শুধু বাসভাড়া নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। উঠেছিলেন ভাইয়ের বাসায়। কিছুটা বাউন্ডুলে জীবনযাপনের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। চোখের সামনে তখন বড় স্বপ্ন। কিন্তু ‘এই যেন স্বপ্ন থেমে যায়’—এমন অবস্থার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে তাঁকে। তারপরও একাধিক সংকট আর সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। দীর্ঘ সাধনায় সুযোগ আসে। এরপর নিজেকে প্রমাণ করার পালা। তিনি নামকে ছাপিয়ে দর্শকের কাছে হয়ে ওঠেন পর্দার ‘সোনাই’, ‘কালু’, ‘সোলেমান’ কখনো বা শরাফত করিম আয়না। দর্শক হয়তো বুঝতে পেরেছেন ‘বোঝ নাই ব্যাপারটা’খ্যাত সময়ের দাপুটে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর কথা বলছি। নাটক, সিনেমা কিংবা ওয়েব ফিল্ম-সিরিজ সব জায়গায়ই তিনি শতভাগ সফল। দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রতিমুহূর্তে নিজেকে যেমন ভেঙেছেন, তেমনি বিভিন্ন শাখায় তাঁর উপস্থিতির বাঁকবদল ছিল আয়নাবাজির মতোই। আজ পয়লা জুন এই সফল অভিনেতার জন্মদিন।
চারুকলায় ভর্তি হয়ে যুক্ত হয়ে যান মঞ্চনাটকে। ক্লাসের ফাঁকে আরণ্যক হয়ে ওঠে তাঁর ঘরবাড়ি। ঠিক সেই গ্রামের সেই স্কুলের মতো। ক্লাস শেষ হলেই দুপুরের পর ছুটে চলে যেতেন স্কুলের মাঠে। বেশির ভাগ দিন খেলায় সেখানেই সময় কাটত। এর মধ্যেই খুঁজে পেতেন আনন্দ। সেই আনন্দ এবার ধরা দিল নাটকের মঞ্চে। প্রতিদিন এই আনন্দের মোহে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে হেঁটে যেতেন নাটকের মহড়ায়। দিনের পর দিন সেভাবে হাতখরচও থাকত না। কিন্তু চোখে ছিল অফুরন্ত স্বপ্ন—অভিনয়টা শিখবেন। একসময় সব বাধা কাটতে শুরু করে। মঞ্চনাটক তাঁকে নতুন জীবন দেয়। এখানেই খুঁজে পান পিতার পরের দ্বিতীয় ব্যক্তিকে, যিনি আরণ্যক নাট্যদলের প্রধান অভিনেতা ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ। এখনো চঞ্চল গৌরবের সঙ্গে বলেন, ‘অভিনেতা হিসেবে আমার জন্ম হয়েছে মামুন ভাইয়ের হাত ধরে। আমার অভিনেতা হিসেবে যা কিছু অর্জন, তার সবচেয়ে বড় অংশীদার মামুন ভাই আর আমার নাট্যদল আরণ্যক। সেই সূত্রে মামুন ভাই আমার দ্বিতীয় পিতা আর আরণ্যক আমার পরিবার।’
পাবনা জেলায় জন্ম হলেও প্রত্যন্ত এক গ্রামে ছিল চঞ্চলদের বাড়ি। যে গ্রামে বর্ষায় রাস্তায় হাঁটু পর্যন্ত কাদা, শীতে ধুলায় মাখামাখি। এখানেই এক শিক্ষক পরিবারে তাঁর জন্ম, যাঁকে শৈশব থেকেই শুনতে হয়েছে ‘মাস্টারের ছাওয়াল’। সেই শিক্ষক বাবা অন্য দশজন বাবার মতোই চাইলেন, আট সন্তানের ছোট ছেলে চঞ্চল প্রকৌশলী হোক। এতে প্রথমত শিক্ষক পরিবারে সম্মান বৃদ্ধি পাবে। সবাই বাহ্বা দেবেন, চিকিৎসক–প্রকৌশলী সবই আছে মাস্টারের ঘরে। অন্যদিকে ক্যারিয়ারে ছেলেকে কখনো পেছনে তাকাতে হবে না। সেই ছেলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ডালপালা ছড়াতে শুরু করলেন। পরিবারের সবার মন খারাপ। তাঁরা চঞ্চলকে নিয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন। আদরের ছোট ছেলে, তাই কেউ মুখে কিছু বলতে পারতেন না। তবে তাঁদের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল। সেটা চঞ্চল বুঝতেন। আর মা–বাবার মুখে অব্যক্ত কথা, ছেলে কোথা থেকে পেল এসব?
শৈশবে পরিবারে গানবাজনা বা সাংস্কৃতিক আবহে থাকলেও সেভাবে চঞ্চলের ইচ্ছা ছিল না সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছু করার। তাহলে সংস্কৃতির এই বীজের বপন কীভাবে হলো চঞ্চলের মধ্যে? চঞ্চল বলেন, ‘আমাদের বাড়ি থেকে পাবনা জেলা অনেক দূরে ছিল। ৩০ কিলোমিটারের কম নয়। তখন রাস্তাঘাট ভালো ছিল না। ৯০ দশকের শুরুর দিকে আমার গ্রাম ছিল একটা অজপাড়াগাঁ। আমাদের তখন যোগাযোগ ছিল পাশের জেলা রাজবাড়ীর সঙ্গে। নদীপাড় এলাকায় বাড়ি। নদী পাড় হলেই রাজবাড়ী। সেখানে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল। যে কারণে শৈশবে বড় একটা সময় সেখানেই কাটে। আমার জামাইবাবু পীযূষ কান্তি সাহা ছিলেন শিক্ষক। একই সঙ্গে তিনি সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই আমার সংস্কৃতির বীজটা পাওয়া। তিনিই আমাকে উৎসাহিত করেছেন—সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছু একটা করতে হবে। আমার গানবাজনা, চারুকলার প্রতি ঝোঁক তৈরি হতে লাগল। জামাইবাবুর জন্যই আমি স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে থাকলাম। মায়ের মুখে শোনা ভক্তিগীতি একসময় আমার কাজে লেগে গেল।’
আরণ্যক নাট্যদলে যোগ দিয়ে টানা প্রায় এক দশক মঞ্চে অভিনয়ের তালিম নেন চঞ্চল। এই অভিনেতা মনে করেন, এটা ছিল পরিবারের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজ। কারণ, তিনি শুধু এই একটি কাজের পেছনেই ছুটেছেন। পরিবারের চোখে ছিল, চঞ্চল ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। এখানে সবাই সফল হয় না। অভিনয় ক্যারিয়ার নিয়ে একসময় উভয়সংকটে পড়ে যান তিনি। তারপরও মনোবল ছিল, অভিনয় পেশাই তাঁর আসল জায়গা। এমনও হয়েছে—১০/১৫ বছর অভিনয় করার পর তাঁকে শুনতে হয়েছে, ‘ভাই অভিনয়ের সঙ্গে আর কী করেন?’ চঞ্চলের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে নেওয়া অনেকটাই ঝুঁকি ছিল। তারপরেও স্বাধীন ভাবে এগিয়েছেন। গুরু মামুনুর রশীদের লেখা ‘সুন্দরী’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন চঞ্চল। পরে দীর্ঘদিন তাঁকে নাটকের ছোট চরিত্রগুলো করতে হতো। এর মধ্য দিয়ে নিজের সেরাটা দেখানোর চেষ্টা করতেন। পরে একসময় ভাগ্য তাঁকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে যায়। সেটা বেশি দিন করেননি। ২০০৪ সালে পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় যেন এক ঐতিহাসিক পর্ব।
এরপর যেন সেই ‘মা’ বিজ্ঞাপনটির কথা মনে আসে। এটি মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল হিসেবে ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মা গো কবে শীতল হবো’... কালজয়ী এই গানটি ব্যবহার করা হয়। নিজেরর গাওয়া জিঙ্গেলের বিজ্ঞাপনচিত্রটিতে মডেল হয়েছিলেন তিনি। ঈদের সময় এটি প্রচার শুরু হয় টেলিভিশনে। তারপরে রাতারাতি দেশের দর্শকের কাছে পৌঁছে যান চঞ্চল। এর আগে কিছু বিজ্ঞাপন করলেও এটি তাঁকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন শুধু অভিনয়ের জাত চেনানোর পালা। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, সালাহউদ্দিন লাভলুসহ একাধিক পরিচালকের নাটক ও বিজ্ঞাপনের নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন চঞ্চল। নাটকের তুমুল আলোচিত অভিনেতা চঞ্চল। বলা যায়, চঞ্চলের অভিনয়ের মধ্য দিয়েই গ্রামের নাটকগুলো দেশের দর্শকের কাছে ভিন্নমাত্রা পায়। তার কারণ ছিল, গ্রামের সব চরিত্রে শতভাগ গ্রামের মানুষের কাছাকাছি চলে যেতেন তিনি। তাঁকে আর অভিনেতা চঞ্চল মনে হতো না। এ কারণেই গ্রামের লাখ লাখ মানুষ তাঁর নাটকের সিডি কিনে দেখা শুরু করেন। ঘরে ঘরে তখন জায়গা পেত শুধুই চঞ্চলের নাটক। এমনকি পাবনার আঞ্চলিক ভাষাকে তিনি সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলেছেন। নাটকে তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেতা যেমন হাসিয়েছেন তেমন দর্শকদের কাঁদিয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আবার বাঁকবদল আসে।
এর মধ্যেই চঞ্চল নাম লেখান সিনেমায়। প্রথম অভিনয় করেন তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় ‘রূপকথার গল্প’ সিনেমায়। সিনেমায় তাঁর অভিনয় প্রশংসা পেলেও সিনেমাটি সেভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি। তবে প্রশংসিত। এরপর কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে যুক্ত হন ‘মনপুরা’ সিনেমায়। কারণ, নাটকে তাঁকে দর্শক যে চরিত্রে দেখে থাকেন, সেটা থেকে চরিত্রটি একদমই ব্যতিক্রম। মুক্তি পায় সিনেমাটি। এ যেন অন্য এক চঞ্চল। যাঁকে সেই সহজ–সরল ‘সোনাই’ বলে মনে হয়। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সোনাই হয়ে দেখা দেন। পুরো ব্যতিক্রম এই চরিত্রে তিনি শতভাগ উতরে যান। ‘মনপুরা’ দিয়ে চলচ্চিত্র অভিনেতা হয়ে দেশের সব দর্শকের সমাদর পান চঞ্চল। ছোট পর্দার পাশাপাশি সিনেমায়ও সমানতালে অভিনয় চালিয়ে যান।
এরপর দর্শকের সামনে আসে ওটিটি। দর্শক ওয়েব ফিল্ম সিরিজের যুগে প্রবেশ করেন। এখানেও ঘূর্ণিঝড়ের মতোই বাঁকবদল করেন চঞ্চল। বুঝেশুনে যুক্ত হন। এ জন্য তাঁকে অনেক গল্পকে ‘না’ বলতে হয়েছে। এরপর হঠাৎ চমকে দেন দর্শককে। তাঁর অভিনীত ‘তকদির’ মুক্তির পরই দর্শকের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। একে একে প্রশংসা পেতে শুরু করেন তিনি চরকির ‘উনলৌকিক’ সিরিজ, ‘মুন্সিগিরি’, হইচইয়ের ‘বলি’সহ একাধিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মের কাজ দিয়ে। দীর্ঘ ক্যারিয়ার নিয়ে চঞ্চল সব সময় ধীরগতিতে হেঁটেছেন। এটাই যেন তাঁর সফলতার মূলমন্ত্র। এই অভিনেতার তুমুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও তিনি নিজেকে সময় দেন, পরিবারকে সময় দেন। ক্যারিয়ার শুরুর পর তাঁর মধ্যে এই একটিই মিল, তিনি কখনো একাধিক কাজের চাপে থাকেননি। সংখ্যার চেয়ে মানের দিকে তাঁর নজর বেশি। ব্যতিক্রম চরিত্রের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পান। প্রতিটি চরিত্রে নিজেকে প্রমাণ করাই তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
চরিত্র নিয়ে খেলতে ভালোবাসেন চঞ্চল। এ কারণেই সব চরিত্রের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে যান। মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ‘হাওয়া’ সিনেমার জন্য ৪০ দিন বঙ্গোপসাগর উপকূলে থেকেছেন, শুটিং করেছেন। ‘বলি’ ওয়েব সিরিজের শুটিংয়ের সময় ২০ দিনের মতো চরিত্রের মধ্যে বসবাস করেছেন। অভিনেতা হিসেবে কাজের পেছনে এত সময় দেওয়ার ঘটনা দেশের প্রেক্ষাপটে বিরল। এ জন্যই হয়তো ‘মনপুরা’, ‘আয়নাবাজি’, ‘দেবী’সহ একাধিক কাজে প্রমাণ করেছেন, তিনি জাঁদরেল অভিনেতা। মজার ব্যাপার হলো, প্রায়ই এই অভিনেতাকে শুনতে হয়, ‘চঞ্চল ভাই, আপনি তো সিনেমায় পুরো উড়িয়ে দিয়েছেন, ফাটিয়ে দিয়েছেন।’ এটা নিয়ে চঞ্চলের বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। তিনি নীরস ভঙ্গিতে বলেন, ‘কাজটা যদি ভালো হয়, ভালো নাটক হলেও দর্শকেরা অভিনয় পছন্দ করেন, সিনেমা হলেও দর্শকেরা একইভাবে গ্রহণ করেন। এটাকে আমি অন্যভাবে দেখি না। আমি ভালো কাজের পাগল।’