কলকাতায় গোয়েন্দা সিনেমা কেন এত জনপ্রিয়

আবীর যখন ব্যোমকেশ বক্সী
ফেসবুক থেকে

চলতি শতকের শুরুর দিকে টালিগঞ্জের বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমা দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না। দক্ষিণ ভারতের রিমেক ছবিগুলো কিছুটা ব্যবসা করলেও মৌলিক বাণিজ্যিক সিনেমাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছিল। এ পরিস্থিতিতে যেন ‘আলোকবর্তিকা’ হাতে হাজির হলেন গায়ক, অভিনেতা ও পরিচালক অঞ্জন দত্ত। ২০১০ সালে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীকে পর্দায় হাজির করেন অঞ্জন। সবাইকে চমকে দিয়ে দুর্দান্ত ব্যবসা করে তাঁর সিনেমা ‘ব্যোমকেশ বক্সী’। তখন কে জানত, ছবিটি দিয়ে পরের এক যুগ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমার সুর ঠিক করে দেবেন অঞ্জন। সেই ২০১০ সালে শুরু করে এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে গোয়েন্দানির্ভর সিনেমা মানেই যেন নিশ্চিত হিট। কিন্তু কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা কেবল গোয়েন্দানির্ভর হয়ে পড়ল, সেটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

মিতিন মাসির নতুন ছবিতে কোয়েল

সত্যান্বেষীর জয়
সেই কবে ‘চিড়িয়াখানা’ বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়, তারপর আর সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে সেভাবে সিনেমা হয়নি। তবে ২০১০ সালে ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ সুপারহিট হওয়ায় পরিচালক, প্রযোজকেরা যেন জাদুর কাঠি হাতে পেলেন। এরপর সত্যান্বেষীকে নিয়ে ‘আবার ব্যোমকেশ’, ‘ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা’সহ আরও সিনেমা করেন অঞ্জন। গোয়েন্দানির্ভর সিনেমা নিয়ে যখন এত ব্যবসা হচ্ছে, অন্য প্রযোজক, পরিচালকেরাই–বা বসে থাকবেন কেন। তাঁরাও দলে দলে গোয়েন্দা সিনেমা, থ্রিলারধর্মী সিনেমা তৈরি শুরু করেন।

গোয়েন্দা সিনেমা বানালেই যেহেতু লাভের মুখ দেখা যাচ্ছে, তাই গত এক যুগে পশ্চিমবঙ্গে একের পর এক গোয়েন্দা সিনেমা দেখা গেছে। যাঁরা সেভাবে থ্রিলার বানাতেন না, এমন পরিচালকেরাও ঝুঁকেছেন গোয়েন্দা সিনেমার দিকে। ফল, বড় পর্দায় দেখা গেছে ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা, কাকাবাবু, কিরীটী রায়, শবর, সোনাদা, মিতিন মাসি, একেন বাবুকে। ওটিটিতেও ব্যোমকেশ, ফেলুদা হয়েছে, দেখা গেছে নতুন নারী গোয়েন্দা দয়মন্তীকেও।

সুশান্ত সিং রাজপুতকেও ব্যোমকেশ চরিত্রে দেখা যায়

গত এক যুগে কেবল বাংলায় নয়, হিন্দিতে ব্যোমকেশ হয়েছে। ২০১৫ সালে সুশান্ত সিং রাজপুতকে ব্যোমকেশ চরিত্রে দেখা যায় দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ সিনেমায়। বক্স অফিসে ব্যবসা করতে না পারলেও সমালোচকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছিল সিনেমাটি।

সবচেয়ে বেশি আবীর
গোয়েন্দা হিসেবে পরিচালক, প্রযোজকদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ আবীর চ্যাটার্জিকে। ব্যোমকেশ, ফেলুদা—বাঙালির প্রিয় দুই গোয়েন্দা চরিত্রেই তাঁকে দেখা গেছে। এ ছাড়া করেছেন আরেক গোয়েন্দা সোনাদার চরিত্রও। ২০১০ সালে অঞ্জন দত্তের ছবিতে ব্যোমকেশ হিসেবে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণেই ক্যারিয়ারের পরের দিকে একের পর এক গোয়েন্দা চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে তাঁকে। ব্যোমকেশ হিসেবে পর্দায় সাতবার দেখা গেছে আবীরকে। এ ছাড়া যিশু সেনগুপ্ত ব্যোমকেশ হয়েছেন তিনবার, একবার করে হয়েছেন ধৃতিমান চ্যাটার্জি ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।

