জীবনছবি

আমজাদ হোসেন
আমজাদ হোসেন
>কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী এবং লেখক আমজাদ হোসেন আর নেই। আজ শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর দুইটা ৫৭ মিনিটে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমজাদ হোসেন ‘জীবনছবি’ শিরোনামে স্মৃতিকথা প্রথম আলোতে লিখেছিলেন ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পাঠকদের জন্য আবার দেওয়া হলো।

ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। খেলাধুলায় কখনো ভালো ছিলাম না বলে ফুল, পাখি, প্রজাপতি নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আকাশে মেঘ জমলে আমার মন খারাপ হয়ে যেত। ঝকমকে রোদের দিন আনন্দের সীমা থাকত না। দিনভর ছোটাছুটি করতাম। এমনকি সন্ধ্যাবেলায় খোলা মাঠে অথবা আমাদের উঠোনে, পূর্ণিমার চাঁদের সঙ্গে দৌড়াতাম। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। ঘামে ভিজে যেত শরীর। দীর্ঘপথ দৌড়াদৌড়ি করে হাঁপাতে হাঁপাতে যেকোনো জায়গায় যখন দাঁড়িয়ে পড়তাম। তখনো দেখতাম যেখানকার চাঁদ সেখানেই আছে। অথচ দৌড়ানোর সময় মনে হতো চাঁদটাও আমার সঙ্গে দৌড়াচ্ছে। আমি যেখানেই যাই, যত দূরেই যাই। আকাশের চাঁদটাও ঠিক একই জায়গাতেই থাকে। শুধু চাঁদ কেন, পাড় ধরে ধরে নদীর সঙ্গেও দৌড়াদৌড়ি করেছি। এই ব্রহ্মপুত্র নদের মতো যেন আমিও অনেক দূরে যাব-এ রকম একটা ইচ্ছা নিয়েই দৌড়াদৌড়ি করেছি নদীর সঙ্গে। ছুটি রেলগাড়ির সঙ্গেও দৌড় দিয়েছি। তেপান্তরের সবুজ ধানখেত ভেঙে ভেঙে, যতটুকু শক্তিতে কুলোয়, দম বন্ধ করে দৌড় দিতাম। ধান গাছের ধারালো পাতায় পা ছড়ে গেছে। হাঁটুর ছাল উঠে গেছে। রক্ত বেরিয়েছে। এসব লুকোতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় মায়ের কাছে ধরা পড়েছি, চড়-থাপ্পড় খেয়েছি। পরের দিন আবার মায়ের শাসন ভুলে গিয়ে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছি। আমি যেন অনেক দূরে যাব। আমাকে যেতেই হবে। কবে, কখন এমন একটা ভাবনা আমার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, আমি তা জানি না। আজও বলতে পারি না। তবে এ সময় বিদ্রোহী কবির একটা কবিতা আবৃত্তি করে, স্কুলের বার্ষিক উৎসবে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম। কবিতাটি ছিল-

থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

আমার ছেলেবেলাটা ছিল এ রকম। দৌড়াদৌড়ি। ছোটাছুটি। প্রতি সন্ধ্যায় আকাশের নক্ষত্র গোনা। কোন পাখির কী ডাক। কোন ফুলের কী রকম গন্ধ। এমনকি মা একদিন শবেবরাতের সন্ধ্যায় বলেছিল, আজ এই পৃথিবীর সবাই নামাজ পড়বে। বন-বিরিক্ষির লতাপাতাও এই রাতে আল্লাহ তায়ালাকে সেজদা করবে। প্রথম রাতে বাবা-কাকার সঙ্গে দু-চার রাকাত নামজ পড়ে খাওয়া-দাওয়া করে দাদির দোতলা টিনের ঘরে গিয়ে লুকিয়েছিলাম। দোতলা থেকে বাড়ির আম-কাঁঠালের গাছগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। মনে মনে প্রতীক্ষা করেছি, আজ রাতে ঘুমাব না। গাছগুলো কীভাবে সেজদা করবে, আমি তা দেখব। গভীর রাতে ঘুমে ঢলে পড়ছিলাম। গা ঝাড়া দিয়ে ঘুম তাড়ালাম। তাকিয়ে রইলাম গাছগুলোর দিকে। দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেল। রোদ উঠল। কিন্তু কোনো গাছকে তো সেজদা করতে দেখলাম না। পরে অবশ্য মা বলেছিল, যারা ইমানদার, তারাই শুধু দেখতে পায়।

আসল কথা, ছেলেবেলায় যে যা বলত সেসব আমি নিজের চোখে দেখতে চাইতাম। এমনকি ভূত দেখারও অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো দিন দেখিনি। ছেলেবেলার এই প্রকৃতিপ্রেমের সুফলও পেয়েছিলাম খুব দ্রুত। এ সময়েই আমার প্রচুর ছড়া-কবিতা ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। সংবাদ-এর খেলাঘরে। ইত্তেফাক-এর কচিকাঁচার আসরে। আজাদ-এর মুকুলের মাহফিলে। দৈনিক মিল্লাত-এ। বিভিন্ন মাসিক পত্রিকায়। তখন আমার বয়স ছিল কত? বারো-তেরো। শিশুসাহিত্যের পাতায় কলম ঘষতে ঘষতে কবিতা ছাপা হতে লাগল বড়দের সাহিত্য সাময়িকীতে। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজ। কো এডুকেশন। তখনকার এই মফস্বল টাউনে নাটকে অভিনয় করেও দারুণ পরিচিতি পেয়েছি। কলেজের বার্ষিক নাটক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালিন্দীতে অভিনয় করে ফার্স্ট প্রাইজ পেলাম। বন্ধু-বান্ধবরা বলল, তুই সিনেমাতেও ভালো করবি।

আমি তখনো ঢাকা দেখিনি। শুধু শুনেছি, বাহান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর এই ঢাকা। চলচ্চিত্র নির্মাণ এই ঢাকাতেও শুরু হয়েছে। মুক্তি পেয়েছে আবদুল জব্বার খানের ছবি মুখ ও মুখোশ। সেই সঙ্গে ফতেহ লোহানী শুরু করেছেন আকাশ আর মাটি আর মহিউদ্দিন সাহেব বানাচ্ছেন রাজা এলো শহরে।

সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখি। কিন্তু সিনেমায় যাব অথবা নামব, এমন কোনো চিন্তা-ভাবনা আমার নেই। আমার তিন বন্ধু বাবা-মায়ের টাকা চুরি করে বোম্বে গিয়েছিল দিলীপ কুমারকে দেখতে। দেখা হওয়া তো দূরের কথা, ওরা শুধু কলের পানি খেয়ে, টিটির হাত-পা ধরে কোনোরকমে ফিরে এসেছে। ওদের ভয়াবহ করুণ অবস্থা দেখে, চলচ্চিত্রের কথা শুনলেই আমার গা শিউরে ওঠে। টিকিট কেটে চলচ্চিত্র দেখব, ব্যস, চলচ্চিত্রে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।

আমি তখনো লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত। খুব কষ্টে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকা জোগাড় করি। বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী-এ তিনজন আমার প্রিয় কবি। দিনরাত তাদেরই কবিতা পড়ি। ভালো লাইনগুলো মুখস্থ রাখি। আমাদের ফরিদ ভাই মানে কবি ইমামুর রশীদ। ইমামুর রশীদ, আল মাহমুদ, ওমর আলী-তখন এদেরও বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রচুর কবিতা ছাপা হচ্ছে।

ইমামুর রশীদের কাছে আমি চির ঋণী। পৃথিবীর আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে তিনিই আমাকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন বিভিন্ন বই দিয়ে দিয়ে। গতকাল দুটি কবিতার বই দিয়েছেন আমাকে। জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন এবং র‌্যাবোর কবিতা। এর আগে আমি জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়িনি। বনলতা সেন-এর কবিতাগুলো পড়ে আমি যেন কেমন হয়ে গেলাম। আমাকে যেন এক ধূসর জগতের শ্রাবস্তীর নগরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখল জীবনানন্দ দাশ। আমি এই অন্ধকারের বনলতা সেনকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না।

দিনরাত কবিতা লিখছি। সেসব কবিতা হচ্ছে কি না জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, ওসব কবিতায় শুধু জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ ছায়া আর কুয়াশায় আচ্ছন্ন কিছু কবিতার লাইন লিখেছি। জীবনানন্দীয় কবিতার প্রভাবে আমার কবিতা ডানাভাঙা প্রজাপতির মতো বিবর্ণ হয়ে পড়ছে।

কিছুদিন আর কবিতা লিখলাম না। কলেজ রাজনীতিতে আমরা তখন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন করি। আমাদের প্যানেল জিতেছে। হৈচৈ-আনন্দে আমরা মেতে আছি। ফাংশন করছি। বক্তৃতা দিচ্ছি। অভিষেক উৎসব হচ্ছে। পড়াশোনা করার সময়ই পাচ্ছি না। অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। সারা রাত কবিতার বই পড়ি।

১৯৫৮ সাল। সামনেই ইন্টারমিডিয়েট টেস্ট পরীক্ষা। গত দু বছর ক্লাসে অনুপস্থিত ছিলাম অনেক বেশি। এখন তা কভার করার জন্য দিনরাত পড়াশোনা করছি। এ ফাঁকেই একটা কবিতা লিখলাম। নাম দিলাম, ‘নরকে এক ঋতু’। মনে মনে স্থির করলাম কবিতাটা কলকাতার দেশ পত্রিকায় পাঠাব। এ পর্যন্ত আমার কোনো ছড়া-কবিতা অমনোনীত হয়নি। যা পাঠিয়েছি সবই ছাপা হয়েছে। পাঠানোর সময় বুকটা ডিব ডিব করছিল। দেশ পত্রিকায় আমার লেখাটা কি ছাপবে? মনে হয় না। আবার মনে হয়েছে, ছাপতেও পারে। কবিতাটা কবিতাই হয়েছে। মনটাকে বেশ শক্ত করেই কবিতাটা পাঠালাম।

কিছুদিন পর কলকাতা থেকে একটি পোস্টকার্ড এল আমার কাছে। তাতে লেখা:

কল্যাণীয়েষু
পূর্ব পাকিস্তানে তুমি কেমন আছো, জানি না। পরিশ্রম করলে তোমার কলমে অনেক ভালো লেখা বেরুবে। তোমার পাঠানো ‘নরকে এক ঋতু’ কবিতাটি ছাপা হচ্ছে...সংখ্যায়। তুমি কলকাতায় চলে আসলে, তোমার খাওয়া-দাওয়া, লেখাপড়ার সব দায়িত্বই আমার ওপরে থাকবে। আমিই সব বন্দোবস্ত করে দেব।
শুভেচ্ছান্তে
সাগরময় ঘোষ

চিঠিটা পড়ে কেঁপে উঠলাম। বারবার পড়লাম। বুকটা শুকিয়ে গেল। ঢকঢক করে পানি খেলাম। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই চিঠিটা কাউকে না কাউকে দেখাতে হবে। আরেকজন না পড়লে আমি যেন নিশ্বাস ফেলতে পারছি না। আমার এক বন্ধুকে দিলাম পড়তে, চিঠি পড়েই সে মহা আনন্দে বিরাট একটা চিৎকার দিল। সঙ্গে সঙ্গেই যেন বাতাসের চেয়েও দ্রুতগতিতে চিঠির সমস্ত কথা জেনে ফেলল কলেজের সব ছাত্রছাত্রী। ছুটে এলেন আমাদের বাংলার অধ্যাপক গোপেশচন্দ্র দে। স্যারের চোখে জল। তাঁর সম্পর্কে সবার একটা ধারণা আছে, রবীন্দ্রনাথের কোন কবিতা, কোন বইয়ের কত পৃষ্ঠায়, এক মুহূর্তের মধ্যেই চোখ বন্ধ করে গোপেশ স্যার তা বলে দিতে পারতেন। তিনিও লেখেন, বিশেষ করে প্রবন্ধ। তার সমস্ত লেখাই ছাপা হয় ভারতবর্ষ আর বসুমতীতে।

আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্যার বললেন, আমার লেখা ছাপা হয় ভারতবর্ষ, বসুমতীতে আর তোমার লেখা ছাপা হচ্ছে দেশ পত্রিকায়! স্যারের কণ্ঠে আনন্দ, বিস্ময় এবং হৃদয় নিংড়ানো খুশি একসঙ্গে মিলেমিশে কাঁপছে। স্যার এবং আমার চারপাশে কলেজের সব ছাত্রছাত্রী ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সবার সামনেই স্যার আমাকে প্রতিজ্ঞা করাচ্ছেন, আমি শুধু লিখব। সারা জীবনই লিখব। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার হাতে কলম থাকবে।

স্যারের শেষ কথাটা হলো, তুমি সারা জীবন নেপথ্যেই থাকবে।

শুধু আমিই বুঝতে পারলাম স্যারের এই ধারালো কথার অর্থ। স্যার বলতে চাইছেন, আমি যেন কখনো আর মঞ্চে না নামি এবং চলচ্চিত্রে যেন কোনো দিন না যাই। আমিও আবেগে থরোথরো হৃদয় নিয়ে বললাম, আমি স্যার নেপথ্যেই থাকব সারা জীবন।

খুব খুশি হলেন স্যার। আমার বন্ধু-বান্ধব, ছাত্রছাত্রীরাও খুশি। স্যার পিয়নকে ডেকে গোপালদার মিষ্টির দোকানে পাঠালেন। আমাদের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবেন। স্যার দেখতে খুব সুপুরুষ ছিলেন। ফরসা। ক্লিন শেভ। শীতকালে ধুতি-পাঞ্জাবির সঙ্গে মুগরঙা শাল আর পায়ে থাকত পাম্প সু। গরমকালে শুধু ধুতি-পাঞ্জাবি আর পায়ে স্যান্ডেল থাকত।

স্যারের এই মহাপুরুষের মতো চেহারা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার হৃদয়ের দেয়ালে টাঙানো থাকবে।

