেট করা হচ্ছে, তা নিয়ে ভাবতে হবে বলে মনে করছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। তিনি বলেন, ‘বিটিভির আমলে যখন বিদেশি ধারাবাহিক আমদানি করা হয়েছিল, সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। এখন তো লোকদেখানো অনুমতি নিয়ে এসব বিদেশি ধারাবাহিক আমদানি করা হচ্ছে।’
বিষয়টি মানতে নারাজ দীপ্ত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা সুবর্ণা পারভীন। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকারের সঠিক নিয়ম মেনে আমাদের অনুষ্ঠান আমদানি করছি।’
সেলিম বলেন, ‘যেসব বিদেশি ধারাবাহিক দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছে, এসবের অনেক কিছু আমাদের সমাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’
কিন্তু এসব অনুষ্ঠান তো জনপ্রিয় হচ্ছে। এমন প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, জনপ্রিয় তো হবেই। আজেবাজে কনটেন্টই বেশি জনপ্রিয় হয়। অনুষ্ঠানের মধ্যে যৌন সুড়সুড়িমূলক উপাদান থাকলে তো জনপ্রিয় হবেই।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান বলেন, ‘বিদেশি ধারাবাহিক প্রচারের ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ ছিল না। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বাণিজ্যিক কারণে প্রচার করতে হচ্ছে। প্রচারের পর দর্শকের কাছ থেকে কিন্তু ভালোই সাড়া পাচ্ছি।’
চ্যানেল আইয়ে রাত সাড়ে ১১টায় দেখানো হয় বিদেশি সিরিয়াল ইউনুস। বিদেশের ধারাবাহিক নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা ইবনে হাসান খান বলেন, ‘দেশের পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে যেসব নাটক ও অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে, সেগুলো আমাদের দর্শক ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। বিদেশি সিরিয়ালগুলো নির্মাণে এতটাই পেশাদারির ছাপ থাকে যে দর্শক এসব দেখতে বাধ্য হন। জনপ্রিয়তার কারণে আজ রবিবার তো হিন্দিতে ডাবিং করে প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশে এ রকম আরও ৫০টা সিরিয়াল যদি থাকত, বিদেশের চ্যানেল ডাব করে চালানো হতো।’
গাজী রাকায়েত বলেন, ‘আমরা কেউ কাউকে যেন দোষারোপ না করি। সবকিছুই নিয়মের মধ্যে থাকা উচিত। বিদেশি সিরিয়াল যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে, এতে অবশ্যই দেশের শিল্পী ও পরিচালকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’