এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর কথাগুলো তিনি যেভাবে বলতেন, সেই সময়ের গণমাধ্যমগুলোতে ঠিক সেভাবে কথাগুলো প্রকাশ করা হতো না। অনেক সময় কথাগুলোর অন্য অর্থ হতো। এভাবে তিনি প্রথম গণমাধ্যম থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তিনি মনে করতেন, তাঁর যৌবনের সিনেমাগুলো দেখে দর্শকেরা সন্তুষ্ট থাকুক। এসব কারণে শেষ বয়সে তিনি কাউকে ছবি তুলতে দেননি। নিকটাত্মীয় ছাড়া কেউ তাঁর দেখা পাননি। একসময় রুমে তালা মারার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এসব কারণেই হয়তো তিনি এখনো ভক্তদের কাছে মহানায়িকা হয়েই আছেন। বলছি সুচিত্রা সেনের কথা। পাবনায় বেড়ে ওঠা রমার আজ ৯২তম জন্মবার্ষিকী।
কিংবদন্তি এই নায়িকার চক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার প্রস্তুতিটা কি সিনেমা ছাড়ার আগে নাকি পরে? এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে তাঁকে নিয়ে লেখা বইগুলো থেকে জানা যায়, তিনি কখনো স্টেশনে তেল নেওয়ার সময় গাড়ি থেকে বের হতেন না। কারণ, ওখানে সবাই তাহলে তাঁকে দেখে ফেলবে। তিনি বলতেন, ‘সবাই যদি আমাকে বিনা খরচেই দেখে ফেলে, তাহলে আর টাকা খরচ করে টিকিট কেটে হলে কেন দেখতে যাবে।’ এটা বলাই যায়, তিনি অনেক আগে থেকেই চেয়েছিলেন, দর্শকের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে। শেষের দিকে শুটিং ইউনিটেও কাজ ছাড়া মেকআপ রুম থেকে তেমন বের হতেন না।
বালিগঞ্জের নিজস্ব বাসায় শেষ বয়সের দিনগুলো কাটিয়েছেন ভক্তের মনে জায়গা করে নেওয়া এই চলচ্চিত্রের মহারানি। তাঁর দেখাশোনার জন্য পরিচারিকা ছিলেন। তাঁদেরকেও মেনে চলতে হতো কড়া নিয়ম। একসময় বয়সের ভারে চলাফেরা করতে পারতেন না। কিন্তু বাড়ির আশপাশে থাকত দর্শক, সাংবাদিকদের ভিড়। তাঁদের আশা, একনজর প্রিয় নায়িকাকে দেখা, ভালো লাগার কথা বলা। পর্দার সেই নায়িকা কেমন আছেন? কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি। সেই সময় শুধু তাঁর একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন, নাতনিরাসহ নিকটাত্মীয়রাই একমাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেতেন। তাঁদের মাধ্যমে জানতে পারতেন, মিডিয়ার কাছের কিছু মানুষ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু সুচিত্রার এককথা, তিনি কারও সঙ্গে দেখা করবেন না।
জানা যায়, উত্তম কুমারের মৃত্যুর পরই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন সুচিত্রা। উত্তমের চলে যাওয়ার রাতে সুচিত্রা এসেছিলেন উত্তমকে শেষবারের মতো মালা হাতে বিদায় জানাতে। মহানায়কের গলায় মালা পরিয়ে মন ভার করে সেই যে বাসায় ঢুকলেন, তারপর তিনি আর বের হননি। একাকী জীবন কাটাতে লাগলেন। সেই থেকে বালিগঞ্জের বাসার সুচিত্রার রুমে নিয়ম হয়ে দাঁড়াল, কেউ তাঁর ঘরে এলে জানান দিয়ে আসতে হবে। শোনা যায়, তাঁর ঘরের দরজা তালা দেওয়া থাকত। কী এমন অভিমান ছিল দ্যুতিময় হাসি ছড়ানো এই নায়িকার। সেটা কখনোই জানা যায়নি। এই অভিমানই হয়তো তাঁকে ভক্তদের কাছে চিরযৌবনা করে রেখেছে।
হলিউডের গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে অনেকেই তাঁর তুলনা করেন। গ্রেটাও বেছে নিয়েছিলেন এক অদৃশ্য জীবন। সুচিত্রার মতো লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন তিনি। তবে শুধু এখানেই নয়, তাঁদের আরও মিল ছিল।
মাত্র ২০ বছর বয়সে গ্রেটা ৩৪টি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। তার মধ্যে ৮টি সুইডিশ ও ২৬টি ইংরেজি। অন্যদিকে সুচিত্রা ২৫ বছর বয়সে ৫৩টি বাংলা ও ৭টি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এসব ছবির বেশির ভাগ ছিল ব্যবসাসফল। সুচিত্রার ৫২তম সিনেমা ‘দত্তা’ ২৩ সপ্তাহ সিনেমা হলে চলেছিল। সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়েছিল। ক্যারিয়ারের শেষ অবধি তিনি দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে গিয়েছেন। তাঁর অভিনীত ‘হারানো সুর’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হলো দেরি’, ‘জীবনতৃষ্ণা’, ‘রাজলক্ষ্মী’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রানী’, ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘চাওয়াপাওয়া’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘গৃহদাহ’সহ প্রায় সব সিনেমা সেই কথাই বলে। শেষ জীবনটা তিনি নিজের মতো করে কাটিয়েছেন, এটাও রাজত্বের চেয়ে কম কিসে।
সুচিত্রা সেনের অভিষেক ঘটে ‘শেষ কোথায়’ সিনেমা দিয়ে। তখন তাঁর নাম ছিল রমা সেন। দুই অক্ষরে নায়িকার নাম মানানসই হচ্ছিল না।
পরিচালক সুকুমার দাশ গুপ্তের সহকারী নীতিশ রায় রমা সেনের নাম রাখলেন সুচিত্রা সেন। ১৯৫২ সালের কথা। তখন ‘কাজরী’ ছবির শুটিং চলছিল। এক বছর পরই ১৯৫৩ সালে উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয় করে লাইমলাইটে আসেন সুচিত্রা। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সুচিত্রা-উত্তম জুটি হয়ে ওঠেন খাঁটি বাঙালি প্রেমিক-প্রেমিকার আইকন, বাংলা চলচ্চিত্রের সার্থক নায়ক-নায়িকা ও চিরকালের প্রেমের জুটি। মেধা, যোগ্যতা, এক্সপ্রেশন, সাজসজ্জার পরিমিতি, মার্জিত রুচি এবং চলাফেরায় নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ধরে রাখা—সব মিলিয়ে সুচিত্রা অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
তথ্যসূত্র: ‘দীপ জ্বেলে যাই’, ‘অজানা অচেনা সুচিত্রা সেন’, ‘চিরদিনের সুচিত্রা সেন’, ‘সুচিত্রা সেন’সহ সুচিত্রা সেনকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই