বিজ্ঞাপনের চাপে টেলিভিশন নাটক ও অনুষ্ঠানের মান ক্রমেই খারাপ হচ্ছে—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিনয়শিল্পী ও টেলিভিশনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মন্তব্য, দেশে পে-চ্যানেল চালু হলে সরাসরি দর্শকের অর্থ পাবে টিভি চ্যানেলগুলো। এতে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা কমবে। চ্যানেলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। বাড়বে বাজেট। তাতে মানও বাড়বে প্রযোজনার।
অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘পে-চ্যানেল হলে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা কমবে। ফলে সবাই চাইবে ভালো অনুষ্ঠান বানাতে। টেলিভিশনের প্রোগ্রাম বিভাগগুলো স্বকীয় হবে। তারা ভালো বাজেট দেবে, কনটেন্ট খুঁজবে। চ্যানেল যদি ভালো কনটেন্ট তৈরি করতে না পারে, তা হলে তার চ্যানেল কেউ দেখবে না। সে কারণে পে-চ্যানেল হলে স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠান কিংবা নাটক নির্মাণ হবে। ভালো কনটেন্ট তৈরি হবে। অভিনয়শিল্পীরা তাঁদের দক্ষতা দেখাতে পারবেন। এভাবেই নাটকের মান উন্নয়ন হবে।’
টেলিভিশনের একমাত্র আয়ের উৎস বিজ্ঞাপন। এর বাইরে আয়ের একটি উৎস তৈরি হলে বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরতা কমবে। আর কনটেন্টের মান ভালো হবে এ কারণে যে, দর্শক টাকা দিয়ে ভালো কনটেন্টই দেখতে চাইবেন। এমনটাই মনে করছেন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাউদ্দিন লাভলু। তিনি বলেন, ‘কেব্ল অপারেটররা দর্শকের কাছ থেকে যে টাকা পান, তার একটা অংশ যদি চ্যানেলগুলোও পায়, তাহলে নাটক-অনুষ্ঠানসহ প্রতিটি জিনিসেরই মান ভালো হবে। তবে একটা কথা আছে। দর্শকের চ্যানেল পছন্দ করার সুযোগও থাকতে হবে, দর্শক কোন চ্যানেল দেখবেন, কোনটা দেখবেন না।’
নাটক ও অনুষ্ঠানের মান কমে যাওয়ায় চ্যানেলের ভিউ কমে যায়। এতে বিজ্ঞাপনদাতারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং বিজ্ঞাপনের মূল্য কমে যায়। বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহী করতে এবং ভালো ভিউয়ের জন্য ভালো কনটেন্টের বিকল্প নেই। সুতরাং ভালো কনটেন্ট নির্মাণে বিজ্ঞাপনের বাইরে যদি কোনো উৎস থেকে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর আয়ের সুযোগ থাকে, তা হবে ভালো খবর। টেলিভিশন অ্যান্ড ডিজিটাল প্রোগ্রাম প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ইরেশ যাকের বলেন, ‘পে-চ্যানেল হলে তো খুবই ভালো হয়। এতে প্রযোজনার বাজেট বাড়বে। এখন টিভির ভিউ কমছে। বিদেশি চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছে। যদি পুরোটাই বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে সমস্যা হবে। বিজ্ঞাপনদাতারা প্রোডাকশন বানাতে আসেন না। তাঁরা পণ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য আসেন। তাঁদের সুযোগ যেখানে বেশি হবে, তাঁরা সেখানেই যাবেন। সেই জায়গায় টেলিভিশন চ্যানেলের ভিউ যদি কমে, সেখানে বিজ্ঞাপনদাতারাও একই দামে বিজ্ঞাপন দেবেন না। শুধু বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করলে বিদেশি চ্যানেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকাটা কষ্টকর হবে। সেই জায়গা থেকে যদি আরেকটা আয়ের উৎস আসে, তাহলে অনুষ্ঠানের মান উন্নয়ন হবে। ভালো মানের কনটেন্টও হবে। শুধু তা-ই নয়, বিজ্ঞাপনী আয়ও বাড়বে।’
নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার জন্য দরকার চ্যানেলগুলোর কনটেন্ট নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা। যা এ দেশে অপ্রতুল বলে মনে করেন দুরন্ত টিভির অনুষ্ঠানপ্রধান মোহাম্মদ আলী হায়দার। তাঁর মতে, শুধু পে-চ্যানেল করলে তো হবে না, পে-চ্যানেল হওয়ার মতো যোগ্য হয়েও উঠতে হবে। তিনি বলেন, ‘দর্শক আমাকে তখনই টাকা দেবেন, যখন আমি যোগ্য হব। কাজেই পে-চ্যানেল হওয়া মানে অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে চলে যাওয়া। আমার চ্যানেলটাকে অন্য চ্যানেল থেকে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলব—এমন মনোভাব নেই বললেই চলে। পে-চ্যানেল হলে সম্ভব হবে। এতে চ্যানেলগুলো তাদের প্রোডাকশনের মান বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে। আমরা দর্শকের কাছ থেকে যে টাকাটা পাব, তাতে বিজ্ঞাপনের ওপরে আমাদের নির্ভরতা কমবে। বিজ্ঞাপনী এজেন্সি থেকে নানা শর্ত থাকে। এসবের যে সিন্ডিকেট, সেটা ভাঙবে।’
দেশে দীর্ঘ সময় ধরে কেব্ল নেটওয়ার্কের আওতায় স্থানীয় ডিশ কোম্পানিকে একটি নির্ধারিত টাকা দেওয়ার মাধ্যমে চ্যানেলগুলো দেখতে পান দর্শকেরা। সেখানে দর্শকের জন্য আলাদা করে কোনো চ্যানেলের জন্য টাকা দিতে হয় না। পে-চ্যানেল হলে দর্শক পছন্দসই চ্যানেল টাকা দেওয়ার মাধ্যমে দেখতে পারবেন। তবে এটা সহজ ব্যাপার নয়। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একসঙ্গে একটি উদ্যোগে সম্প্রচার পদ্ধতি তৈরির মাধ্যমে এর সমাধানে আসা যেতে পারে। বাংলাভিশনের অনুষ্ঠানপ্রধান তারেক আখন্দ বলেন, ‘আমাদের পাশের দেশেই সম্প্রচার পদ্ধতি আছে। যেমন দর্শকেরা একটা বান্ডল কেনেন। তার ভেতরে কিছু চ্যানেল থাকে। সব নিয়মকানুনসহ ভ্যাট কেটে সরকারও সেখান থেকে আয় করে, আবার চ্যানেলগুলোও পেয়ে থাকে। এই পদ্ধতির সুবিধা হলো, শুধু বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করতে হয় না।’ তিনি বলেন, ‘পে-চ্যানেলের অনেক টেকনিক্যাল দিক আছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সরকারি প্রতিনিধি, টেলিভিশনের অভিজ্ঞ ব্যক্তি, কেব্ল নেটওয়ার্কের প্রতিনিধি মিলে একটা সম্মিলিত ওয়ার্কিং কমিটি করে, একটা পদ্ধতি তৈরি করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে পরিবেশনকারীও টাকা পেল, সরকার ভ্যাট পেল, চ্যানেলও আয়ের একটা পথ পেল। পে-চ্যানেল মোটাদাগে এখন টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির উত্তরণের পথ।’