শিল্পীসংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম
শিল্পীসংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম

করোনাকালে রাজনীতিতে ফেরার প্রেরণা পাচ্ছেন সেলিম

ছাত্ররাজনীতি করতেন অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। সেখান থেকে পরে আর মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেননি তিনি। বরং থিয়েটারে মনপ্রাণ সঁপেছেন, একেই করেছেন পেশা। তবে করোনাকাল তাঁকে দিচ্ছে রাজনীতির পুরোনো মঞ্চে ফেরার প্রেরণা। সম্প্রতি অতীত রাজনীতির নানা আলো-আঁধারের দ্বার খুলে গেছে তাঁর সামনে।

করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিম। নমুনা পরীক্ষার ফল হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশনে চলে যান তিনি। যাবতীয় শুটিং বাতিল করে দেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। এখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ। তবু সচেতন থাকতে ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘৪ তারিখ যখন জানতে পারি যে আমি আক্রান্ত, তখন থেকে আইসোলেশনে চলে যাই, সব শুটিং বাতিল করি। সেদিন থেকেই ওষুধ খেতে শুরু করি। আসলে সচেতনতার কোনো বিকল্প নাই। অজ্ঞাত এ রোগ নিয়ে এতটুকু অবহেলা করা যাবে না। আমি তো টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছিলাম। যদি কেউ মনে করে যে টিকা নিলে আর করোনায় আক্রান্ত হবেন না, সেটা ভুল। আমি মনে করি, করোনা থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র হচ্ছে সচেতন থাকা। সাধারণ মানুষসহ শিল্পীসমাজের জন্য আমার পরামর্শ, নিজ বাড়িতে নিরাপদে থাকুন।’

অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি প্রার্থী শহীদুজ্জামান সেলিম

শিল্পীরা বাড়িতে অবস্থান করলে শুটিং বন্ধ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে বহু শিল্পী শুটিং বন্ধ করে দিয়েছেন। ঈদের অনুষ্ঠানের কী হবে? এ প্রসঙ্গে অভিনয়শিল্পী সংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘হুট করে শুটিং বন্ধ করা যাবে না। যদি অন্য সেক্টরগুলো বন্ধ করা হতো, তাহলে আমরাও শুটিং বন্ধ করতাম। হুট করে গণপরিবহন বন্ধ করায় মানুষের কিন্তু চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আমরাও গত বছর হুট করে শুটিং বন্ধ করে বিপদে পড়েছিলাম। মানুষ যখন বাসায় থাকবে, একঘেয়ে বোধ করবে, তখন টেলিভিশনে নতুন কিছু অনুষ্ঠান কিন্তু লাগবে। ফলে আমাদেরও শুটিং চালিয়ে যাওয়া দরকার। তবে জীবনের চেয়ে শুটিং বড় নয়। ভালো হয়, যদি খুব সতর্কতার সঙ্গে তাঁরা শুটিংয়ে অংশ নেন। মানুষ যেমন বাড়িতে সতর্ক থাকে, শুটিং ইউনিটকে তেমন বাড়ি মনে করে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করা উচিত। দূরত্ব বজায় রেখে, দূরে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলা উচিত।’

‘রাত জাগানিয়া’ নাটকে শহীদুজ্জামান সেলিম। ছবি: সংগৃহীত

করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দী সেলিম পড়েছেন একগুচ্ছ বই। অবিরাম পড়েই চলেছেন। গত বছরও বেশ কিছু বই কিনে রেখেছিলেন, সময়ের অভাবে সেসব পড়তে পারছিলেন না। কী কী বই পড়ছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি যে বইগুলো পড়ছি, সেগুলো এ বছরের বেস্টসেলার। মহিউদ্দিন আহমদের “প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান” ও “লালসন্ত্রাস”—বই দুটি সম্প্রতি পড়েছি। রক্ষীবাহিনী নিয়ে আনোয়ার উল আলমের লেখা “রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা”, আলতাফ পারভেজের “মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী”, সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাসমগ্র পড়তে শুরু করেছি। গত দুই বছর যে পরিমাণ বই কেনা আছে, সেগুলো সময়ের অভাবে এত দিন পড়তে পারিনি। এগুলো এখন বসে বসে পড়ছি।’ পাঠতালিকার বেশির ভাগই রাজনৈতিক বই কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক বই ও ইতিহাসের পটভূমিতে লেখা বই পড়তে পছন্দ করি। আগেও এ ধরনের বই পড়তাম। আমাদের সময়ে এমন সব রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেছে, সেসব নিয়ে কখনো কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। ফলে তখন আমার অনেক কিছুই জানা হয়নি। এই বইগুলো পড়ে আমি তখনকার নানা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি। তখন মনে হতো, এটা কী হচ্ছে, কেন হলো, লাভটা কার বা ক্ষতি হলো কোথায়? চাইলে বাবার সঙ্গে আলাপ করতে পারতাম। কারণ, তিনি রাজনীতিসচেতন মানুষ ছিলেন। কিন্তু কেন যেন করা হয়নি। এখন মনে হচ্ছে, এসব প্রশ্নের উত্তর জানা খুব জরুরি। মাত্র ৯ মাসে একটা দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু স্বাধীন তো আর হঠাৎ হয়নি। ঘোষণা দেওয়ামাত্র দেশ স্বাধীন হয়নি। দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল, দেশভাগের পর থেকেই যে প্রস্তুতি, একাত্তরে গিয়ে সেটি বিরাট যুদ্ধে রূপ নেয়। যুদ্ধটা এত দ্রুত কেন শেষ হলো? আর্তসামাজিক অবস্থার কী কী পরিবর্তন হলো? অর্থনৈতিক কতটা ক্ষতি হলো? এত দল–মত কেন? এগুলো জানা খুব জরুরি ছিল। ঘটনাগুলো আমাকে খুব ব্যথিত করে। যখন রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, তখন নেতাদের কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইনি। হয়তো সংকোচ বা সংশয়ে, ওই সময়ের রাজনীতিতে ওটা বোধ হয় করা যেত না বা তাঁদের কাছাকাছি যেতে পারিনি। যাঁদের কাছাকাছি ছিলাম, তাঁরাও হয়তো ততটা জানতেন না। এখন যখন আমি জানছি, আমার কাছে নতুন নতুন সব দিক খুলে যাচ্ছে।’

শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকী

শহীদুজ্জামান সেলিম জানান, রাজনীতি করতে গিয়ে জেল খাটতেও হয়েছে তাঁকে। সেটা সামরিক শাসক এরশাদের আমলে। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘এখন যাঁরা রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা কেউ রাজনীতির মানুষ নন। অথচ আমাদের মতো রাজনীতি করা মানুষের কোনো জায়গা না আছে রাজনীতিতে, না আছে সংস্কৃতিতে। যেহেতু থিয়েটার করেছিলাম, সেখানেই একটা জায়গা তৈরি হয়েছে, পরিচিতি তৈরি হয়েছে। এখনো সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছি। জেনে না–জেনে অনেকে রাজনীতিতে আসছে।’ রাজনীতিতে ফিরবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতির লোক, যেতে তো হবেই। নিজের দেখা ও জানা সত্যগুলো মানুষকে জানাতে হবে।’