আমার বয়স এখন আঠারো। এ বয়সেই আমাদের মফস্বল টাউনের সবাই আমাকে চেনে। দেশ পত্রিকায় কবিতাটি ছাপা হওয়ার পর, কবি-সাহিত্যিকদের কাছেও পরিচিত হব। ঢাকায় থাকে ছড়াকার রফিকুল হক। বাড়ি রংপুর। লেখার মারফতেই দুজন দুজনকে চিনি। এখনো কেউ কারও মুখোমুখি হইনি। আমি এখনো ঢাকায় যাইনি। কলকাতায়ও না। আমার চুলে এখনো সরষে তেলের গন্ধ। কথাবার্তায় মফস্বলের আঞ্চলিক টান। মানে আমার অবস্থা এখনো কুয়োর ব্যাঙের মতো। পুকুর কিংবা সমুদ্র কবে দেখতে পাব, তা ভবিতব্যই জানে।

এত বড় আনন্দের সংবাদটা বাড়ির কাউকেই বলতে পারলাম না। লেখালেখির সংবাদে বাবা খুশি হন। তাকে বলতে পারলাম না, তিনি কলকাতার কথা শুনেই রেগে যাবেন। ওটা হিন্দুদের দেশ। তুমি ওখানে যাবে কেন? উনি মুসলিম লীগের ভক্ত। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উনার প্রিয় নেতা। উনি পাকিস্তানকে ভালোবাসেন। দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় অনেক হিন্দু বন্ধুকে পরিবারসহ বাড়িতে এনে আশ্রয় দিয়েছেন। অনেককেই দর্শনা পর্যন্ত যেতে সাহায্য করেছেন। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে একটা ফুটো কড়িও নেননি। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি মুসলিম লীগের অন্ধ ভক্ত। ইসলাম রক্ষার জন্য তিনি জিহাদ করতে পারেন। ভোরে কোরআন শরিফ এবং সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া তার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে থাকি বলে তিনি খুব মনঃক্ষুণ। মাঝে মাঝে বকাঝকাও করেছেন আমাকে। এমতাবস্থায় কিছুতেই তাকে কলকাতার কথা বলতে সাহস পেলাম না। আর মা, তিনি তো আমাকে বাড়ির বাইরেই যেতে দিতে চান না। আমার আগে তার এক মেয়ে হয়েছিল, মারা গেছে। আমার পরে মারা গেছে তার সাত-সাতটি ছেলে। কেউ আঁতুড়ঘরে, কেউ তিন-চার দিনের সময়, দু-একজন বোধহয় দশ-পনের দিন বেঁচে ছিল। এভাবেই তার সাত-সাতটি ছেলে মারা গেছে। আমিও বেঁচে আছি অনেক অসুখ-বিসুখে ভুগে ভুগে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় পর্যন্ত আমার গলায় অনেক রকমের তাবিজ ছিল। কুমিরের দাঁতের তাবিজ। নানা রকম শিকড় বাঁধা তাবিজ। কত কী যে ছিল গলায় আর কোমরে! এখন সেসবের নামও ভুলে গেছি। সাত ছেলের মৃত্যুতে তার সমস্ত আদর যেন আমার ওপরই উপচে পড়ছে। আমি একটু চোখের আড়ালে থাকলেই খোঁজাখুঁজি করতে করতে কেঁদে ফেলেন। তাকে যদি কলকাতার কথা বলি, কাউকে ধাক্কা দিতে হবে না। তার আগেই তিনি মাটিতে পড়ে যাবেন।

কাউকেই বললাম না। দু চোখে কলকাতার স্বপ্ন নিয়ে বসে রইলাম সারা রাত। একবার ভেবেছিলাম পালিয়ে যাই। কিন্তু যাব যে, সে টাকা-পয়সাও তো আমার কাছে নেই। সংসারের অবস্থাও খুবই খারাপ। বাবা তার বাপ-মায়ের একমাত্র ছেলে। কিন্তু বোন তার পাঁচজন। সেই বোনেরা মামলা করে পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। এক বোনের পাওনা দিতে গিয়ে দোতলা টিনের ঘরটাও বিক্রি করে নগদ টাকা দিতে হলো। পাঁচ বোনের ভাগাভাগিতে এক ভাই আর কতটুকু সম্পত্তি পাবে। বাবা নিজেও অসুস্থ। গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় দিনরাত ছটফট করেন। পেটে বালিশ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকেন। সংসারটা চলে আমার টিউশনির টাকা-পয়সায়। এত কিছুর ভেতরেও আমি টিউশনি করি চার-পাঁচটা। পাড়ার লোক অবাক হয়, আহারে ছেলেটার কী কষ্ট! কলেজেও পড়ে আবার টিউশনি করে সংসার চালায়। বাড়ির কাউকে কিছুই বলতে পারলাম না। কলকাতার স্বপ্ন আমার ভেতরেই দিনের পর দিন বিবর্ণ হতে হতে নষ্ট হয়ে গেল।

ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার মনে হলো বাড়িতে আর থাকতে পারব না। ঢাকায় যেতেই হবে। আরও ভাইবোন হয়েছে। তারা বেঁচে আছে। আমার আট বছরের ছোট এক ভাই। তার ছোট তিন বোন। সংসারের খরচ আরও বেড়ে গেছে। টিউশনির টাকায় হচ্ছে না। ঢাকায় গিয়ে একটা কিছু না করলে এরাও বাঁচবে না। তখন আমার ইচ্ছা ছিল, সারা জীবন যখন লেখালেখিই করব, কলেজের অধ্যাপনা করাই হবে আমার জন্য আদর্শ চাকরি। যে রকম পরীক্ষা দিয়েছি, পাস আমি করবই। তখন ঢাকায় গিয়ে একটা যেকোনো ধরনের চাকরি নেব। রাতের কলেজে পড়াশোনা করব। এমন একটা ইচ্ছা নিয়েই একদিন রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালালাম।

স্টেশনে যাওয়ার আগেই ঝড়বৃষ্টিতে পড়লাম। ঝোড়ো হাওয়া এসে যেন আমার চুল টেনে ধরল। আমি যেন আর এগোতে না পারি, এই ভেবে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আগেই বলেছিলাম, প্রকৃতির সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। সে জন্যই আমার মনে হচ্ছে, ওরা আমাকে জামালপুরের বাইরে যেতে দিতে চাইছে না। যেন বৃষ্টি বলছে, যেও না। ঝড়ো বাতাস আটকানোর চেষ্টা করে বলছে, যেও না। বিদ্যুৎ চমকে উঠে বলছে, যেও না। ওদের বাধা অতিক্রম করে চলে এলাম স্টেশনে। জামাকাপড় ভিজে জবজবা। এ অবস্থায়ই ট্রেনে উঠে বসলাম। অসময়ের বৃষ্টিতে খুব ঠান্ডা লাগছে। শরীরটা ঠকঠক করে কাঁপছে। ঝড়বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম, আমি যাব। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে আমাকে এখন অন্য কোথাও যেতেই হবে।

প্রচণ্ড রোদের দুপুরে ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি যে চাইব আমার এমন কোনো পরিচিত লোক নেই ঢাকা শহরে। এই প্রথম এসেছি। রাস্তাঘাট চিনি না। ট্রেন থেকে নেমেই একটা রিকশা নিয়ে ছুটলাম কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। ওখানে ছড়াকার রফিকুল হক থাকে। জগন্নাথ কলেজে পড়ে। ওর মেসের ঠিকানাটা জানা ছিল। ওর কাছেই প্রথম গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আশ্রয়ও পেলাম।

তখন খুব ছোট ছিল ঢাকা শহর। গুলিস্তান থেকে নবাবপুর হয়ে সদরঘাট। আর সদরঘাট থেকে সোজা পশ্চিমে চকবাজার। ব্যস, মানুষের যত হৈ চৈ, যানবাহনের যত ভিড়, যত রকম কেনাকাটা, শুধু এই এলাকাজুড়ে। ব্যস্ত শহর বলতে এইটুকুই।

গুলিস্তানের উত্তর দিক থেকেই শহরটা একটু একটু করে বাড়ছে ভীষণভাবে আধুনিক মেজাজ নিয়ে। এই জিন্নাহ অ্যাভিনিউতেই সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে রয়েল স্টেশনারির গা ঘেঁষে। নাম ‘লাসানি’। বিদেশি খাবারসহ উচ্চ মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্ট। ঢাকা শহরে সম্ভবত এই প্রথম, রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন মডার্ন মেয়েরা আসছে নির্দ্বিধায়।

এই লাসানি রেস্টুরেন্টের আরও একটু উত্তরে ‘কসবা’ নামের আরও একটি নতুন বার খোলা হয়েছে। খুবই ছোট কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। ভেতরে আলোর চেয়ে আঁধার একটু বেশি। নির্জন পরিবেশ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। খুব দামি দামি লোকজন আসে। ঝকমকে গাড়িটা বাইরে রেখে ভেতরে যায় নিঃশব্দে। আবার যখন কেউ বেরোয়, তখনো তেমন কোনো সাড়া-শব্দ হয় না। ঢাকা শহরের মানুষ যারাই এদিকে বেড়াতে আসে, মুখে-চোখে বিস্ময় নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে এই কসবা বারের দিকে। বিদেশি বিদেশি ভাব বলেই সাধারণ মানুষ এর ভেতরে যাওয়ার সাহস পায় না।

