এক ঘণ্টার একটি নাটকের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে, তার প্রায় ৭০ শতাংশ টাকাই মাত্র দুজন তারকার পারিশ্রমিক হিসেবে গুনতে হচ্ছে প্রযোজকদের। বাকি ৩০ শতাংশ টাকা দিয়ে নাটক বানাতে হিমশিম খাচ্ছেন বেশির ভাগ নির্মাতা। নাটকের গল্পে দুজন তারকার বাইরে দু–একজন সহশিল্পী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নাটক নির্মাণে আপস করছেন অনেক নির্মাতা।
নাটকের বাজেট কমছে। বাড়ছে কেবল কেন্দ্রীয় চরিত্রের পারিশ্রমিক। আর বাজেট কম হওয়ায় বেশির ভাগ নাটকের গল্প আটকে থাকছে শোবার ঘর, অফিসকক্ষ ও পার্কের বেঞ্চিতে। নাটক হয়ে যাচ্ছে পরিবারহীন। টিভি নাটক পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টর্স গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, ‘৫ বছর আগেও যে নাটকের বাজেট ছিল তিন লাখ টাকা, সেই নাটকের বাজেট এখন কমে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ থেকে এক লাখ আশি হাজার টাকায়। নাটকের দাম কমলেও তারকাদের পারিশ্রমিক বেড়েছে ৩ থেকে ৪ গুণ পর্যন্ত। একটি নাটকের যে বরাদ্দ, তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ টাকা চলে যাচ্ছে তাঁদের সম্মানী দিতে।’
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তারকাদের পারিশ্রমিক দিতে নাটকের আত্মীয়স্বজন, গৃহকর্মী, প্রতিবেশীর চরিত্রগুলো গল্প থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে বাংলা নাটক ক্রমে পরিবারকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে পড়েছে অনেক দিন আগেই। এ প্রসঙ্গে অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, ‘যাঁর চাহিদা আছে, তাঁর পারিশ্রমিক বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটা অন্য সময়েও ছিল। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের নাটকের বাজেট অনেক কম। নাটকের বাজেট বাড়াতে হবে, তা না হলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির গল্পগুলো হারিয়ে যাবে।’
অনেকেই বলছেন, টেলিভিশন চ্যানেল নাটকের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছে নিজেদের চাংক (অনুষ্ঠান প্রচারের সময়) বিক্রি করে দিচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ক্রেতা প্ল্যাটফর্মগুলো একই ঘরানার গল্প, চরিত্র, পোশাক, লোকেশনের বাছ-বিচার না করে ‘ভিউ’-এর আশায় তাদের সুবিধামতো তারকাদের নিয়ে নাটক বানাচ্ছে। ফলে একই তারকারা ঘুরেফিরে বারবার পর্দায় ফিরে আসছেন। এ সমীকরণের কথা জানালেন প্রযোজক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজু মনতাসীর। অন্যদিকে বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আকন্দ বলেন, ‘আমাদের টিভি নাটকের পার্টনার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো। নাটক নির্মাণে ব্যয় করা টাকার একটি বড় অঙ্ক তাদের তুলতে হয় অনলাইন ‘ভিউ’ থেকে। ফলে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় তারকাদের নিয়ে নাটক বানালে মান যাচাই ছাড়া আমাদের আর কিছু বলার থাকে না।’
তারকাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করতে হয় মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, আফরান নিশো, নুসরাত ইমরোজ তিশা, মম, মেহ্জাবীন চৌধুরী, তৌসিফ মাহবুব, সাফা কবির ও তানজিন তিশাকে। এ নামগুলো জানিয়েছেন এখনকার সময়ের বেশ কজন ব্যস্ত নির্মাতা, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পী ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এ ছাড়া কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও টিভি চ্যানেলের কর্মকর্তারাও বলেছেন এ নামগুলোই।
অধিক পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রিয় একজন অভিনেতা বলেন, ‘শিডিউল নিতে এসে প্রথমেই নির্মাতা এবং প্রযোজক বলেন, “ভাই বাজেটের কোনো সমস্যা নেই”। আমি নিজেই ভাবি, এত টাকা তাঁরা কোত্থেকে দিচ্ছেন? টাকাটা উঠেই–বা আসছে কীভাবে!’
জনৈক অভিনয়শিল্পী জানান, অনেক নির্মাতা ও প্রযোজক তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে শিডিউলের জন্য অনুরোধ করেন। শিডিউলের অনুরোধ শুনতে দিনে অন্তত ৩০ জন নির্মাতার ফোন ধরতে হয়। অনেক নির্মাতা সেটে এসে বসে থাকেন। প্রযোজকেরা ভিড় করেন। প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও একদিন নিজের মতো করে ছুটি কাটাতে পারেন না।
এ রকম পরিস্থিতিতে কী করতে পারেন একজন অভিনেতা? আরেক অভিনেতা বলেন, ‘অনেকেই শিডিউল নেওয়ার সময় এক রকম গল্প শোনান। শুটিংয়ের আগমুহূর্তে গিয়ে দেখা যায়, চিত্রনাট্য অন্য রকম। একটি শুটিং টিমের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কাজটা করতে হয়। প্রযোজকেরা আমাদের চাহিদা বাড়িয়ে দিলে আমাদের কিছু করার থাকে না।’