‘বাদশাহী আংটি’ ছবিতে ফেলুদা হিসেবে দেখা যায় আবীরকে

২০১৮ সালে নতুন এক গোয়েন্দা সোনাদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। সুবর্ণ সেন ওরফে সোনাদা ইতিহাসের অধ্যাপক। সঙ্গীদের নিয়ে ইতিহাসের গন্ধ আছে এমন জায়গায় ঘুরতে যান, অবধারিতভাবেই সেখানে জুটে যায় রহস্য। এ সিনেমা সিরিজকে ‘ভারতের ইন্ডিয়ানা জোনস’ বলা যেতে পারে। ব্যোমকেশ, ফেলুদার পর সোনাদার চরিত্রেও অভিনয় করেন আবীর। সামনে আবীরকে দেখা যাবে আরেক গোয়েন্দা দীপক চ্যাটার্জির ভূমিকায়।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নানা ধরনের সিনেমায় অভিনয় করলেও শিশুদের জন্য সেভাবে কাজ করা হয়নি, এ আক্ষেপ থেকেই সৃজিত মুখার্জির সঙ্গে ‘কাকাবাবু’ সিরিজে অভিনয় করতে থাকেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি। তরুণ বয়সে তোপসে হয়েছিলেন পরমব্রত। বড় হয়ে ফেলুদার চরিত্রও করেছেন। সর্বশেষ প্রদোষচন্দ্র মিত্রের চরিত্রে তাঁকে দেখা যায় অরিন্দম শীলের ওয়েব সিরিজ ‘সাবাশ ফেলুদা’য়।

‘হত্যাপুরী’ সিনেমার দৃশ্য

এ ছাড়া ফেলুদাকে নিয়ে সর্বশেষ সিনেমা ‘হত্যাপুরী’তে ফেলুদা হয়েছেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। গত এপ্রিলেই দেব জানান, তিনিও ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করবেন। চলতি বছরের পূজায় মুক্তি পাবে দেব অভিনীত ও প্রযোজিত ‘দুর্গ রহস্য’। অন্যদিকে ‘দুর্গ রহস্য’ নিয়েই আবার ওয়েব সিরিজ করছেন সৃজিত মুখার্জি।

সৃজিত মুখার্জির ওয়েব সিরিজে ফেলুদার চরিত্রে দেখা গেছে টোটা রায়চৌধুরীকেও

সৃজিত মুখার্জির ওয়েব সিরিজে ফেলুদার চরিত্রে দেখা গেছে টোটা রায়চৌধুরীকেও। তাঁর অভিনীত দুটি সিরিজ দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছে। মুক্তির অপেক্ষায় আছে আরও দুটি—‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ ও ‘ভূস্বর্গ ভয়ংকর’।

গোয়েন্দা সিনেমা কেন এত জনপ্রিয়
চলতি বছর কোনো বাংলা সিনেমাই সেভাবে ব্যবসা করতে পারছিল না। কিন্তু পয়লা বৈশাখে একেন বাবু সিরিজের নতুন সিনেমা ‘দ্য একেন রুদ্ধশ্বাস রাজস্থান’ দুর্দান্ত ব্যবসা করে। গল্প, অভিনয় যা-ই হোক, গোয়েন্দা সিনেমা হলেই যেন সুপারহিট। সমালোচকেরা বেশির ভাগ গোয়েন্দা সিনেমার যতই সমালোচনা করুন না কেন, বক্স অফিসে তা হিট হয়েছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ সম্ভবত বাঙালির গোয়েন্দা সাহিত্যপ্রীতি। ফেলুদা, ব্যোমকেশ পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম এখনো তাদের প্রিয় চরিত্রগুলোকে পর্দায় দেখতে মুখিয়ে থাকে। একটু ভালো অভিনয় আর ভালো লোকেশনে শুটিং হলেই হলো, পরিবার নিয়ে ছোটে প্রেক্ষাগৃহে।

‘সাবাশ ফেলুদা’র পোস্টার

পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ইউটিউবার অরিত্র ব্যানার্জি মনে করেন, ‘একেন বাবুকে নিয়ে প্রথম সিনেমার প্রেক্ষাপট দার্জিলিং; যেটা আবার ফেলুদার কারণে বাঙালির কাছে এক নস্টালজিয়া। দ্বিতীয় ছবির প্রেক্ষাপট রাজস্থান, যেটিও ফেলুদার কারণে বাঙালির স্মৃতিতে ভালোভাবেই রয়ে গেছে। এ ছাড়া একেন চরিত্রটি তৈরি হয়েছে জটায়ুর প্রেরণায়। একটু থ্রিলার, সঙ্গে কমেডি—সব মিলিয়ে দর্শক দেখেছে।’

ওয়েব সিরিজে ব্যোমকেশ হয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য

পশ্চিমবঙ্গে কেন এত গোয়েন্দা সিনেমা হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে পরিচালক অনিকেত চ্যাটার্জি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, কোনো একটি ছবি হিট হলে প্রযোজকেরা সে ধরনের ছবিই করতে চান। ফলে পরিচালক না চাইলেও সে ধরনের ছবি করতে হয়।

গোয়েন্দানির্ভর সিনেমাগুলো যেভাবে বক্স অফিসে সাফল্য পাচ্ছে; সামনে পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের সিনেমা যে আরও অনেক নির্মিত হবে, সে কথা এখনই বলে দেওয়া যায়।