টালিগঞ্জের এনটি ওয়ান, টেকনিশিয়ান, ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে তালা। নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের চেনা ভিড়ভাট্টাও নেই। স্টুডিওপাড়া সুনসান। টানা দুই দিন ধরে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল টালিউড। গতকাল সোমবার ও আজ মঙ্গলবার কোনো শুটিং স্টুডিওতে গড়ায়নি।
সিনেমা, সিরিয়াল কিংবা ওয়েব সিরিজ—সব ধরনের শুটিং বন্ধ রয়েছে। পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে টালিউডের ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ও পরিচালকদের মধ্যে মতপার্থক্যের জেরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়েছে। কবে শুটিং শুরু হবে, তা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় দিন গুনছেন পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা দেব ও মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। মুখ্যমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘দেখা হলো, কথা হলো, ভালো লাগল।’
এক্সে দেব লিখেছেন, ‘খুব শিগগির সব মিটে যাবে। আশা করছি, বুধবারের মধ্যে শুটিং শুরু হবে। টেকনিশিয়ান, প্রযোজকসহ সিনেমার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।’
তবে বুধবারই শুটিং শুরু হবে কি না, তা এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (আজ সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা পর্যন্ত) আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়নি।
প্রেক্ষাপট
গত বছরের অক্টোবরে কলকাতায় কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেয় ঢাকার ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকি। চরকির ‘লহু’ নামে একটি সিরিজ পরিচালনা করছেন কলকাতার পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়। কলকাতায় শুটিংয়ের জন্য যে ফি দাবি করে করে ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া, তাতে চরকিকে দ্বিগুণ পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হয়। ফলে কলকাতায় দিন চারেক শুটিংয়ের পর ঢাকায় সিরিজের শুটিং করা হয়।
ঢাকায় শুটিংয়ে কলকাতার টেকনিশিয়ানদের না নেওয়ায় পরিচালক রাহুলের ওপর চড়াও হয়েছে টেকনিশিয়ানদের ফেডারেশন। ফেডারেশনের অভিযোগ, রাহুলকে তিন মাসের জন্য বহিষ্কার করে পরিচালকদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ড। পরে ফেডারেশনের অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় বহিষ্কার তুলে নেয় গিল্ড।
এর মধ্যে রাহুলের পরিচালনায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে নিয়ে একটি সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দেয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসভিএফ। এই ঘোষণার পর বেঁকে বসে ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া। ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস ঘোষণা দেন, রাহুলের পরিচালনায় কোনো টেকনিশিয়ান কাজ করবেন না। তবে সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে তিনি কাজ করতে পারবেন।
বাধ্য হয়ে পরিচালক সৌমিক হালদারকে ছবিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয় এসভিএফ। শনিবার সকালে শুটিং সেটে প্রসেনজিৎ, অনির্বাণরা হাজির হয়েছিলেন। পরিচালকের চেয়ারে রাহুলকে দেখে টেকনিশিয়ানরা জানান, রাহুলের পরিচালনায় তাঁরা কাজ করবেন না।
এরপর বিষয়টি আর পরিচালক রাহুলে আটকে থাকেনি। পরিচালকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন; একে একে পরিচালকেরা ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। সোমবার থেকে কর্মবিরতির ডাক দিয়েছে ডিরেক্টরস গিল্ড। বিষয়টি দ্রুত সুরাহার দাবি তুলেছেন অভিনয়শিল্পীরা।
অচলাবস্থার মধ্যে গতকাল অভিনেতা প্রসেনজিতের বাসভবনে টালিউডের পরিচালক ও অভিনেতাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দাবি তোলা হয়, ভুল–বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে শুরু করা হোক স্টুডিওপাড়ায় শুটিং।
এ সভায় ছিলেন পরিচালক গৌতম ঘোষ, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সুজিত সরকার, সুজয় ঘোষ, রাজ চক্রবর্তী প্রমুখ পরিচালক ও তারকারা।
সভায় পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেন, ‘স্টুডিওপাড়ায় একটা অচলাবস্থা চলছে। আমরা এর নিরসন চাই। আমরা চাই নিজেদের মধ্যকার বিবাদ কাটিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে উচ্চ মাত্রায় তুলতে। তাই এই অচলাবস্থা কাটাতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।’
এই নির্মাতা বলেন, ‘দুই পক্ষকেই ভাবতে হবে আমাদের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমরা পারস্পরিক সৌহার্দ্যের আবহে মিটিয়ে নিতে চাই আমাদের সমস্যাকে। আমরা বিভাজনে বিশ্বাস করি না। আমাদের ছোট একটা ইন্ডাস্ট্রি। এখানে কোনো পক্ষ নেই। সবাই আমরা এক।’
ক্ষোভটা পুরোনো
দীর্ঘদিন ধরে ফেডারেশন অব সিনে টেকনিশিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সভাপতির দায়িত্বে আছেন তৃণমূলের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস। তিনি সিনেমার কেউ নন; তাঁর সময়ে ফেডারেশনের সঙ্গে নির্মাতা, শিল্পীদের দূরত্ব বেড়েছে বলে দাবি করেছেন কেউ কেউ।
ফেডারেশনের চাপিয়ে দেওয়া কিছু নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে কয়েকজন পরিচালক ও অভিনেতা। অনেক সময় প্রয়োজন না হলেও অতিরিক্ত টেকনিশিয়ানকে নিয়ে কাজ করতে প্রযোজক ও পরিচালকদের বাধ্য করা হয়। এতে খরচ বাড়লেও মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না প্রযোজকদের। অন্যথায় তাঁদের ওপর চড়াও হয় ফেডারেশন।
বিদেশে শুটিং করতে গেলে ফেডারেশনের ১৬ কিংবা ১৯ টেকনিশিয়ানকে নিতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। অভিযোগের বিষয়ে স্বরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো সাড়া মেলেনি।
চরকি কী বলছে
এক বিবৃতিতে চরকি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রযোজনার মধ্য দিয়ে বাংলা কনটেন্টের মান দিন দিন বাড়ানোর প্রতি বদ্ধপরিকর চরকি। যে দেশেই চরকি প্রযোজনাবান্ধব পরিবেশ পাবে, সেখানেই বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেদওয়ান রনি বলেন, ‘আমরা পুরো বিশ্বের বাঙালিকে এক করতে চেয়েছিলাম। এখনো তা-ই চাই। সহযোগিতা ছাড়া বাঙালিদের নিজেদের শক্তি, নিজেদের সৃজনশীলতাকে তুলে ধরা সম্ভব নয়। সীমানার বাধা পেরিয়ে আমরা যেমন এখানে তৈরি করতে চাই একটি সুস্থ প্রযোজনাবান্ধব ইন্ডাস্ট্রি, সেই সঙ্গে এ-ও প্রত্যাশা করি, বাংলার জন্য এভাবেই এগিয়ে এসে একে অপরকে এগিয়ে নেব আমরা সবাই।’
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে চরকির হেড অব কনটেন্ট অনিন্দ্য ব্যানার্জি বলেন, ‘আমরা পুরোদমে লহুর শুটিং শুরু করি। কিন্তু অল্প কিছুদিন না যেতেই বাধাগ্রস্ত হয় কাজ, থেমে যায় শুটিং। এরপর আমরা সব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এবং আলোচনার পথ সুগম করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার চাহিদা অনুযায়ী যে কদিন পশ্চিম বাংলায় শুটিং হয়েছে, সে কদিনের দ্বিগুণ পারিশ্রমিক পরিশোধ করি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হলে নিরুপায় হয়ে একসময় বাংলাদেশেই সিরিজটির বাকি অংশের কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সে অনুযায়ী কাজও করা হয়।’
অনিন্দ্য ব্যানার্জির ভাষ্যে, ‘শোনা যাচ্ছে, উদ্ভূত পরিস্থিতি দিন দিন আরও অনাকাঙ্ক্ষিত দিকে মোড় নিচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগের। যেখানে চরকি আশা করেছিল সহযোগিতা, সৌহার্দ্য ও কোলাবরেশনের মধ্য দিয়ে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরবে, সেখানে শুরুতেই সেই উদ্যম মন্থরগতি ধারণ করে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল, দুই দেশের বাংলাভাষীদের জন্য কাজ করার, একই প্ল্যাটফর্মে তরুণ, সৃষ্টিশীল, মেধাবী, সৃজনশীল বাঙালিদের কাজ তুলে ধরার। কিন্তু বর্তমান কর্মপরিস্থিতি আমাদের মনে দ্বিধা ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে।’