বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে যাওয়ার আগে কলকাতার বিমানবন্দরে সুপ্রিয়া, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া রায়
বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে যাওয়ার আগে কলকাতার বিমানবন্দরে সুপ্রিয়া, উত্তমকুমার, সত্যজিৎ রায় ও বিজয়া রায়

মানিকদা, হালকা মেকআপ করলে হয় না

আজ উত্তমকুমারের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই প্রয়াত হন তিনি। তাঁর সময়ে ভারতের সেরা নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের দুটি সিনেমা নায়কচিড়িয়াখানায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। মহানায়কের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে উত্তম–সত্যজিতের রসায়ন নিয়ে এই প্রতিবেদন।

সেবার জলবসন্ত বেশ ভোগায় উত্তমকুমারকে। এ জন্য শুটিং থেকে একদমই দূরে ছিলেন। কারও সঙ্গে তেমন দেখাও করছেন না, বাইরেও বের হচ্ছেন না। এমন সময় জানতে পারেন, সত্যজিৎ রায় তলব করেছেন। তাঁদের দেখা হলো। নায়কের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা এবার পূরণ হচ্ছে। তাঁকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় সিনেমা বানাবেন। এই সিনেমার নাম নায়ক। কিন্তু শুরুতেই কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেলেন উত্তমকুমার।

গল্প, চরিত্র কোনো কিছু নিয়েই উত্তমকুমারের কোনো কথা নেই। চোখ বন্ধ করে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল জলবসন্ত থেকে সেরে ওঠা উত্তমের মুখের দাগ নিয়ে। মেকআপ ছাড়া যে নায়ক কখনোই অভিনয় করেননি, তাই আশ্বস্ত ছিলেন, এবারও মেকআপেই মুখের দাগগুলো ঠিক করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন। কিন্তু ভয় একটাই, তিনি আগে থেকেই জানতেন, মানিকদা মেকআপ করা পছন্দ করেন না। তাহলে কী করা যায়? এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় মুখের দাগগুলো দেখে উত্তমকুমারের মনের কথা জানতে পারলেন।

সত্যজিৎ রায় জানালেন, ছেলেদের মুখে তিনি মেকআপ পছন্দ করেন না। এ কথা শুনে অনেকটাই আশাহত হলেন উত্তমকুমার। তিনি এবার বলেই ফেললেন, ‘মানিকদা, হালকা মেকআপ করলে হয় না। মুখের চিহ্নগুলো ঢাকবার জন্য...।’

কিন্তু বাধা দিলেন মানিক বাবু। তবে সেদিন দাপুটে এই নায়ককে কী বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়? সেই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ কী বলেছিলেন, তা জানা যায় সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের লেখা আমাদের কথা বইতে। সেদিন সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘কিছু ম্যাটার করবে না, মুখে দুই–একটা দাগ থাকলে কী হয়েছে? আমি ছেলেদের কোনো মেকআপ পছন্দ করি না। এমনকি মেয়েদেরও যথাসম্ভব হালকা, যা না হলেই নয়; সেই ধরনের মেকআপ করাই। তুমি তো আমার আগের ছবি দেখেছে। মেকআপ ছাড়া কিংবা কম মেকআপে কি খারাপ দেখায়? বরং মুখের অভিব্যক্তি অনেক ভালো ফুটে ওঠে।’

সত্যজিতের দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন উত্তমকুমার

স্ট্যাইলিশ যে নায়ককে মেকআপ ছাড়া কখনোই দেখা যায়নি, তিনি এবার মুখে জলবসন্তের দাগ নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে রাজি হলেন। কারণ একটাই, মানিক বাবুর সিনেমায় ‘না’ বলার সুযোগ নেই। কাজেই উত্তম রাজি হলেন। কারণ, ক্যারিয়ারে এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। এদিকে সবাই জানতেন, সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা মানেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচনায় থাকা। কান চলচ্চিত্র উৎসব, বার্লিন বা ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের কথাই যদি বলি, সেখানে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা থাকবেই। সিনেমা নিয়ে বছর ধরে দেশে–বিদেশে ঘোরার সুযোগ ও সম্মাননার জন্য অভিনয়শিল্পীরা মুখিয়ে থাকতেন মানিক বাবুর সিনেমার ডাক পড়ার অপেক্ষায়। পরে শুরু হলো নায়কের শুটিং। এখানেও মজার ঘটনা ঘটে।

কারণ, আড্ডাবাজ উত্তমকুমারকে আর আগের মতো হাসি, ঠাট্টা, গল্পে মেতে উঠতে দেখা গেল না। কারণ, শুটিংয়ের বেশির ভাগ সময়ই তিনি মেকআপ রুমে বসে থাকতেন। এদিকে জানাজানি হয়ে গেল, এবার মানিক বাবুর সিনেমায় উত্তম শুটিং শুরু করেছেন। তখনই শুরু হলো আরেক বিপত্তি।

উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন

উত্তমকে দেখার জন্য ফ্লোর ভেঙে পড়ত, এতটাই ভিড় হতো। কিন্তু সেদিকে বিন্দুমাত্রও খেয়াল করতেন না উত্তম। এই উত্তমকুমার যেন চুপচাপ শান্তশিষ্ট একজন অভিনেতা, যাঁর মুখের সামনে সব সময় থাকত চিত্রনাট্য। পরিচালক কী চাইতেন, সেটা আগে বোঝার চেষ্টা করতেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের কথা বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘উত্তমকুমার নায়ক–এর ফ্লোরে এসেও মুখের সামনে ডায়ালগের পাতাটা ধরে রাখত। যাতে কোনো ভুল না হয়।’

শুটিংয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে

প্রথমবার একসঙ্গে মানিক বাবুর পরিচালনায় অভিনয়, তাই খুবই সতর্ক ছিলেন উত্তম। সময়মতো ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়াতেন। সত্যজিৎ রায় ফ্লোরে ঢুকলেই সঙ্গে সঙ্গে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে নমস্কার জানাতেন। ক্যামেরার সামনে বেশির ভাগ দেখা যেত এক শর্টেই ওকে। তেমন কোনো ভুল হতো না। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনার স্টাইলও পছন্দ করতেন। দেখা যেত, মাঝেমধ্যে এসে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে যেতেন।

উত্তমকুমারের ভদ্রতা, শিষ্টাচার, শিক্ষা দেখে খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎ। শুটিংয়ের এক পর্যায়ে সত্যজিৎ রায় ও উত্তমকুমারের মধ্যে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। উত্তম ভেবেছিলেন হয়তো প্রথম ও শেষবার মানিক বাবুর সিনেমায় শুটিং করা। পরে তিনি ১৯৬৬ সালে হঠাৎ করেই চমকে যান। এবার সত্যজিতের চিড়িয়াখানা সিনেমায় সুযোগ পান। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিতে ব্যোমকেশ বক্সীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে উত্তমকুমার

এটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের স্মরণীয় ঘটনা। এ সিনেমার শুটিং করতে গিয়ে উত্তমকুমার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। শুটিং বন্ধ ছিল বহুদিন। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ মে নায়ক মুক্তি পায়। সিনেমাটি হয়ে যায় তাঁর ক্যারিয়ারে অন্যতম সিনেমা। এই সিনেমা নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে উত্তম ছুটলেন প্রথম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের আমন্ত্রণে। ক্রিটিকস প্রাইজ, স্পেশাল জুরিসহ তিনটি পুরস্কার জিতেছিলেন নায়ক। যে উত্তমকুমারের একের পর এক শিডিউল নিয়ে সিনেমার শুটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তাঁকেই দেখা গেল গোটা বছর ধরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে লন্ডন, প্যারিস, জাপানের বড় বড় উৎসবে ঘুরতে।   সূত্র: বিজয়া রায়ের আমাদের কথা ও উত্তমকুমারের আমার আমি।