গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর দেশ ছেড়ে এখন ভারতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। পরে দেশে বেশ কিছু জায়গায় সহিংসতা হয়। অনেকেই হতাহত হন। ভেঙে ফেলা হয় গুরুত্ব স্থাপনা ও সম্পদ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে এবার মুখ খুললেন কলকাতার অভিনেতা পরমব্রত। তিনি লিখেছেন কলকাতার আনন্দবাজারে।
এর আগে এক মাস ধরে এই অভিনেতা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি। শুরুতে এ প্রসঙ্গে পরমব্রত লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ প্রসঙ্গে শেষ অবধি নীরবতা ভঙ্গ করছি! কারণ, এক মাসের কিছু আগে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলনের ওপর সে দেশের সরকার ক্রমাগত যে আক্রমণ চালিয়ে গেছে, তা ন্যক্কারজনক ও বর্বরোচিত তো বটেই, একচ্ছত্র ক্ষমতার মোহে অন্ধ শাসকের মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দেওয়ার চরম উদাহরণও বটে। আমরা সবাই কমবেশি জানি, এই আন্দোলন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা কেন্দ্র করে শুরু হলেও সরকারের নানা অগণতান্ত্রিক ও একনায়কোচিত পদ্ধতি নিয়ে জমতে থাকা মানুষের রাগ ফেটে বেরিয়ে এই আন্দোলনকে এক বৃহৎ চেহারা দেয়, যা আজ এক চরম পরিণতি পেয়েছে!’
এই আন্দোলনে সরকারের পদত্যাগ যদি ছাত্রদের সর্বশেষ ও একমাত্র দাবি হয়ে থাকে, সেটাকে অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে চান এই অভিনেতা। কিন্তু বেশ কিছু প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন এই অভিনেতা। তিনি মনে করেন, এতে কারও কাছে জনপ্রিয় ও অজনপ্রিয় হতে পারেন।
পরমব্রত লিখেছেন, ‘এক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি দেখলাম একটি পোস্ট দিয়েছেন, “যে মসজিদ থেকে মানুষকে এক হওয়ার ডাক দিয়েছেন, সেই মসজিদ থেকেই সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার ডাক দিন!” আরেকটি পোস্টে পড়লাম, “কালীবাড়ি রক্ষা করছেন মাদ্রাসার ছাত্রেরা।” সত্যিই ভালো লাগল পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসবের প্রয়োজন পড়ছে কেন?’
পরমব্রত আরও লিখেছেন, ‘“বিজয়োল্লাসে মত্ত” কিছু মানুষ দেখলাম বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙছেন, গণভবন লুটপাট করছেন। শুনলাম ৩২ নম্বর ধানমন্ডি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে! কারাগার ভেঙে দেওয়ায় বন্দীরা পালাচ্ছেন। সাবেক শাসক দলের সাংসদদের বসতবাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকি পিটিয়ে হত্যাও চলছে। বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক তথা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মাশরাফির বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়েছে।’
যে আন্দোলনকে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ বা ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়ে ছাত্র ও সাধারণ জনতা এগিয়ে নিয়েছেন, তাঁরা ভাঙচুর লুট করতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন এই অভিনেতা। তিনি লিখেছেন, ‘ওত পেতে থাকা কিছু স্বাধীনতাবিরোধী, কট্টরপন্থী শক্তি আপনাদের এই অসামান্য আন্দোলন হাইজ্যাক করে ফেলছে না তো? আপনার হয়তো বলবেন “কোলাটেরাল ড্যামেজ। কিছু বেনোজল তো ঢুকবেই! মানুষ এত দিনের রাগ একটু তো দেখাবেই!” হয়তো তা-ই। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, আন্দোলন থেকে এদের সরিয়ে রাখা বোধ হয় এই আন্দোলনের স্বার্থেই দরকার!’
পরমব্রত লিখেছেন, ‘আসলে ঘরপোড়া গরু তো! সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় হয়। বারবার শুনছি “বাংলা বসন্ত” বলা হচ্ছে এই মুভমেন্টকে! মনে পড়ছে “আরব স্প্রিং”-এর কথা। আর এ-ও মনে পড়ছে যে সেই বসন্তের ফল অধিকাংশ জায়গায় ভালো হয়নি। কট্টরপন্থী মৌলবাদী শক্তি হাইজ্যাক করেছে সেই মুভমেন্টকে, মধ্যপ্রাচ্য তলিয়ে গেছে গৃহযুদ্ধ ও অশেষ রক্তপাতের গহ্বরে। আমি যে দেশের নাগরিক, সেই দেশেও কিন্তু যন্তরমন্তরে অণ্ণা হজারের সমর্থনে আন্দোলন, ভ্রষ্টাচারবিরোধী আন্দোলন ১০ বছর আগে ডেকে এনেছিল এমন এক শক্তিকে, যার নীতিগত বিরোধিতা আমাদের মতো লোকেরা আজও করে চলেছি! এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ভারতের সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কিন্তু কিছুটা হলেও প্রমাণ করে দিয়েছে, শত মেরুকরণ সত্ত্বেও মানুষ কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়, সংবিধান দ্বারা চালিত হতে চান!’
এই অভিনেতা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য দিনটিকে ‘গৌরবের দিন’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘যে গর্বের আঁচ আমাদের গায়েও এসে লাগছে! নিশ্চয়ই উল্লাসেরও দিন! কিন্তু স্বৈরাচারকে পরাস্ত করার এই আনন্দকে কালিমালিপ্ত হতে দেবেন না! এক ফ্যাসিস্টকে সরিয়ে আরও বড় ফ্যাসিবাদকে জায়গা করে দেবেন না! গণতন্ত্রকামী এই আন্দোলনকে সসম্মান গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠা দিন, শুধু গলার জোরে! গায়ের জোরে নয়।’
এর মধ্যে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, এমন সরকার ছাড়া কোনো সরকার তাঁরা মানবেন না। তাঁরা জাতিধর্ম-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক দিয়েছেন! প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও একে স্বাগত জানিয়েছেন পরমব্রত।
পরমব্রতর ভাষ্য, ‘ঢাকার শাহবাগ বা টিএসসিতে আমার যেসব বন্ধু উৎসবে মেতেছেন, তাঁদের ক্ষুণ্ন করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই! বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মানুষই তৈরি করবেন। সেটাই উচিত এবং সেই সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নিশ্চয়ই নেই। করতে আমি চাইও না! আমি ভারতীয়। কিন্তু যাঁরা আমাকে চেনেন, বিশেষত আমার বাংলাদেশের বন্ধুরা, তাঁরা জানেন, আমার কাছে আমার “বাঙালি” পরিচয়টা কতটা গর্বের! বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আর পাঁচজন ভারতীয়ের মতো “পেশাদার” তো নয় বটেই, আর পাঁচজন পশ্চিমবঙ্গবাসীর মতোও নয়! সম্পর্কটি অনেক বেশি আত্মিক এবং প্রকৃত অর্থে আত্মীয়তার! টানটা নাড়ির! তাই হয়তো একটু অনধিকারচর্চাই করে ফেললাম! মাফ করবেন!’