এই কসবা বারের ঠিক উল্টো দিকেই মানে প্রধান রাস্তার পূর্বদিকে ঢাকা স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে। একহাত উঁচু গোলাকার বৃত্তের মতো নির্মীয়মাণ ঢাকা স্টেডিয়াম আস্তে আস্তে ওপরের দিকে উঠছে। আর এই স্টেডিয়ামের খুব কাছেই দুর্গন্ধময় বড় একটা পচা পুকুরে প্রতিদিন এই শহরের আবর্জনা ফেলে ফেলে ভরাট করার চেষ্টা চলছে। এখানেই নাকি নির্মিত হবে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এবং নতুন ধরনের একটি মার্কেট।

এই নির্মীয়মাণ ঢাকা স্টেডিয়ামের প্রধান গেটের সামনেই খুব উঁচু একটা বাঁধানো গোল-চত্বর ছিল। কেন এটা তৈরি করা হয়েছিল তা আমি জানি না। কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি কখনো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সন্ধ্যার পর এই চত্বরে বসলেই হু হু করে বাতাস ছুটে আসত সদরঘাট থেকে। বুড়িগঙ্গার বিশুদ্ধ বাতাস। সে সময়েই এখানে জমে উঠেছিল কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। এই আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন কবি শহীদ কাদরী। সারা দিন রেক্স রেস্টুরেন্টে আড্ডা মেরে, ভ্যাপসা গরমে ক্লান্ত হয়ে এই গোল-চত্বরে এসে বসতেন সন্ধ্যার পর।

বুড়িগঙ্গার ভেজা বাতাসে, আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ ঘুমিয়েও পড়ত। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেই দলবাঁধা শেয়ালের ডাক শোনা যেত। অনেকেই চমকে উঠত এই ডাক শুনে। এই গোল-চত্বরের আরও উত্তরে শান্তিনগর-চামেলিবাগের কাছাকাছি ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে থাকত শেয়াল। রাত একটু গভীর হলেই ওদের ডাকাডাকি শুরু হতো। এ রকম ছিল তখনকার ঢাকা। শাহজাহানপুর, বাসাবো এসব ছিল নিচু জায়গা। মাইলের পর মাইল জলে ডোবা ধানখেত। বিষাক্ত সাপ আর শেয়ালের ভয়ে কেউ কেউ ধানমন্ডির জায়গাও কিনত না। লালমাটিয়ার পুরো এলাকাটাতেই শুধু ধানের জমি ছিল। ইন্দিরা রোডটা ছিল গ্রামের মতো। বাড়ি বাড়ি চাপকল। টিন আর মুলিবাঁশের দোচালা ঘর। ফিল্মের লোকজন তখন এই ইন্দিরা রোডে এসে গ্রামের শুটিং করত।

যখন কোনো ফিল্মের শুটিং হয়, মানুষ দৌড়াদৌড়ি করে এসে ভিড় জমায়। আমি একদিন ফতেহ লোহানীর শুটিং দেখেছিলাম কাকরাইলে। এখন যেখানে ঈশাখাঁ মার্কেট এবং লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল ঠিক তার উল্টোদিকে, ভিআইপি সড়কের দক্ষিণে বিরাট একটা পুকুর ছিল। চারপাশে উঁচু মাটির পাড়। থোকা থোকা ঝোপঝাড়। ঠিক ওখানেই শুটিং করছিলেন তিনি। আকাশ আর মাটির শুটিং। পুকুর-পাড়ে বসে আছেন কলকাতার নায়ক প্রবীর। পরনে নীল রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা, পায়ে কলাপুরি স্যান্ডেল। প্রবীর পুকুর-পাড়ে বসে সিগারেট খাচ্ছেন। আধপোড়া সিগারেটটা ছুড়ে মারলেন পুকুরে। সিগারেটটা পুকুরের জলে ভাসছে। এই শটও নিলেন পরিচালক ফতেহ লোহানী সাহেব।

সবই দূর থেকে দেখছি। ভিড় ঠেলে কাছে যেতে পারছি না। শুটিংয়ের লোকরাও বাধা দিচ্ছে-আমার খুব শখ ছিল, কলকাতার নায়ক প্রবীরকে একটু কাছ থেকে দেখব, কিন্তু কিছুতেই তা সম্ভব হলো না। কিছুক্ষণ শুটিং দেখে রোদে ঘেমে চলে এলাম সেখান থেকে। গোপেশ স্যারের কথা রাখতে পারিনি। শুধু অভাবের কারণেই ঢাকার মঞ্চে মঞ্চে নাটক করি। এমনকি সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিদের জন্যও জেলখানার ভেতরে নাটক পরিচালনা করেছি। বেশির ভাগ নাটক করতাম ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট এবং মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে। প্রতিদিন নাটক করতাম আছির উদ্দীন সাহেবের মিনার্ভা থিয়েটার্সে। এই নাটক করার সুবাদেই সিঅ্যান্ডবিতে একটা চাকরি পেলাম। ওয়ার্ক অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি। বেতন একশ দশ টাকা। তখন একশ দশ টাকায় দুই ভরি সোনা পাওয়া যেত। চাকরির শর্ত হলো, আমাকে কোনো দাপ্তরিক কাজকর্ম করতে হবে না। সকাল দশটায় গিয়ে শুধু হাজিরা বহিতে স্বাক্ষর করব। আর মাস শেষে বেতন নেব। ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন ওয়ান বছরে তিন-চারটে নাটক করে। শুধু সেই নাটকগুলোতে অভিনয় এবং নাটকটি আমাকেই পরিচালনা করতে হবে। এই হলো আমার সারা বছরের কাজ।

