নিজের কাজের মাধ্যমে বাবা সব বুঝিয়ে দিতেন

গত বছরের ২৭ নভেম্বর ৭৬ বছর বয়সে মারা যান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের। বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। মারা যাওয়ার পর প্রথম জন্মদিন তাঁর। একই দিনে তাঁর ছেলে ইরেশ যাকেরেরও জন্মদিন। দিনটিতে বাবাকে নিয়ে লিখেছেন ইরেশ যাকের

বাবা কোনো দিন হাতে ধরে শিক্ষা দিতেন না। বাবার জীবনের শেষের দিকে আমি মোটামুটি তাঁর শিক্ষক হিসেবে কাজ করতাম। এটা এভাবে বা ওভাবে করো—এসব বাবার মধ্যে কোনো দিন ছিল না। ওভারঅল বলতে পারি, অভিনয়, ব্যবসা সব ক্ষেত্রে তাঁর কাছ থেকে সবচেয়ে বড় শিক্ষা লাভ হচ্ছে—যেটাই করবে, বিশ্বাস নিয়ে করবে।
বাবার টেলিভিশনের নাটকগুলো দেখলে তেমনটাই বোঝা যাবে যে তিনি বিশ্বাস নিয়ে সব করতেন।

বাবা আলী যাকেরের সঙ্গে ছেলে ইরেশ যাকের

দেখা যেত, এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করছেন, যার মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা; অথচ তিনি যে জুতা পরেছেন, সেটির দাম ২০০ ডলার। আমরা করলে অনেকেই হয়তো বলতেন, এটা কেমন করে হয়! কিন্তু তিনি যে বিশ্বাসের সঙ্গে অভিনয়টা করতেন, সেই বিশ্বাসের কনভিকশন—স্টেজ বা টেলিভিশন, যেখানেই বলি না কেন, বিশ্বাসের কারণে দর্শকও বিশ্বাস করতেন, লোকটা এ রকমই। এত দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, এত স্বাস্থ্যবান একটা লোক, ওটা কখনো মাথায় থাকত না। সবাই মনে করতেন, আচ্ছা, বিষয়টা তো এ রকমই। হি ইউজড টু ব্রিং আ লট অব কনভিকশন হিজ ওয়ার্ক।

আমার এক খালা বলতেন, বাবা যে অ্যাডভার্টাইজিং করতেন, লাক্স যদি তাঁর ক্লায়েন্ট হয়, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, লাক্সের চেয়ে ভালো সাবান বাংলাদেশে নেই। এই কনভিকশন নিয়ে তিনি কাজটা করতেন। ওভারঅল শিক্ষা লাভের জায়গা এটাই। আমিও পরে দেখলাম, বিশ্বাস নিয়ে বাবা কাজ করেন। এটার সঙ্গে পাশাপাশি বলতে হয়, তিনি কখনো নীতির সঙ্গে আপস করতেন না। আপস করলে বিশ্বাস রাখা যায় না। আর বিশ্বাস না রাখতে পারলে জীবনে শান্তি আসবে না। ওভারঅল এটিই তাঁর কাছ থেকে আমার শিক্ষা পাওয়া।

জন্মদিনে বাবা আলী যাকেরকে কেক খাইয়ে দিচ্ছেন ছেলে ইরেশ যাকের। এমন দৃশ্য আর কোনোদিন দেখা যাবে না

তিনি যখন মঞ্চনাটকের নির্দেশনা দিতেন, যদিও আমি কোনো দিন তাঁর পরিচালনায় কাজ করিনি, তবে সহশিল্পীদের কাছ থেকে শুনেছি, ছটলু (আলী যাকেরের ডাকনাম) ভাই, কখনো এই ডায়ালগ এভাবে দাও বলতেন না। বাবা শুধুই ছোটখাটো জিনিস ধরিয়ে দিতেন। হয়তো বলতেন, এটা বোধ হয় এ রকম, দ্যাটস ইট। তিনি কোনো দিন, আমার কাজের ক্ষেত্রেও এমনটা করতেন না। কখনো স্পেসিফিক করে বলতেন না, ইরেশ, তোমার এই সময়ে অফিসে আসা উচিত, এটা করা উচিত, ওইটা করা উচিত। নিজের কাজের মাধ্যমে বাবা সব বুঝিয়ে দিতেন।

তাঁর কোনো কাজে আমি খামখেয়ালি করছি দেখলেও তিনি কখনো বলতেন না, তুমি আরেকটু মনোযোগী হও। তিনি শুধু বলতেন, আই থিংক ইউ আর নট বিলিভ হোয়াটস ইউ আর ডুয়িং। তুমি তোমার যেটা কাজ, সেটা এনজয় করছ না। ট্রাই টু ফিগার আউট দ্য ওয়ে, কীভাবে কাজটা তুমি এনজয় করবে। মানুষকে ইন্সপায়ার্ড করে কাজ করাতেন, কোনো দিন মানুষকে ক্রিটিসাইজড করে কিছু করতেন না। সব সময় এম্পাওয়ার্ড করে ভালো করার চেষ্টা ছিল। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করতেন, কাজটা আরও ভালো করলে আমি নিজে কীভাবে আরও ভালো অনুভব করব, সেই জায়গা থেকে মানুষকে ফিডব্যাক দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

গায়েহলুদ ও মেহেদি অনুষ্ঠানে মা সারা যাকের, বাবা আলী যাকের, বোন শ্রিয়া সর্বজয়ার সঙ্গে ইরেশ ও মিম।

ছবি তোলার ব্যাপারটি ছিল বাবার শিশুসুলভ একটি ব্যাপার। বাবা আর্লি লাইফে তাঁর বাবা-মা, বড় বোনসহ সবাইকে হারিয়েছেন। তাঁর ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়, তিনি ছবির মাধ্যমে ওই সময়টাকে ক্যাপচার করার চেষ্টা করতেন। ফটোগ্রাফির টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে তিনি খুব বেশি মাথা ঘামাতেন না। আমরা তো এখন ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে কত আঁতলামি করি। এই টিচারের কাছে শিখি, অনলাইনে ক্লাস করাসহ আরও কত কী যে করি। বাবার ক্ষেত্রে, ইট ওয়াজ জাস্ট ক্যাপচারিং হোয়াট হিজ হার্ট ফেল্ট অ্যাট দ্যাট টাইম।

আমার জীবনের একজন বন্ধু বাবা। এরপর ফিলোসফার ও শিক্ষক। অনেকের আক্ষেপ থাকে, বাবাকে কোনো দিন ‘আই লাভ ইউ’ বললাম না। আমি বাবাকে আমার জীবনে প্রায় সব দিনই আই লাভ ইউ বলেছি। এই জায়গাটা তিনি তৈরি করে গেছেন। তাই এ নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। বাবাকে ওপরে বা নিচে কিংবা কোনো পজিশনালি দেখতে পারব না। বাবা সারাক্ষণই আমার সঙ্গে আছেন মনে করছি।

এক ফ্রেমে পুরো পরিবার—‘বার্থ ডে বয়’ আলী যাকের ও ইরেশ যাকের সঙ্গে সারা যাকের ও শ্রিয়া সর্বজয়া। এমন দৃশ্য আর কোনোদিন দেখা যাবে না

বাবার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, আমাদের বন্ধুত্ব অনেক নিগূঢ়। আমাদের মধ্যে সব বিষয়ে কথাবার্তা হতো। খেলা দেখা থেকে শুরু করে ঝগড়াঝাটি সবই হতো। আমি আবার অপছন্দের মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি না। সব সময় যাঁদের ভালোবাসি বা পছন্দ করি, তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া হতো।

বাবার সঙ্গে একদিন খেলা নিয়ে খুব ঝগড়া হয়েছিল। খুবই হাস্যকর সেই ব্যাপার। একবার মেহরাব হোসেন খেলা শুরু করেছেন। বাবা তখন বলছিলেন, দেখো, ছেলেটা কী ইয়াং, ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে, কী সুন্দর খেলে। আমি বললাম, ও ছোট কেমনে? আমরা একসঙ্গে নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট খেলছি, আমার ২-৩ বছরের সিনিয়র। বাবা বললেন, না না, তা হতেই পারে না। ওকে দেখো, কী তরুণ। এই নিয়ে দুজনের ফাটাফাটি ঝগড়া। অনেক ঝগড়া আবার সেখানেই সমাধান। ক্রিকেট, রাজনীতি, সমাজ—সব নিয়ে। শেষের দিকে বাবা খুব দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। একসঙ্গে অনেক মৌন সময় কাটিয়েছি। এ সময়টায়ও বাবা খেলার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলেন। হাসপাতালের দিনগুলোতেও ক্রিকেট খেলাটাই দেখতেন বেশি।

বাবা আলী যাকেরের ভিডিওচিত্র ধারণ করছেন ইরেশ। পাশে আছেন মা সারা যাকের। এমন দৃশ্য আর কোনোদিন দেখা যাবে না

আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা বন্ধু বাবা-মা-বোন। আমার ওয়াইফ মাঝেমধ্যে বলেন, তুমি কি কোনোদিন তোমার বাবা-মা ও বোনকে ছাড়া পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। আমার মা–ও তো বলেন, তুমি কি শ্রিয়া, ছটলু ও আমাকে ছাড়া কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারো না? আমার সেই বন্ধুকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন। একই দিনে আমার ও বাবার জন্মদিন। বাবাকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন খুবই বাজে, খুব খারাপ।