চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদে উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গ। আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়েছে গোটা ভারতে। এর মধ্যে দক্ষিণ ভারতে ‘মি টু’ ঝড়ের তদন্ত প্রতিবেদন, তথা হেমা কমিটির চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসতেই আবারও নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। মালয়ালম চলচ্চিত্রশিল্পের বাঘা বাঘা তারকাকে নিয়ে আসছে ভয়ংকর সব যৌন নিপীড়নের তথ্য। হেমা কমিটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন সে দেশের বিনোদনজগতের মানুষেরা। দক্ষিণকে অনুসরণ করল টলিউড। অভিনেত্রীদের সঙ্গে হওয়া যৌন হেনস্তা দমনে হেমা কমিটির আদলে ‘সুরক্ষা কমিটি’ খুলেছে টলি ফেডারেশন। এ কমিটিতে অভিযোগ জানানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সুপরিচিত চলচ্চিত্র পরিচালক অরিন্দম শীলের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করল সেখানকার পরিচালকদের সংগঠন ‘ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’।
এনডিটিভি, আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্র বলছে, ই-মেইল মারফত অরিন্দম শীলকে এই বরখাস্তের নোটিশ পাঠানো হয়েছে। পরিচালকের সদস্যপদ সংখ্যা ১৯৩। তা উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, পরিচালকের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ উঠেছে। যার প্রাথমিক প্রমাণ রয়েছে এবং তা অত্যন্ত উদ্বেগের। এমন অভিযোগ সংগঠনের পক্ষে ক্ষতিকর।
সেই কারণেই ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিচালককে সাসপেন্ড করা হচ্ছে, অথবা যত দিন না পর্যন্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে, তত দিন এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলেই জানানো হয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইনকে ‘ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’র সভাপতি সুব্রত সেন বলেছেন, ‘“সুরক্ষা বন্ধু” কমিটি ঘোষণার পরই আমরা জানিয়েছিলাম, পরিচালকদের বিরুদ্ধে তথ্য–প্রমাণসহ অভিযোগ এলে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’ উল্লেখ্য, দিনকয়েক আগে বাংলা বিনোদন দুনিয়ার এক অভিনেত্রী অভিযুক্ত পরিচালকের বিরুদ্ধে অশালীন আচরণের অভিযোগ এনে নারী কমিশনের দ্বারস্থ হন।
সুব্রত ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার অনলাইনকে আরও বলেন, ‘নারী কমিশনের থেকে অভিযোগ আসার পরই আমরা বিষয়টি নিয়ে সবাই আলোচনায় বসি। সবার সম্মতিতে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’ সেই অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিচালকের বিরুদ্ধে এই বিশেষ নির্দেশ কার্যকর হবে। যে দিন তিনি ‘নির্দোষ’ হিসেবে লিখিত বার্তা পাবেন, সে দিন থেকে আবার আগের মতো কাজ শুরু করতে পারবেন, জানিয়েছেন সুব্রত। অরিন্দমের নাম উল্লেখ না করে এ-ও জানিয়েছেন, ‘এরপরও পরিচালক যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান বা তাঁর সঙ্গে যদি কোনো প্রযোজক কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে কোনো বক্তব্য থাকবে না সমিতির।’
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে কথা বলেছেন পরিচালক। দৃশ্য বোঝাতে গিয়ে অভিনেত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করার অভিযোগে তিনি দাবি করেন, বিষয়টি ‘একটি খুনির সন্ধানে’ সিনেমার সেটে হয়েছে। সাহেব ও অভিযোগকারী অভিনেত্রীকে তিনি একটি ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তা একটি ‘চিট শট’ ছিল। পরিচালক শট বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর ভাষায়, সেই সময় ‘অ্যাক্সিডেন্টালি’ একটা ঘটনা ঘটে। আর সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃতভাবেই হয়েছিল। তখনো এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। সেই সময়ে চিত্রগ্রাহক থেকে শুরু করে সেটের বাকি সবাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অভিনেতা সাহেব চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। পরিচালক আরও জানান, তিনি শুক্রবার নারী কমিশনে গিয়ে কথা বলেছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর অনিচ্ছাকৃত কোনো আচরণের জন্য অভিনেত্রী যদি অপমানিত হয়ে থাকেন, তার জন্য তিনি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী, ‘আমার সহকারী পরিচালক ও ক্যামেরাম্যান এবং সুরিন্দর ফিল্মসের সদস্যরা সাক্ষী হিসেবে আছেন। কিন্তু ডিরেক্টরস গিল্ড আমার সঙ্গে কথা না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ পরিচালক জানান, অনিচ্ছাকৃতভাবেই যে ঘটনা ঘটেছে, তা তিনি লিখিতভাবেই দিতে যাচ্ছিলেন। তাতে অভিনেত্রী রাজি ছিলেন না। তখন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুরোধে তিনি অনিচ্ছাকৃত শব্দটি বাদ দেন। সেটিই এখন তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিচালক জানান, বিষয়টি আইনজীবীদের সঙ্গে তিনি আলোচনা করবেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন।
এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকজন শিল্পী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও লেখালেখি হচ্ছে। ফেসবুকে অভিনেত্রী স্বস্তিকা লিখেছেন ঠিক এভাবে, ‘পাপের ঘড়া উলটায়। ভেবেছিলাম বোধ হয় নিজের জীবনে দেখে যেতে পারব না। ভগবান, তুমি এই কথাটুকু যে রেখেছ, এ–ই অনেক। ২০ বছর সময় লাগল, সে লাগুক। আমাদের জগতের সমস্ত মেয়েদের বলছি, সময় এসেছে সম্মান দখল করার। আর ভয় নয়। গলা তুলে, আঙুল তুলে চিৎকার করে নোংরা লোকগুলোর মুখোশ টেনে ছিঁড়তে হবে। সবাই বেরিয়ে এসো। হাত ধরে একসঙ্গে সোচ্চার হই। এটা আমাদের মৌলিক অধিকার।’ স্ট্যাটাসের সঙ্গে তিনি পরিচালক সমিতির সভাপতি সুব্রত সেনের চিঠি যুক্ত করে দেন।
প্রসঙ্গত অরিন্দম শীল একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক। তাঁর পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো ‘আবর্ত’, ‘এবার শবর’, ‘হর হর ব্যোমকেশ’ ও ‘ঈগলের চোখ’।