নাটক করি আর ঘুরে বেড়াই। লেখালেখিও চলছে। নাট্যকর্মীদের চেয়ে কবি-লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিই বেশি। কবি-লেখকরা যেন আমার হৃদয়ের মানুষ। ওরা আমার হৃদয়ের শব্দ শুনতে পায়। আমি যেন আমার আসমানি কাচের আয়নায় ওদের হৃদয়গুলো দেখতে পাই। একজন কবি যখন জীবনানন্দ দাশ কিংবা নরেশ গুহের নতুন কবিতা শোনায় অথবা কেউ যখন বলে, বিমল কর কিংবা সন্তোষকুমার ঘোষের এই গল্পটি অসাধারণ! গল্পটা এই রকম; তখন যেন আমি স্ফটিক জলে মাছের মতো সাঁতরাতে সাঁতরাতে জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পাই। ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে আমার চিন্তা-চেতনার নতুন নতুন জানালা খুলে যায়।

খবর পেলাম আমার জন্য দিবানিশি কাঁদতে কাঁদতে মা খুব শুকিয়ে গেছেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। খেতে বসলেই নাকি আমার কথা মনে পড়ে। আর তখনি শুরু হয় কান্না। খাওয়া আর হয় না। বাবাও দিন-রাত ¯ব্ধ হয়ে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে চিঠি লেখেন আমার কাছে। আমি সেই চিঠি পড়ে কেঁদে ফেলি, কিন্তু কখনো তার উত্তর দেই না। একশ দশ টাকা মাসে পাই। সঙ্গে সঙ্গে একশ টাকা বাবার নামে মনিঅর্ডার করি। আমার দু-চার কথা মনিঅর্ডারের নিচেই লিখে দেই। তখনকার দিনে একশ টাকা মধ্যবিত্ত সংসারের জন্য অনেক। অঢেল কাঁচাবাজার করা যেত। জামা-কাপড়, ওষুধ পাঠাই আলাদাভাবে। কখনো যেন বাবা-মায়ের কষ্ট না হয় সেদিকেই সব সময় খেয়াল রাখতাম। মাস শেষে আমার হাতে থাকত দশ টাকা। নাটক, রেডিও নাটক করে আমি আরও টাকা পেতাম। তা দিয়ে আমিও চলতে পারতাম ঢাকা শহরে। দুটো পরোটা-মাংস খেতে লাগত মাত্র তিন আনা। আর কী চাই। এ রকমই সস্তা ছিল মেস ভাড়া। খাওয়া-দাওয়া। মাত্র আট আনা পকেটে থাকলে রিকশায় যেকোনো জায়গায়, যেখানে খুশি চলে যেতে পারতাম। কোনোরকম অসুবিধা হতো না।

আমার কষ্ট ছিল বাবার চিঠির কোনো উত্তর না দেওয়া। কোনো মান-অভিমান বা জেদ করে নয়। আমি খুব আদরে মানুষ হয়েছি। সেই আমাকে পয়সার জন্য ঢাকায় আসতে হয়েছে। ঢাকায় যেভাবে কষ্ট করছি, চিঠির উত্তর দিতে গেলেই আবেগে সেসব কথা লিখে ফেলি। তা পড়ে বাবা এবং মা দুজনেই কাঁদেন। দু-চার কথার চিঠি তো লেখাই যায়, কিন্তু চিঠিতে যদি আমার প্রাণের দুঃখ-কষ্টের কথা না-ই লিখতে পারি, তাহলে সে চিঠি লিখব কেন? এই ভয়েই বাবার কোনো চিঠির উত্তর দিচ্ছি না অনেক দিন যাবৎ।

নাট্য আন্দোলনের প্রথম গ্রুপ ড্রামা সার্কেলে তখন নাটক করি। মুকসেদুল সালেহীন যখন নাটকের হাজার বছরের ইতিহাস বলতেন তা শুনে অবাক হয়ে যেতাম। শুধু ভারতবর্ষ কেন, সারা পৃথিবীর আধুনিক নাটকের উপমা টেনে আনতেন। আমি তখন ¯ব্ধ হয়ে থাকতাম। মনে হতো আমি যেন হাজার বছরের পুরোনো এক নাট্যমন্দিরে ঢুকেছি। ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছে, শেক্‌সপিয়ার এসে মঞ্চে দাঁড়াচ্ছেন। পর্দা সরে যাচ্ছে, জার্মানির মঞ্চে ব্রেখট এসে দর্শকদের অভিবাদন জানাচ্ছেন। কলকাতার মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের রক্ত করবী হচ্ছে। অন্ধকারে নন্দিনী এসে রাজার সঙ্গে কথা বলছেন। রাজা শম্ভু মিত্রের ভয়াবহ কণ্ঠস্বরে সমস্ত দর্শক স্তব্ধ হয়ে আছেন।

মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবনে শাইখ এবং নরুল মোমেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিন নাট্যকারকে নিয়েই যত আলাপ-আলোচনা। মফস্বলেও তাদের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে সারা বছরই। ড্রামা সার্কেলে রক্ত করবী করার পর মুনীর চৌধুরীর একমাত্র কবর নাটক ছাড়া আর কোনো নাটকই ভালো লাগছে না আমার। তাদের সমালোচনা করব এমন বিদ্যাবুদ্ধিও আমার নেই। এই শ্রদ্ধেয় ত্রয়ী নাট্যকার সম্পর্কে কাউকে কিছু বলারও সাহস পাচ্ছি না। সে এক দারুণ জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়েছে আমার ভেতরে। আমার এই অস্থির সময়ে হঠাৎ একদিন গুলিস্তান সিনেমা হলে ছবি দেখতে গেলাম। ছবিটির নাম জাগো হুয়া সাবেরা। ছবিটি পরিচালনা করেছেন এ জে কারদার। সহকারী পরিচালক জহির রায়হান। নায়ক আনিস মানে খান আতাউর রহমান। শুধু একবার নয়, পর পর কয়েক দিন একই ছবি দেখলাম। কী আশ্চর্য ছবি, জীবনের কত কাছে গিয়ে জীবনের কথা বলছে। এই ছবি তো অন্য রকম ছবি। দিলীপ কুমার-নার্গিস কিংবা উত্তম-সুচিত্রার গানে ভরা ছবি নয়। এই ছবিকেই বোধহয় জীবন-ঘনিষ্ঠ ছবি বলা হয়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসেরই চিত্ররূপ জাগো হুয়া সাবেরা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি কোথাও নেই। কেন? মানিকবাবুর অপরাধ কী? দেশটা ভাগ হয়ে গেছে বলেই কি হিন্দু বলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি ব্যবহার করা হয়নি? এই নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক যন্ত্রণা বন্ধু-বান্ধবের আলাপ-আলোচনায়।

জহির রায়হান তখন আমার একজন প্রিয় গল্পকার। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার অনেক গল্প পড়ে আমি মুগ্ধ। সেই জহির রায়হান এই ছবির সহকারী পরিচালক। তাহলে লেখকরাও কি ছবি পরিচালনা করতে পারেন? এমন একটা প্রশ্ন উঠল আমার ভেতরে। আমার ধারণা ছিল, কবি-সাহিত্যিকরা কোনো দিন চলচ্চিত্রের জগতে আসেন না। পরে বন্ধু-বান্ধবের কাছে শুনলাম, শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র এমনকি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হয়েছিলেন। নজরুল ইসলাম তো অভিনয়ও করেছেন চলচ্চিত্রে।

আরও দু-একবার ছবিটি দেখলাম। নায়কের চরিত্রে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল খান আতাকে। লম্বা ছিপছিপে শরীর। মাথায় বাবরি চুল। মুখে কোনো মেকআপ নেই। কণ্ঠস্বর ভীষণ আবেগময়। তখন মনে হয়েছিল, এই মাঝির চরিত্রে খান আতাকে যত মানিয়েছে, উত্তম কুমারকেও এভাবে এমন চরিত্রে মানাবে না। নায়িকা তৃপ্তি মিত্রও নিখুঁত অভিনয় করেছেন। কাজী খালেকের অভিনয় অনেক দিন মনে রেখেছেন এ দেশের দর্শক। তার চেয়ে বড় কথা, এ ধরনের ছবি এখানে নির্মিত হয়নি। সত্যজিৎ রায়ের সেই বিশ্ব বিখ্যাত ছবি পথের পাঁচালী এখনো দেখিনি বলে এই জাগো হুয়া সাবেরা ছবিটিই আমাদের চলচ্চিত্রের নতুন এক জায়গায় নিয়ে গেল। ছবি মানেই নাচে-গানে ভরপুর, এ কথাটা মিথ্যা। বানোয়াট। চলচ্চিত্র যে জীবনের কথা বলতে পারে, কঠিন বাস্তবতাকে টেনে তুলে আনতে পারে সিনেমার পর্দায়, তার প্রমাণ এই জাগো হুয়া সাবেরা। পরবর্তী সময়ে পত্রপত্রিকায় দেখেছি, এ জে কারদারের এই ছবিটিও মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছে।