বাবার কাছে শিখেছি, পানির মতো হতে হবে। পানি যেমন যেকোনো স্থান-কাল-পাত্রে নিজেকে মানিয়ে নেয়, শিল্পী হতে হলে হতে হবে সে রকম। ঠিক পানির মতো করেই চরিত্রগুলোয় নিজেকে গলিয়ে দিই, ধারণ করি সেই চরিত্রের আকার, রং, ঢং। কখনো কখনো কিছু চরিত্রের সঙ্গে আমি এমন একাকার হয়ে যাই, অভিনয় শেষেও তারা আমার ভেতর রেশ রেখে যায়। কখনো কোনো চরিত্রকে আমি টেনে নিয়ে তুলে ধরি পর্দায়। কখনো আবার কিছু চরিত্রের ওপর ছেড়ে দিই আমার সব ভার। এভাবেই চরিত্রে চরিত্রে নানা মাত্রার বোঝাপড়া চলে আমার।
অভিনয়জীবনে কত চরিত্রেই তো নিজেকে ঢেলেছি। মনে রাখার মতো চরিত্রের সংখ্যা কম নয়। একটা নিয়ে বলতে গেলে আরেকটা মনে কড়া নেড়ে বলে, আমিও কিন্তু আছি।
যে তিন নির্মাতা আমার অভিনয়জীবনকে রূপ দিয়েছেন, তাঁদের একজন অরণ্য আনোয়ার, আরেকজন গোলাম সোহরাব দোদুল। অরণ্য আনোয়ারের কাজ করে আমি পরিচিত হয়েছি। আর গোলাম সোহরাব দোদুল আমাকে নিয়ে গেছেন চরিত্রের বৈচিত্র্যে ভরা এক রঙিন জগতে। কখনো যৌনকর্মী, কখনো অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে, কখনো মাঝবয়সী সংগ্রামী মা, কখনো নির্যাতিত সাহসী নারী। সেসব করতে করতে অভিনেত্রী হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস ক্রমে বেড়েছে।
তৃতীয়জন, ঠিকই ধরেছেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সরয়ার নাকি আমাকে প্রথম দেখেছিল ‘নুরুল হুদা’ নাটকের সেটে। সে স্মৃতি আমার নেই। আমার স্মৃতিতে আছে, আমাদের দেখা হয়েছিল কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মাধ্যমে। তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন সরয়ারের একটা নাটক ‘পরপার স্টোর’-এ অভিনয়ের জন্য। ‘তোমার নখ তো বড়। আমাকে চুইংগামের প্যাকেটটা খুলে দাও তো।’ এটাই ছিল আমার সঙ্গে সরয়ারের প্রথম কথা। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। সেই বিরক্তি নিয়ে মাকে বলেছিলাম, এই লোকটির সঙ্গে কাজ করব না।
‘পরপার স্টোর’-এ কাজ করতে গিয়ে দেখি, সরয়ারের কাজের ধরন একেবারেই অন্য রকম। ইম্প্রোভাইজেশন বা তাৎক্ষণিক অভিনয়ের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। কাজের এই ধরন আমাকে দারুণ টানল। সেই টানের স্রোতে আমরা কোত্থেকে কোথায় গিয়ে পড়লাম, সেটা পরের ইতিহাস।
হয়ে উঠলাম চটপটে
‘আমাদের নুরুল হুদা’ * রুম্মান
তখনো আমি স্কুলছাত্রী—ভিকারুননিসা নূন স্কুলে, দশম শ্রেণিতে। এখনকার তিশা প্রাণখোলা হাসি আর আড্ডায় সাবলীল হলেও সেই তিশা ছিল চুপচাপ। এই দুই তিশার মাঝখানে পরিবর্তনের সূত্রপাত ‘আমাদের নুরুল হুদা’ নামে ধারাবাহিক এক নাটকে।
পরিচালক অরণ্য আনোয়ারের সাহসেই নাম লেখাই সিরিজটিতে। নাটকের সিকুয়েল তৈরির প্রচলন বোধ করি এটি থেকেই শুরু হয়েছিল। ‘নুরুল হুদা একদা ভালোবেসেছিল’, ‘অতঃপর নুরুল হুদা’ এবং ‘আমাদের নুরুল হুদা’—এসবে দেশের তারকা–শিল্পীদের সমাবেশ ঘটেছিল। জাহিদ হাসান, জয়া আহসান, মাহফুজ আহমেদ, মোশাররফ করিম, ফজলুর রহমান বাবু, মাসুম আজিজ, শ্রাবন্তী, রুমানা রশীদ ঈশিতাদের মতো শিল্পীরা ছিলেন এই নাটকের অংশ। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখন এত বড় বড় শিল্পীর সঙ্গে পর্দা ভাগ করা ছিল আমার জন্য অভাবনীয়। আমি তখন স্কুলপড়ুয়া নিতান্ত এক কিশোরী।
অরণ্য আনোয়ার যখন নাটকে আমার রুম্মান চরিত্রটির কথা শোনালেন, আমি একদম ঘাবড়ে গেলাম। রুম্মান পটপট করে কথা বলে, কাউকে ভয় পায় না, অনর্গল কথা চালিয়ে যেতে ওর বাধে না। কিন্তু হড়বড় করে কথা বলাই তখনকার তিশার কাছে বিরাট এক ঝক্কি। স্কুলে যারা অনেক কথা বলত, আমি তাদের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকতাম। আমি তখন একেবারেই নতুন, চরিত্র তৈরি করা, চরিত্রের নানা স্তর—অতশত বুঝতাম না। পরিচালকের চোখে চরিত্রটাকে দেখে ক্যামেরার সামনে সেটাই তুলে ধরতাম। তখনো আমি কেবলই ডিরেক্টরস অ্যাক্টর। এখনো কমবেশি তা-ই। তবে এখন চরিত্রটি পরিচালকের চোখ দিয়ে দেখে তারপর চরিত্রের গঠন, গভীরতা আর উপস্থাপন নিয়ে নিজে কাজ করি।
রুম্মানে ফিরে যাওয়া যাক। চটপটে, বাকপটু, সাহসী মেয়ে রুম্মান হওয়ার জন্য আমি চৌকস মেয়েদের অনুসরণ করতে শুরু করি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার চর্চা করি। জাহিদ হাসান, ফজলুর রহমান বাবু, মাহফুজ আহমেদের মতো অভিনেতারা তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। মনে মনে ভাবি, তাঁদের সঙ্গে এক ফ্রেমে দাঁড়াব। পরিচালক ‘অ্যাকশন’ বললেই তো সব গুলিয়ে যাবে। কথা জড়িয়ে যাবে আমার। সংলাপগুলো মুখের ভেতরেই হারিয়ে যাবে কোথাও।
মাহফুজ আহমেদ আর আমি প্রথম দৃশ্যে দাঁড়িয়েছি ক্যামেরার সামনে। পরিচালক বললেন, অ্যাকশন। আমি আমার সংলাপ বললাম। মাহফুজ ভাইও তাঁরটা বললেন। ডিরেক্টর ‘কাট’ বলে ‘ওকে’ বলতেই জানে পানি এল। কিন্তু মাহফুজ ভাই অনুরোধ করলেন, ‘আমরা কি শটটা আরেকবার দিতে পারি?’ পরিচালক অরণ্য আনোয়ার কারণ জানতে চাইলেন। প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ ভাই যা বললেন, সেটি এখনো আমার মনে রয়ে গেছে, ‘তিশা যে প্রথমবারেই এতটা ভালো করবে, আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমার অংশটাও তো তিশার মতো ভালো হওয়া উচিত। আবার করি।’ মাহফুজ ভাই তখন আমাদের কাছে তারকা। তাঁর সেই কথায় আমার আত্মবিশ্বাস চতুর্গুণ হয়ে গিয়েছিল।
এই চরিত্র ঘিরে আমার কত যে স্মৃতি। আমার বয়স তখন এতই কম ছিল যে মাহফুজ ভাইয়ের সহ-অভিনেত্রী হিসেবে পর্দায় তুলে ধরার জন্য, মানে আমাকে বড় দেখানোর জন্য নির্মাতা-কুশলীদের অনেক যন্ত্রণায় পড়তে হয়েছে। পোশাক, চুল বাঁধা, হাঁটাচলা কেমন হলে স্কুলপড়ুয়া তিশা গ্রামের মেয়ে রুম্মান হয়ে উঠবে, তা নিয়ে চলল বিস্তর গবেষণা। দর্শক যখন রুম্মানকে মনে রাখতে শুরু করল, তখনই সার্থক হলো সব গবেষণা। নাটক শুরু হয়ে একসময় শেষও হয়ে গেল, কিন্তু রুম্মান আমাকে ছেড়ে যায়নি কোনো দিনও। সেই যে মুখচোরা আমি পটপট করে কথা বলা শিখে গেলাম, তার আর কোনো থামাথামি নেই।
নাটকে জীবনে একাকার
‘সিক্সটি নাইন’ * দিঠি
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘পরপার স্টোর’-এ কাজ করতে গিয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, সেটাই আমাকে টেনে আনল ওর পরের নাটকে। ‘পরপার স্টোর’-এর শুটিংয়ের শেষ দিকে সরয়ার আমাকে ‘সিক্সটি নাইন’ নাটকটির কথা বলল। আমি এককথায় রাজি।
নাটকের দিঠি চরিত্রটা আমার বয়সী এক তরুণীর। তাই দিঠির মনস্তত্ত্ব ধরতে আমার সমস্যা হয়নি। সেটে এসে কথা বলতে বলতে আমরা নিজেদের চরিত্র বুঝে নিতাম, তাদের নানা দিক জেনে নিতাম। এরপর ইম্প্রোভাইজ করে শট দিতাম। সাবলীলভাবে কাজ এগোচ্ছিল। নাটকের মা-বাবা-বোনেরা বাস্তবেও হয়ে উঠছিল পরিবারেরই মতো। সরয়ারের সঙ্গে সখ্যও ধীরে ধীরে প্রেমের দিকে গড়াতে শুরু করল। কাজের ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে আমরা কথা বলতাম। মনে আছে, আগের দিন রাত জেগে ফোনে প্রেম করতাম। পরদিন সরয়ার সেটে এসে আগের রাতের কথাবার্তা সংলাপ হিসেবে নাটকে ঢুকিয়ে দিত। ‘সিক্সটি নাইন’-এর সেটের ছাদে দাঁড়িয়েই আমি আর সরয়ার প্রথম যুগল ছবি তুলেছিলাম। নাটকে আমার ছোট বোনের চরিত্রে অভিনয় করেছিল শ্রেষ্ঠা। সে-ই তুলে দিয়েছিল ছবিটা। মেয়েরা সত্যিই যেমন প্রেমের কথা সবার আগে ছোট বোনকে জানায়, আমিও আমাদের সম্পর্কের কথা সবার আগে শ্রেষ্ঠাকে জানিয়েছিলাম। নাটক আর বাস্তব একাকার হয়ে গিয়েছিল ‘সিক্সটি নাইন’-এর সেটে।
‘সিক্সটি নাইন’-এর শেষ দৃশ্যে দিঠি জানতে পারে, ওর দুরারোগ্য ব্যাধি হয়েছে। ওই দিনের শুটিংয়ের আগপর্যন্ত দিঠির পরিণতি আমি জানতাম না। শুধু জানতাম, ওর একটা অসুখ হবে। টেকে যাওয়ার আগে সরয়ার বলল, দিঠি আর ফিরবে না। শুনে আমি থমকে গেলাম। আমার মাথায় ঢুকে গেল, আমি আর ফিরব না? আমার হাতে আর সময় নেই? কেমন ঘোর লেগে গেল। হঠাৎ মনে হলো, আমি চলে গেলে আমার মায়ের কী হবে? মা তো একা হয়ে যাবে? দিঠির জীবনের অনিশ্চয়তা গ্রাস করে ফেলল আমাকে। অনুভূতিটা আমাকে এমনভাবে পেয়ে বসল যে আমি হু হু করে কাঁদতে শুরু করলাম। ক্যামেরা চলতে থাকল, আমার কান্না থামে না। পুরো সেট স্তব্ধ। শিল্পের বেদনা শূন্য করে দিল আমার বুক।
না-বলা কথা বাবাকে
‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ * রুবা
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলল, ‘চলো, এবার একটা সিনেমা করি।’ আমাকে সে শোনাল ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবির রুবা চরিত্রটি। সাধারণ পারিপার্শ্বিকতায় বেড়ে ওঠা এক জটিল বুনটের একটি চরিত্র। আমাদের সমাজে উচ্চবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের একা বাস করা কঠিন নয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও জীবিকার কারণে একা থেকে যায়। কিন্তু একটি মধ্যবিত্ত মেয়ে? একা মেয়ের চারপাশে কতশত প্রশ্ন। সব প্রশ্ন তো মানুষ মুখ দিয়েও করে না। প্রশ্ন তোলে চোখ, আচরণ আর অভিব্যক্তি দিয়ে। রুবা সে রকম একটি মেয়েরই প্রতিনিধি।
ছবিটি মুক্তির পর আমার একটি অসামান্য অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমরা মফস্বলের একটি সিনেমা হলে ঘুরতে যাই। ফিরে আসার সময় এক চায়ের দোকানি আমাদের চায়ের দাওয়াত দিলেন। আমাদের ২৫ জনের পুরো দলকেই তিনি চা খাওয়াবেন। চা খাওয়াতে খাওয়াতে তিনি বললেন, তাঁর মেয়েটিও ঢাকায় একা থাকে। এই ছবিটি নাকি তাঁকে তাঁর মেয়ের জীবনের লড়াইগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বলতে বলতে তাঁর অশ্রু চিকচিক করতে লাগল। বললেন, ‘আজকাই মেয়েরে ফোন দিমু। কমু, যা-ই হোক, তোর বাপ তোর লগেই আছে মা!’ ভদ্রলোকের কথা আমার ভেতরে তিরের মতো গেঁথে গিয়েছিল।
ছবিতে একটি দৃশ্যে রুবা ঘুম ভেঙে জেগে উঠে দেখে, বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে সে একা। মাকে ডাকছে। মায়ের মৃত্যুর পর শেষবারের মতো সে মাকে দেখতে পাচ্ছে না। মায়ের কাছে গিয়ে তাঁকে বলতে পারছে না নিজের ভেতরের না-বলা কথাগুলো। সেই দৃশ্যে রুবার যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলার সময় হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় বাবার কথা। রুবা যখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘মা, আই অ্যাম সরি।’ আমার মনে হলো, আমিও বাবাকে বলতে চেয়েছিলাম তাঁকে কতটা ভালোবাসি। কখনো তাঁকে ‘আই অ্যাম সরি’ বলার সুযোগ হয়নি। এর আগেই তিনি চলে যান। রুবার সঙ্গে সেদিন আমিও বাবাকে বলেছিলাম মনের না-বলা কথাগুলো। দৃশ্যটিতে তিশাকে ফুঁড়ে রুবা জেগে উঠেছিল।
পরে যখন সরয়ার জানতে চেয়েছিল, ‘ডুব’ ছবিতে আমি কোন অভিনয় করতে চাই? একবাক্যে আমি সাবেরির নাম বলেছিলাম। সাবেরির গভীর শূন্যতা আমার শূন্যতায় এসে মিলেছিল। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে না পারার কষ্ট, তাঁর স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা, একটিবারের জন্য হলেও বাবাকে ফিরে পাওয়ার আকুতি, আমি নিজেকে দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম।
অচেনাকে চেনা
‘মায়াবতী’ * মায়াবতী
সব চরিত্রই তো আর জীবন থেকে আমরা পাই না। কিছু চরিত্র আসে একেবারেই অচেনা। জীবনের দূরদূরান্তেও যার ছায়া খুঁজে পাওয়া যায় না, সেসব চরিত্র আমাকে অনেক টানে। যেমন শুরুতেই বলব অঞ্জন চৌধুরীর ‘মায়াবতী’ ছবির কথা। প্রতিটি সিনেমার আগে আমি প্রায় দেড় মাস সময় নিই। এই দেড় মাস আমি অন্য কোনো কাজ করি না। এই সময়টাতে নিজেকে চরিত্রের উপযোগী করে তুলি।
মায়াবতী চরিত্র হয়ে ওঠার জন্যও আমি দেড় মাস সময় নিয়েছিলাম। ছুটে গিয়েছিলাম দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিতে। কারণ, চরিত্রটি ছিল যৌনকর্মীর। প্রায় দিনই সকালে আমি দৌলতদিয়া চলে যেতাম, ফিরতাম রাতে। যৌনকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। দেখতাম তাঁদের জীবন। তাঁদের গল্প শুনতে শুনতে মনে গেঁথে নিতাম গল্প বলার ঢং। এভাবেই আমার ভেতরে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় মায়াবতী চরিত্রটি।
প্রতিকূলতায় প্রেরণা
‘ছিন্ন’ * তিথি
আমরা পর্দায় যে গল্পটা দেখি, সেটা ফুটিয়ে তোলার পেছনে যে আরও কত না-বলা গল্প থেকে যায়! কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সে রকম কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল ‘ছিন্ন’ টেলিছবির তিথি আর ‘রাতারগুল’-এর লাইলি চরিত্র করতে গিয়ে।
ওয়াহিদ আনামের ‘ছিন্ন’ করতে গিয়ে যে যে অভিজ্ঞতা হলো, সেটা ভয়ংকর। ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। ছবির শুটিং লোকেশন ছিল কুয়াকাটার সৈকতে। সুন্দরবনের উপকূলবর্তী সেই এলাকায় চলে এল ৩ নম্বর বিপৎসংকেত। আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে শুরু করল ঝড়। কী যে বিধ্বংসী সেই ঝড়। একটা সময় মনে হলো, আমরা আর হয়তো বেঁচে ফিরতে পারব না।
ঝড়ের অভিজ্ঞতা আমার আগেই ছিল। বুঝতে পারছিলাম, যেকোনো মুহূর্তে নেটওয়ার্ক চলে যাবে। সরয়ার তখন সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরে। দ্রুত ওকে মেসেজ করলাম, ‘আর কোনো কথা না হলে ক্ষমা করে দিয়ো। মনে রেখো, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমার মাকে দেখে রেখো।’ এখন মনে পড়লে হাসি পায়, কিন্তু তখন সত্যিই অন্তরে মৃত্যুভয় ঢুকে গিয়েছিল।
ঝড় থেকে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাতেই বিপদের শেষ হয়নি। একটা ভেলায় চড়ে তারিক আনাম খান আর লুৎফর রহমান জর্জের সঙ্গে শুটিং করতে হবে। আমি তো সাঁতার জানি না। সে নাহয় সামাল দেওয়া গেল। ঘটনা ছিল আরও রোমহর্ষ। একটা দৃশ্যে আমাকে কাদায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখানো হবে। শুটের আগে আমাকে বলে দেওয়া হলো, একটু পরপর যেন আমি হাততালি দিই। কেন এই অদ্ভুত কাণ্ড, প্রথমে বুঝিনি। পরে জানতে পেরেছি, আমি যেখানে শুয়ে ছিলাম, তার পেছনের ঝাড়ে কুমিরের আনাগোনা। আওয়াজ করে মানুষের অস্তিত্ব জানান না দিলে ওরা বেরিয়ে আসতে পারে। পরে শুনে আমার গা শিউরে উঠেছিল।
আরও যে কত গল্প, জীবনে গভীর দাগ রেখে যাওয়া অভিজ্ঞতা। ‘আরমান ভাই’ আর ‘লেডিকিলার’-এর মতো প্রযোজনাগুলো করে পেয়েছি অগণিত মানুষের ভালোবাসা। তৌকীর আহমেদের ‘হালদা’য় উপকূলবর্তী নারী, শিহাব শাহীনের অসম্ভব জনপ্রিয় টেলিছবি ‘মনফড়িঙের গল্প’-এ ডিজিটাল যুগের তরুণী, ‘অস্তিত্ব’-এ অভিনয়ের জন্য অটিস্টিক মেয়ে—আলাদা আলাদাভাবে আমাকে জীবন চিনিয়েছে। অভিনয় শেষ হলেও তাই কিছু কিছু চরিত্রের কিছু অংশ আমার ভেতরে রেখে যায়। অভিনয়ের এই এক অসম্ভব আনন্দ।