কলকাতা। ব্রিটিশ ভারতের একসময়ের রাজধানী, বাণিজ্যবন্দর। বিখ্যাত সব স্থাপত্য, হুগলি নদী, হাওড়া ব্রিজ, বামপন্থী আন্দোলন, দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—সব মিলিয়ে বারবার পর্দায় উঠে এসেছে শহর কলকাতার নানান রূপ। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন থেকে শুরু করে অপর্ণা সেন—দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন নিজেদের প্রিয় শহরকে। সম্প্রতি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট কলকাতাকে উপজীব্য করে নির্মিত সেরা ১০ চলচ্চিত্র নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
‘ক্যালকাটা’ (১৯৪৬)
জন ফ্যারো দারুণভাবে অল্প বাজেটের ছবিটিতে নোয়ার ও থ্রিলারের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। কলকাতার প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও আদতে ছবির শুটিং হয়েছে সেট ফেলে। ছবিটিতে ঔপনিবেশিক ভারতে প্রাচ্যবাদী কল্পনা সম্পর্কে কথা বলে। বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও হলিউড যেভাবে প্রায়ই ভারতকে পর্দায় তুলে ধরে, এখানে সেটা দেখা যায়নি।
‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা অবলম্বনে ছবিটি বানিয়েছিলেন বিমল রায়। গল্পটি কৃষক শম্ভু মহেতোকে (বলরাজ সাহনি) কেন্দ্র করে। বেশি অর্থ উপার্জনের আশায় যে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় যায়, যাতে ফিরে এসে শিল্প পুঁজিবাদের গ্রাস থেকে পৈতৃক জমিটি রক্ষা করতে পারে। কলকাতায় শম্ভু রিকশা চালায়। তার মাধ্যমে পরিচালক কলকাতা নামের এক শহুরে জঙ্গলকে উপস্থাপন করেছেন, যেখানে কার্যত শম্ভুর মতো পরিযায়ী শ্রমিকেরা বন্দী। বিমল রায় ছবিটি বানিয়েছিলেন কলকাতার শরণার্থী আন্দোলনের আধারে। ভারতের নিউ ওয়েভ সিনেমার শুরুর দিকে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়।
‘মহানগর’ (১৯৬৩)
প্রযুক্তিগত আধুনিকতার প্রতীক কলকাতা ট্রামওয়ের একটি শট দিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবিটি শুরু করেন। এই ছবিতেই সত্যজিৎ তাঁর নিজের শহর কলকাতার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প বলা শুরু করেছিলেন। যাদের বেকারত্বসহ পরিবর্তিত নানা বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত ছবির প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেন অনিল চট্টোপাধ্যায় ও মাধবী মুখোপাধ্যায়।
‘ক্যালকাটা’ (১৯৬৩)
কলকাতা নিয়ে ফরাসি পরিচালক লুই ম্যালের তথ্যচিত্র। ভারত নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘ফ্যান্টম ইন্ডিয়া’ সম্পাদনা করার সময় ম্যালে আবিষ্কার করেন, তাঁর কাছে কয়েক ঘণ্টার ফুটেজ আছে, যা কলকাতা শহর, জনগণ ও ষাটের দশকের শেষের দিকে যে অস্থিরতা চলছে, তার প্রতি ট্রিবিউট জানাতে পারে। ছবির কিছু অংশে ম্যালের সহকারী ছিলেন মৃণাল সেন। ছবিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশেষ করে দারিদ্র্য, বস্তি ও আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিকে ‘পর্যটকের দৃষ্টিভঙ্গি’ বলে সমালোচনা করা হয়। সমালোচকদের অন্যতম ছিলেন সত্যজিৎ রায়।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০)
সত্যজিতের কলকাতা ট্রিলজির প্রথম ছবি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি যেন রাজনৈতিক সহিংসতার দ্বারা অবরুদ্ধ একটি শহরের প্রতিচ্ছবি। যেখানে সামাজিক সংঘাত, ব্যাপক দুর্নীতি ও বেকারত্ব চলছে। ছবিটি ফটো-নেগেটিভ ফ্ল্যাশব্যাকের মতো প্রযুক্তি নিয়ে নিরীক্ষার জন্য প্রশংসিত হয়। প্রধান চরিত্র অভিনয় করেন ধৃতিমান চ্যাটার্জি।
‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭১)
মৃণাল সেনের কলকাতা ত্রয়ীর প্রথম কিস্তি। বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও সহিংস অবরোধের মধ্যে যেন একটি বিশৃঙ্খল শহুরে ল্যান্ডস্কেপ ছিল ছবিটি। ছবির সিনেমাটোগ্রাফি ছিল যুগান্তকারী। কে কে মহাজনের হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার কাজ, পুরোপুরি অন লোকেশন শুটিং ছবিটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রঞ্জিত মল্লিক।
‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ (১৯৮১)
শশী কাপুর প্রযোজিত এই সিনেমা দিয়ে বাংলা সিনেমায় সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের পরিচালক হিসেবে অভিষেক হয়। ছবির গল্প অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এক স্কুলশিক্ষকের। অপর্ণা সেন নিজের ছবিতে কলকাতায় আটকা পড়া অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, একাকিত্ব ও পিতৃতন্ত্রের মর্মস্পর্শী অন্বেষণ করেছেন। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন জেনিফার কেন্ডাল।
‘কাহানি’ (২০১২)
সুজয় ঘোষের এই ছবিতে কলকাতা এসেছে একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হিসেবে। ‘কাহানি’ কলকাতাকে নির্মাতাদের কাছে আবার জনপ্রিয় করে তোলে। টান টান থ্রিলার ছবিটিতে শহরকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয়, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। দৈনন্দিন জীবন ও রাস্তার নানা ঘটনা গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ছবিটি দারুণভাবে পর্দায় কলকাতার ল্যান্ডমার্কগুলোকে উদ্যাপন করে।
‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী!’ (২০১৫)
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে হিন্দি ছবিটি নির্মাণ করেন দিবাকর ব্যানার্জি। পরিচালক ছবিতে ১৯৪১ সালের কলকাতাকে পুনর্নির্মাণ করেন। এ জন্য কয়েক বছর ধরে কলকাতা নিয়ে গবেষণা করে ছবির টিম। ছবিতে পরিচালক কলকাতাকে চিত্রিত করেন কলকাতার পুরোনো গ্রাফিক নভেলের প্রেরণায়। প্রয়াত সুশান্ত সিং রাজপুত অভিনীত ছবিটি আড়ম্বরপূর্ণ।কলকাতা নিয়ে নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে ভিজ্যুয়ালের দিক থেকে এটি অনেক ছবির চেয়ে এগিয়ে থাকবে।
‘আমি ও মনোহর’ (২০১৮)
পরিচালক অমিতাভ চ্যাটার্জির নির্মাণে সম্মোহিত শহুরে গল্প। ধীরলয়ে বলা ছবিটি আধুনিক কলকাতার দুই একাকী মানুষের গল্প। ছবির অনেকগুলো দৃশ্য রাতে শুট করা। ক্যামেরার বৈচিত্র্যময় কাজের মাধ্যমে পরিচালক শহরকে তুলে ধরেছেন।