তাঁর ঝুলিতে রয়েছে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র আর রেডিও—সব মাধ্যমেই অভিনয় করে চলেছেন সমান তালে। তিনি বাংলাদেশের জনপ্রিয় ও গুণী অভিনয়শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু। করোনাকাল, মঞ্চ, বড় ও ছোট পর্দার অভিনয়—দীর্ঘ সময় ধরে কথা হলো এ রকম নানান বিষয়ে।
করোনার দিনকাল কীভাবে কাটছে?
ঘুম থেকে উঠি। নাশতা করি। গৃহস্থালির টুকটাক কাজকর্ম করি। বই পড়ি। সিনেমা দেখি।
গৃহস্থালির কাজকর্ম, যেমন?
যেমন ঘর ঝাড়ু দিই। আমার বাসার দুই পাশে আবার দুটি বড় বারান্দা আছে। আমার বউ তাই ঘর ঝাড়ু দিতে দেয় না। বকে। বলে, লোকে দেখে ফেলবে, কী বলবে! আমি বলি, দেখলে তো ভালো। তারাও ঘরের কাজ করতে অনুপ্রাণিত হবে।
কী কী সিনেমা দেখলেন?
দক্ষিণ কোরিয়ান ‘মিরাকল ইন সেল নম্বর সেভেন’, সাদত হাসান মান্টোর জীবন নিয়ে নন্দিতা দাসের বানানো ছবিটা, ‘লায়ন’। আরও কতগুলো টার্কিশ, মেক্সিকান, ইরানি, ব্রিটিশ, স্প্যানিশ, ফরাসি ছবি দেখেছি। নেটফ্লিক্সে দেখি। আবার বন্ধুবান্ধবও ভালো ভালো ছবি দেখতে পরামর্শ দেয়।
করোনায় কী কী কাজ আটকে গেল?
‘উড়াল’ আর ‘রাত জাগা পাখি’ সিনেমার শুটিং শেষ হয়েছে। আরও দু-একটা ছবির কাজ চলছিল। ২২ মার্চ থেকে ঈদের নাটকের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। এখন তো সব বন্ধ। শিল্পী মানুষ তো। শুটিংয়ের সেটের জন্য মাঝেমধ্যেই মনটা অস্থির লাগে।
করোনাকাল ফুরালে সবার আগে কী করবেন?
বন্ধু, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী—সবাইকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরব। এখন তো প্রতিদিনই চার-পাঁচজনের সঙ্গে ভিডিও কলে আড্ডা হচ্ছে। মোবাইলের ভেতর দিয়ে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। কিন্তু স্পর্শটা তো অধরাই থেকে যাচ্ছে।
আপনার অভিনীত আপনার প্রিয় তিন সিনেমার তালিকায় কী কী থাকবে?
‘শঙ্খনাদ’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘স্বপ্নজাল’। ‘আহা’ আর ‘স্বপ্নডাঙ্গা’কেও রাখতে হবে।
এখনকার তরুণদের মধ্যে বড় ও ছোট পর্দা মিলিয়ে কার অভিনয় আপনার ভালো লাগে?
ওভাবে তো নাম বলা যাবে না। বড় পর্দায় সিয়াম আহমেদের সম্ভাবনা আছে। চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিমরা তো বারবার প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত। নতুনদের মধ্যে...মঞ্চের কাজ যদিও এখন কম, তবে বেশ কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ আছে।
আপনার প্রিয় তিনটা সিনেমার নাম বলেন।
খুব কঠিন। ‘রোমান হলিডে’, ‘টোকিও স্টোরি’, ‘কালার অব প্যারাডাইস’, ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ‘সিনেমা প্যারাডিসো’...এ রকম প্রচুর, প্রচুর। কোনটা রেখে কোনটা বলি। পৃথিবীতে ভালো ছবি তো আর কম হয়নি।
আপনি কোত্থেকে অভিনয় শিখলেন? সিনেমা দেখে দেখে?
অভিনয় শিখে ফেলেছি বলব না। শেখার চেষ্টা করছি। আমার মনে হয়, কেউ কখনো অভিনয় পুরোপুরি শিখে ফেলতে পারে না। কেবল চেষ্টা করে যায়। কাছাকাছি কিছু একটা করার। হ্যাঁ, সিনেমা দেখে তো শিখিই। ছোটবেলায় শুক্রবার সকালে হলগুলোতে ইংরেজি ছবি দেখাত, যাকে বলে ম্যাটিনি শো। তখন আমি ‘ম্যাককেনাস গোল্ড’, ‘দ্য ক্যাসান্ড্রা ক্রসিং’, ‘সানফ্লাওয়ার’, ‘টু উইমেন’—এই সব সিনেমা দেখেছি। তখন থেকেই অড্রে হেপবার্ন, গ্রেগরি পেক, সোফিয়া লরেন—তাঁরা মন, মাথা দখল করে নিয়েছিলেন। তারপর থিয়েটার। আরণ্যকের কর্মশালায় ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে লোকজন আসত শেখাতে। ইউএসআইএসের (ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস) অধীনে সেখানকার থিয়েটার আর্টিস্টদের কাছ থেকেও শেখার সুযোগ হতো। কাজ করতে করতে শেখা চলে। অভিনয়টা তো সত্যি নয়, কিন্তু সত্যের খুব কাছাকাছি একটা ব্যাপার। তাই দিন শেষে অভিনয়টা হয় মূলত মাথা দিয়ে। আমি মানুষকে, আমার সময়কে, সমাজকে যত ভালো বুঝব, তত বেশি চরিত্রটাকে আবিষ্কার করতে পারব। তারপর সেটা শরীরে আনতে হবে। অভিনয়ের তো কোনো সীমানা বা ছক নেই। তাই এই শিল্পমাধ্যমকেই আমার চূড়ান্ত সৃজনশীল বলে মনে হয়।
আপনি তো প্রায় সমানভাবেই নিজেকে থিয়েটার, টিভি ও বড় পর্দায় ভাগ করে দিয়েছেন। একেক প্ল্যাটফর্মের একেক অভিনয়ের কীভাবে পার্থক্য করেন?
উহুঁ, রেডিও বাদ গেল। রেডিওতেও প্রতি সপ্তাহে আমার একটা করে নাটক যায়। আমি বিষয়টাকে তুলনা করব ক্রিকেট খেলার সঙ্গে। যেমন টেস্ট, ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টি। একেক ফর্মের খেলা একেক রকম। কিন্তু খেলাটা পারতেই হবে। একইভাবে মূল অভিনয়টা জানতেই হবে। একটা দৃশ্য দিয়ে বোঝাই। ধরুন মাঝি বইঠা টেনে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে। মঞ্চে সেটা আমরা হয়তো ছবি এঁকে, আলো দিয়ে, শব্দ দিয়ে বা অভিনেতার হাতে কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে দৃশ্যটা করে ফেলব। সামনে বসা দর্শক সেটাই বিশ্বাস করবেন। কিন্তু নাটকে যদি তা-ই করি, দর্শক কিন্তু আর বিশ্বাস করবেন না। অন্যদিকে বড় পর্দায় ছোট ভুল বড় দেখায়, একটু ভালো অভিনয় করলেও সেটাও অনেক বড় হয়ে যায়।
আপনি বলেন যে ভালো অভিনেতা হতে গেলে ভালো মানুষ হতে হবে। কেন, খারাপ মানুষ কি ভালো অভিনেতা হয় না?
কাজের প্রতি সততা না থাকলে কীভাবে হবে! অন্যকে ঠকানো, মিথ্যাচার, অবৈধ কাজকর্ম—এগুলোই যদি মাথার ভেতর থাকে, তাহলে তো সে সুস্থ চিন্তাশীলতার মানুষ হবে না। সেই মানুষ মন উজাড় করে শিল্প করবে কীভাবে?
নাটকের মূল সমস্যাগুলো কী?
বাজেট নেই তো। ভালো নাটকের জন্য ভালো পরিচালক লাগবে। তাঁকে ভালো সম্মানীও দিতে হবে। ভালো অভিনয়শিল্পী আর টেকনিশিয়ান লাগবে। তাঁদেরও মূল্যায়ন হয়, এমন সম্মানী দিতে হবে। সময় কই সময় নিয়ে নাটক লেখার, বানানোর? তাড়াহুড়োয় ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ করে কেবল টিভি আর ইউটিউবের খালি জায়গা ভরার জন্য নাটক করলে ভালো নাটক হবে? আগে আমরা ৫০ মিনিটের একটা নাটক করেছি ৪-৫ দিনে। মাঝেমধ্যেই সেটা ছয়-সাত দিনও হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিয়তটা কি ঠিক আছে? সবাই মিলে এতটুকু ছাড় না দিয়ে, সবটা উজাড় করে একটা ভালো কাজ করব, এই দৃষ্টিভঙ্গি কোথায়? নাটক যখন কেবলই ব্যবসা, তখন ভালো নাটকের আশা করাটা বোকামি।
করোনাকাল থেকে কী শিখলেন?
সব খারাপ ব্যাপারেরও কিছু ভালো দিক থাকে। পৃথিবী কিছুটা কার্বনমুক্ত হয়েছে। এখন আমি বারান্দায় বসে দেখি, আকাশটা আরও নীল। গাছের পাতা আরও সবুজ। নিশ্বাস নিলে বাতাসটা আর আগের মতো ভারী লাগে না। খবরে দেখি, সমুদ্র আরও স্বচ্ছ। সেখানে ডলফিন খেলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেলে আমাদের চারপাশ, এই পাতা, আকাশ, সমুদ্র, ডলফিনদের জন্যও ভাবতে হবে। ঘরে থাকার বিকল্প নেই। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, এর আগেও এ রকম মহামারিতে ছেয়ে গেছে বিশ্ব। সেসব কাটিয়ে সামনে এগিয়েছে সময়। আমাদের এখন আরেকটু সচেতন আর শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে।