গত বুধবার পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পেয়েছে সৃজিত মুখার্জির ছবি পদাতিক। ছবিতে মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমগুলো সিনেমাটি ও চঞ্চলের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
‘পদাতিক’কে প্রয়াত নির্মাতা মৃণাল সেনের বায়োপিক বলা হলেও, সমালোচকেরা বলছেন সিনেমাটি আদতে তা নয়; বরং এটি মৃণাল সেনের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আর সেই সময়ের নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে নির্মিত। ছবিতে মৃণাল ছাড়াও আছে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক চরিত্রও!
সিনেমাটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক সংবাদ প্রতিদিনের অনলাইন সংস্করণে রিভিউ ছাপা হয়েছে। সেখানে সিনেমাটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘মৃণাল সেন হিসেবে চঞ্চল চৌধুরী ও পরিচালক–পত্নী গীতা সেনের চেহারায় মনামী ঘোষ ক্যামেরার সামনে আসার পর ধারাবাহিকভাবে মৃণাল সেনের জীবনের ট্র্যাকে ছবিটি ফিরে আসে। একের পর এক তাঁদের দাম্পত্যজীবনের খুঁটিনাটির সঙ্গে জড়িয়ে যায় উত্তমকুমারকে নিয়ে প্রথম ছবি রাতভোর বানানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে নিজের মতো করে বাইশে শ্রাবণ তৈরির কিঞ্চিৎ আনন্দ প্রাপ্তির মুহূর্তও। একদিকে তাঁদের ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য লড়াই, অন্যদিকে নিজের মনের মতো সিনেমা বানানোর সংগ্রাম চলতে থাকে। এই পর্বে সৃজিতের চিত্রনাট্য অনেক বেশি সুগ্রন্থিত। চিত্রায়ণেও আনতে পেরেছেন মৃণাল সেন ঘরানার ন্যারেটিভ ভাঙার ভঙ্গি।’
সংবাদপত্রটির মতে, ছবির আকর্ষণীয় দৃশ্য হলো, মৃণাল সেনের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ছবি নিয়ে দীর্ঘ ও বন্ধুত্বপূর্ণ অথচ তার্কিক আলোচনা। মৃণাল সেনের বাড়িতে ঢুকে ক্ষুধার্ত ঋত্বিকের খাওয়ার দৃশ্যটি। অভিনয় নিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘অভিনয়ে চঞ্চল চৌধুরী ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। তবে তাঁর মেকআপে সেটি বজায় থাকেনি। সত্যজিতের চরিত্রে জীতু কমল অপরাজিত ছবির মতোই। গীতা সেনের চরিত্রে মনামী ঘোষ মধ্যবিত্ত গৃহবধূর মেজাজটি ফুটিয়েছেন। ছবির বিভিন্ন জায়গায় মৃণাল সেনের ছবির অংশগুলোর ব্যবহার অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত, প্রাসঙ্গিক। অতীত ও বর্তমান যেন এক সমান্তরাল সময়ের ইঙ্গিত দিতে চায়। বেশ শিল্পসম্মত অংশগুলোর নির্বাচন।’
‘পদাতিক’ নিয়ে রিভিউ প্রকাশ করেছে আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন সংস্করণও। তারা ছবিটিকে ১০-এ রেটিং দিয়েছে ৭। সিনেমাটি সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, ‘খুব সহজ ছিল না কাজটি। কারণ, একদিকে অভিনবত্ব রয়েছে এই ছবির দুই মূল অভিনেতা কোরক সামন্ত আর চঞ্চল চৌধুরীকে একেবারে কলকাতার আমজনতার মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে এসে উপস্থাপন করায়। অন্যদিকে ন্যারেটিভ চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে এই দুই অভিনেতার অভিনীত চরিত্রগুলোকে মৃণাল সেন পরিচালিত ছবিগুলোর সিকোয়েন্সে মিলিয়ে দেওয়া। এর সঙ্গে আরও একটি দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করলেন সৃজিত। মৃণাল সেনের জীবনের সঙ্গে তাঁর পরিচালিত ছবির দৃশ্যায়নকে মিলিয়ে দিলেন তিনি। তবে এ কথা ঠিক, এই ত্রিবিধ মেলবন্ধনে যে ছবি গড়ে উঠেছে, সেই ছবিকে বুঝতে হলে মৃণাল সেনের ছবিগুলো আত্মস্থ করে আসা প্রয়োজন। না হলে এ ছবির বেশ কিছু টুইস্ট থেকে দর্শক রসবঞ্চিত হবেন।’
অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘মৃণাল সেনের চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী তাঁর যথার্থতা প্রমাণ করেছেন অনায়াসেই। কিন্তু জীতু কমলের পুনরাবৃত্তি ও সত্যজিতের কণ্ঠস্বরের অহেতুক অনুকরণ কেমন যেন কানে বাজছে। সস্তার ক্লোন এবং প্রোটোটাইপ চরিত্র থেকে মৃণাল সেন বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন সব সময়। সৃজিত সেটা করতেই পারতেন। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের বেশ কিছু উপস্থিতি সংক্ষিপ্ত হতে পারত ছবিতে। বরং সত্যজিৎ-মৃণালের রসিকতার দৃশ্যটি মনোগ্রাহী।’
সিনেমাটির প্রশংসা করেছে কলকাতার আলোচিত তিন ইউটিউব চ্যানেল অরিত্রস জ্ঞান, রূপমস রিভিউ ও আর্টিস্টিক সেভেন সেন্স। অরিত্রস জ্ঞান চ্যানেলের অরিত্র নিজের ভিডিওতে বলেছেন, ‘চঞ্চল চৌধুরী পুরো পর্দার মধ্যে ঢুকে গেছেন। তিনি দুর্দান্ত কাজ করেছেন। কঠিন দৃশ্যগুলো তিনি অনায়াসে করেছেন।’
সাম্প্রতিক সময়ের সৃজিতের সেরা কাজ উল্লেখ করে রূপম বলেন, ‘ছবিতে চঞ্চল চৌধুরীর পারফরম্যান্স দারুণ। তাঁর উচ্চারণ, তাঁর কথা বলা, তাঁর ভেঙে পড়া—এটা যেভাবে তিনি করেছেন, সেটা দুর্দান্ত। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, বারান্দার ছেলের সঙ্গে নিজের যে না বলা কথা ভাগাভাগির চেষ্টা—এই দুটো দৃশ্য আপনি ভুলতে পারবেন না।’
আর্টিস্টিক সেভেন সেন্স চ্যানেলের সাগরনীল বলেন, ‘পরিচালক হিসেবে, মানুষ হিসেবে মৃণাল সেনের দর্শনের সঙ্গে আপনি যদি পরিচিত হন, তাঁর সিনেমা যদি আপনার দেখা থাকে; তাহলে “পদাতিক ”আপনার ভালো লাগবে।’