তাপস পাল। ছবি: ফেসবুক থেকে
তাপস পাল। ছবি: ফেসবুক থেকে

তাপস পাল: শেষটা ভালো হয়নি নায়কের

তথাকথিত নায়কের বাইরে সরল-শান্ত চেহারা আর অভিনয়দক্ষতা দিয়ে দর্শকমন জয় করেছিলেন ভারতের চলচ্চিত্র অভিনেতা তাপস পাল। আশি-নব্বই দশকে দুই বাংলাতেই তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। আজ এই অভিনেতার প্রয়াণদিবস। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।

তাপস পাল l আইএএনএস

ভারতের, বিশেষ করে কলকাতার বাণিজ্যিক সিনেমার পরিচালকেরা তাপস পালকে বারবার এমন সব চরিত্রের জন্য নির্বাচন করছিলেন, যা বাংলার তথাকথিত নায়কের মতো নয়; বরং স্বাভাবিক, সারল্যই তাপস পালের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। যে কারণে তাঁর একের পর এক পারিবারিক গল্পের ছবি হয়ে উঠেছিল আশি ও নব্বই দশকের সুপারহিট বাণিজ্যিক সিনেমা।

১৯৫৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হুগলির চন্দননগরে জন্ম নেন তাপস পাল। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। কলেজজীবনে মাত্র ২২ বছর বয়সে অভিনয়জগতে পা রাখেন। তাঁর অভিনয়দক্ষতা ছিল ব্যতিক্রমী। তাঁর এই অভিনয়দক্ষতাকেই কাজে লাগান খ্যাতনামা পরিচালকেরা। বাংলা চলচ্চিত্রের তথাকথিত নায়কদের মতো সুদর্শন, ভালো নাচ, মারপিট জানার বিপরীতে সরল চেহারা তাপস পালকে করে তোলে অনন্য। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় একের পর এক পারিবারিক গল্পের চলচ্চিত্র।

প্রেম, অভিমান, অনুরাগ এবং প্রয়োজনে হালকা মারপিট ছিল তাপস পালের সিনেমার বৈশিষ্ট্য। একদিকে নিপাট সারল্য, অন্যদিকে ক্লাইমেক্সে পৌঁছে বীরত্ব প্রদর্শন করে নায়িকাকে উদ্ধার—এমন বহু দৃশ্যে তিনি অভিনেতা থেকে তারকা হয়ে উঠেছিলেন। তবে এখানে শেষ নয়, বাণিজ্যিক সিনেমার এই তারকাকে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো বিকল্পধারার পরিচালকও। তাপস পাল নিজেকে মেলে ধরেছিলেন ‘উত্তরা’ বা ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’-এর মতো সিনেমায়। যেখানে তাঁর চরিত্র ছিল ছোট, অভিনয় ছিল অসামান্য।

তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘দাদার কীর্তি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তাপস পাল সিনেমাজগতে পা রাখেন। এরপর ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘সাহেব’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’সহ বেশ কিছু হিট ছবি তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। অভিনেতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশেও সমান জনপ্রিয় ছিলেন। ‘সাহেব’ ছবির জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান।

তাপস পাল

বাংলার পাশাপাশি তাপস পাল অভিনয় করেছেন হিন্দি ছবিতেও। একসময় তিনি তৎকালীন বোম্বেতেও গিয়েছিলেন অভিনয়ের সূত্রে। ১৯৮৪ সালে হীরেন নাগের ‘অবোধ’ সিনেমায় তাঁর বিপরীতে নায়িকা ছিলেন মাধুরী দীক্ষিত। রাখি গুলজারের সঙ্গেও অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। একসময় তরুণ মজুমদারের ডাকে আবার কলকাতা ফিরে এসে দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেন ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ ছবিতে। ১৯৮৫ সালের ওই ছবি বক্স অফিসে বিপুল সাফল্য এনে দেয়।
বাংলা ছবিতে তৈরি হয় দেবশ্রী-তাপস সফল জুটি। ‘অর্পণ’, ‘সুরের সাথী’, ‘সুরের আকাশে’, ‘নয়নমণি’, ‘চোখের আলোয়’, ‘তবু মনে রেখো’ তাপস পালের বাণিজ্যিক সফল সিনেমা।

জনপ্রিয়তার সূত্রে একসময় রাজনীতিতেও নামেন তাপস পাল। ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের মনোনয়ন পেয়ে কৃষ্ণনগর লোকসভা কেন্দ্রের সংসদ সদস্য হন। অবশ্য নানা মন্তব্যকে ঘিরে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।

ভক্তরা এভাবেও বলেন, ‘দাদার কীর্তি’র গোবেচারা নিপাট ভালো ছেলেটি হয়ে শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি তিনি। বরং জীবনের শেষ কয়েক বছরে তাঁর জীবনের চিত্রনাট্য উল্টো দিকে ঘুরেছে দুঃখজনক ভাবেই। ভারতীয় অর্থলগ্নি সংস্থা রোজ ভ্যালির সঙ্গে জড়িত তাপস পাল বেআইনিভাবে অনেক টাকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। বেশ কিছুদিন ভুবনেশ্বরে সিবিআই হেফাজতে তিনি বন্দীও ছিলেন। রাজনৈতিক সভায় ‘ধর্ষণের হুমকি’ দিয়ে সমালোচিত হন তিনি। তাঁর নেতিবাচক ভিডিও ভাইরাল হয়। সে সময় তার জনপ্রিয়তা তলানিতে ঠেকে।

তবে সব ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত অভিনয়ের চেনা জগতে আবার ফিরতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফেরা হয়নি, চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুর পর সে পশ্চিমবঙ্গের বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর মন্তব্য করেছিলেন, ‘তাপস পাল রাজনীতির লোক ছিলেন না। তাঁর জনপ্রিয়তাকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়েছিল।

যেভাবে তিনি বিতর্ক এবং অভিযোগে জড়িয়েছিলেন, তাতে অসৎসঙ্গে সর্বনাশ কথাটা হয়তো বলা যায়।’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের ভাষ্য ছিল, ‘অসময়ে, কষ্টদায়কভাবে তাপসকে বিদায় নিতে হলো। যাঁদের হয়ে রাজনীতি করতে গিয়েছিলেন, তাঁরা যে পরিস্থিতিতে তাঁকে ফেলেছিলেন, তাপস হয়তো তারই শিকার।’ রাজনীতির শিকার হোক আর নিজের দোষে হোক, সব মিলে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, শেষটা ভালো হয়নি এই নায়কের।