পৃথিবীতে সম্ভবত একজন পুরুষই আছেন, যিনি বয়স লুকিয়ে রাখেন। কারণ, তাঁর বয়স বাড়ে না। চিরতরুণ নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদের আজ জন্মদিন। এ বছরও বয়স বাড়েনি তাঁর। কেবল জীবনে যোগ হয়েছে এক অসহায় উপলব্ধি, মানুষ কদিন বাঁচে!
বিগত বছরগুলোতে শিবলী মোহাম্মদের জন্মদিন উদ্যাপন করতেন তাঁর নাচের শিক্ষার্থীরা। আর বাড়িতে আর দশটি বাঙালি পরিবারের মতোই ভালো ভালো সব খাবার রান্না করা হতো, কেক আনা হতো। গত বছরের জন্মদিনের স্মৃতিচারণা করে শিবলী বলেন, ‘গত বছরের এই দিনে কলকাতার নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার সুকল্যাণ ভট্টাচার্যের বাড়িতে ছিলাম। সেখানে শাকিলা (শিল্পী শাকিলা জাফর) এসে আমাকে সারপ্রাইজ দিল। জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইন্দ্রানী হালদার আমাদের খুব ভালো বন্ধু, সে গেল, ঢাকা থেকে নীপা গেল। প্রত্যেকের হাতেই ছিল উপহার। তখনো জানি না, আগামী বছর এ রকম একটা সময় পার করতে হবে।’
আজও হয়তো বাড়ির লোকেরা চাইবে তাঁর জন্মদিনটা ভালোভাবে উদ্যাপন করতে। কিন্তু শিল্পীর মন সায় দেয় না। যখন জন্মদিনের কেকের মোমবাতি নেভাবেন তিনি, হয়তো তখন পাশের বাড়ির কারও জীবনপ্রদীপ নিভছে! এ রকম মহামারির দিনে আনন্দ করতে কোনো শিল্পীই চাইবেন না। বরং এখনো ভূমি দখল, ত্রাণসামগ্রী আত্মসাৎ, ধর্ষণ, দুর্নীতি হতে দেখে অসহায় বোধ করছেন শিবলী মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের জীবন বড়ই অনিশ্চিত। জীবনটা এতই ক্ষণস্থায়ী যে যেকোনো সময় আমরা মরে যেতে পারি। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। স্রষ্টা আমাদের শোধরানোর পথ করে দিয়েছেন। এরপরও যদি মানুষ না শোধরায়, কিছু করার নেই।’
করোনায় অসহায় মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে। তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন এই নৃত্যশিল্পী। অনেকে সরব, অনেকে নীরবে দান করছেন। তবে এখনো বহু মানুষ আছেন, যাঁরা টাকা আঁকড়ে ধরে আছেন। একটা পয়সাও কাউকে দিচ্ছেন না, দেন না। নিজের সবকিছু একাই ভোগ করতে চান! এই মানুষদের প্রতি শিবলী মোহাম্মদের অভিমানের শেষ নেই। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা যে টাকা রোজগার করি, তাতে অসহায় দরিদ্রদের অধিকার আছে। আমার মনে হয়, স্রষ্টা এই উপলব্ধির জন্যই করোনা দিয়েছেন। করোনায় কোটিপতিরা বিদেশ থেকে বড় বড় চিকিৎসক এনেছেন, কিন্তু বাঁচতে পারেননি।’
‘আমি স্বপ্ন দেখি না। কেননা, স্বপ্ন দেখা মূল্যহীন। স্বপ্ন বলতেই মানুষ বোঝে কেবল গাড়ি-বাড়ি-সম্পদ গড়া। অথচ মৃত্যুর পর মানুষ এসব নিয়ে যেতে পারছে না,’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলেন শিবলী। তিনি বলেন, ‘আমি, নীপা, জাহাঙ্গীর ভাইয়েরা মিলে আলাপ করতাম, আমরা নৃত্যাঞ্চলটাকে বড় করে করব। অনেক বড় স্বপ্ন তাঁদের চোখে। কিন্তু আমি কখনোই স্বপ্ন দেখতাম না। আমার মনে হতো, কয় শ বছর বাঁচব? আমরা কি তবে পরিকল্পনা করব না? আমি মনে করি, আমাদের উচিত বর্তমানটাকে সুন্দর করা। যখন চলে যাওয়ার, তখন তো যাবই।’
ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন শিবলী মোহাম্মদের বাবা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে বাবাকে হত্যা করে। তখন অকূল পাথারে পড়ে পুরো পরিবার। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে শিবলী বলেন, ‘তখন অসহায় হয়ে গিয়েছিল আমাদের পরিবার। আমার মা সেলাই করে আমাদের সংসার চালিয়েছেন। আমরা জানি, ক্ষুধার যন্ত্রণা কাকে বলে! আমি মনে করি, যাঁরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেন, চার-পাঁচটা ফ্ল্যাটের মালিক, কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স, তাঁরা গরিবের ক্ষুধার যন্ত্রণা বুঝবেন না।’
করোনার দুর্যোগে বহু মানুষ ঘরে বসে গেছেন, ঘরে বসে আছেন শিল্পীরাও। করোনায় বাঁচার তাগিদে অনেকেই পেশা বদলে ফেলেছেন। নৃত্যশিল্পীদের অনেকে সবজি বিক্রি করছেন, অনলাইনে সালোয়ার–কামিজ বিক্রি করছেন। শিবলী বলেন, ‘আমাদের উচিত তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। একসময় তাঁরা আমাদের আনন্দ দিয়েছেন। এখন তাঁদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না। মানুষের উচিত দরিদ্র, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো। পৃথিবী স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবারও টাকা রোজগার করা যাবে। অর্থ আঁকড়ে থাকার মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সৃষ্টিকর্তাকে শুধু অনুরোধ করতে পারি, আমাকে সুস্থ রাখুন।’
শিবলী মোহাম্মদ বয়স লুকিয়ে রাখতে চান। তাঁর পরিচিতজনেরা চান সেটা উদ্ঘাটন করতে। এ নিয়ে রীতিমতো বিব্রত শিবলী। তিনি বলেন, ‘অনেকে কৌশলে জানতে চান, ম্যাট্রিক কত সালে। আমি বলি, আমি ম্যাট্রিক পাস করিনি! হা হা হা। বয়স বলতে চাই না, কারণ, বয়সের কথা মনে হলেই ভয় করে। তবে ৯৯ হলে বলব, আগামী বছর ১০০।’ অনেক দিন পর নাচের ক্লাস শুরু করতে যাচ্ছেন এই শিল্পী। জানালেন, অনেকটা জীবিকার তাগিদেই শুরু করতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকজন মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে। তা ছাড়া অভিভাবকেরা নাচের ক্লাস শুরু করার অনুরোধ করে যাচ্ছেন।