বন্ধু, তুমি যেখানেই থাকো, আনন্দে থাকো। তোমার সৃজনশীল, শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুমি কোটি মানুষের অন্তরে আনন্দ দিয়েছ, এটা তোমার প্রাপ্য। তোমার সঙ্গে প্রথম কোথায় পরিচয়, আজ আর তা ঠিক মনে আসছে না। তবে সত্তরের দশকে যখন তুমি নয়নমণি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হলে, তখন থেকেই তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সখ্য গড়ে উঠল। সত্যদার (প্রয়াত সংগীত পরিচালক সত্য সাহা) বাসায় সবাই মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী আড্ডাই না জমে উঠত। গ্রামীণসমাজ, জীবন, সংস্কৃতি সম্পর্কে তোমার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা সবাইকে বিস্মিত করত এবং তারই প্রতিফলন দেখতে পেলাম তোমার অসাধারণ নির্মাণকৌশলসমৃদ্ধ কিছু চলচ্চিত্রে—গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, কসাই, ভাত দে ইত্যাদিতে।
তুমি সামগ্রিকভাবে বাংলা চলচ্চিত্রে যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলে। গ্রামীণ জীবনের সুখ, দুঃখ, বঞ্চনা, ভালোবাসার এমন বাস্তব, আবেগঘন চিত্রায়ণ বাংলা চলচ্চিত্রে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে তোমাকে একজন পথিকৃৎ বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। তোমার গোলাপী, বিশেষ করে শ্লেষ এবং সহানুভূতির সমন্বয়ে সৃষ্ট ‘জব্বর আলি’ চরিত্রটি, চরিত্র চিত্রায়ণে অসাধারণ দক্ষতারই প্রমাণ দেয়।
জহির রায়হানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়ার সংলাপ তুমিই লিখেছিলে। তোমার সব সৃষ্টিতেই জীবনকে পাই, বিশেষ করে বঞ্চিত, অবহেলিত ও দুঃখী মানুষের। ভাত দে চলচ্চিত্রের বিখ্যাত সংলাপটি, ‘আমি ভাত চুরি করি না তো, খিদা লাগলে খাই।’ এমন গভীর মমতামাখা সংলাপ দুঃখী মানুষের প্রতি অপার ভালোবাসা ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। তোমার চিত্রনাট্যে, সংলাপে, গীত রচনায়—সর্বত্র এই ভালোবাসা, এই আবেগ দর্শককেও আবেগাপ্লুত করেছে, কাঁদিয়েছে, হাসিয়েছে। তোমার প্রায় সব কটি ছবিতেই গান গেয়েছি আমি, যেগুলোর রচনাও তোমারই ছিল। রেকর্ডিংয়ের সময় তুমিও থাকতে। মনে পড়ে, এমনই একটি গানের রেকর্ডিংয়ে রাত তিনটা অবধি গাইয়েছিলে আমাকে, তোমার কান্না পাচ্ছিল না বলে। অবশেষে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘এবার হয়েছে।’ এমনই আবেগপ্রবণ ছিলে তুমি এবং এই আবেগ তোমার চলচ্চিত্রের প্রতিটি ফ্রেমে যেন মিশে রয়েছে। গানের চিত্রায়ণেও তোমার জুড়ি ছিল না। ‘আছেন আমরা মোক্তার’, ‘ও তোদের মা জননী’ বা ‘আমি আছি থাকব’ ইত্যাদি গানের এমন অসাধারণ চিত্রায়ণ যেন তোমার পক্ষেই সম্ভব ছিল।
তুমি নিয়মিত লেখালেখি করলেও সমান খ্যাতি অর্জন করতে পারতে। ছাত্রজীবনেই দেশ পত্রিকায় তোমার কবিতা ছাপা হয়েছিল। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও তো পেয়েছিলে। অভিনয়েও তুমি ছিলে সমান কুশলী। ধারাপাত ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অথবা জব্বর আলি চরিত্রে তোমার অভিনয় আজও মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। আসলে তুমি মানুষটাই ছিলে খুব খেয়ালি।
তোমার সঙ্গে শেষ দেখা এই তো সেদিন চ্যানেল আই চত্বরে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। তুমি বলেছিলে, ‘চলো যাই এফডিসিতে।’ আমি যেতে পারিনি। এখন আফসোস হচ্ছে, কেন যাইনি, তোমার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কাটানো যেত। তোমাকে হাসপাতালে যেদিন দেখলাম, সেদিন তুমি এ জগতে আর ছিলে না। তুমি নেই, এ অভাব পূরণ হওয়ার নয়। তোমার মতো আরেকজন আমজাদ হোসেনের জন্য আমাদের চলচ্চিত্র জগৎকে কে জানে কত দিন অপেক্ষা করতে হবে।
বন্ধু তোমাকে সালাম।
লেখক: সংগীতশিল্পী