সেবার শীতের বেশ দাপট। কলকাতায় ছিল রেকর্ড পরিমাণ ঠান্ডা। ১৭ জানুয়ারি ২০১৪। সেদিন কলকাতায় ফিরেছিলেন সুচিত্রা। সুচিত্রা, মানে সুচিত্রা সেন। উত্তম কুমারের সুচিত্রা; ‘হারানো সুর’-এর রমা, ‘সপ্তপদী’র রিনা ব্রাউন, ‘সাত পাকে বাঁধা’র অর্চনা, ‘উত্তর ফাল্গুনী’র দেবযানী, পান্না বাঈ বা সুপর্ণা। বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে সুচিত্রা।
‘ফিরে এসেছিলেন’ বলার কারণ, তিনি থেকেও ছিলেন না। তিনি ছিলেন, তবে কলকাতা তাঁকে দেখেনি। তাঁকে দেখা যায়নি নন্দন, কলাকেন্দ্র, নিউমার্কেট, ধর্মতলা, সল্টলেক বা পার্ক সার্কাসে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তাঁকে দেখেনি কেউ। সুচিত্রা সেন সেই নারী, যিনি সম্মোহনী সৌন্দর্যের আগল ভাঙেননি জীবনকালে। বয়সের সঙ্গে নিজেকে পাল্টে গড়ে নেননি নতুন চরিত্রে, হননি চরিত্রাভিনেত্রী বা পার্শ্ব-অভিনেত্রী। পর্দার অভিনয়জীবনে নিজের যে চূড়ান্ত রোমান্টিক রূপটি গড়েছিলেন, স্বেচ্ছা-অন্তরালে সেই রূপটিই ধরে রেখেছিলেন শেষ জীবনেও। এই মানুষটিকে ফিরে আসতে দেখেছি ১৭ জানুয়ারির কলকাতায়। সেদিন কলকাতা ভেসেছিল সুচিত্রার শোকে। কলকাতাবাসীর আগ্রহ আর আলোচনার বিষয় ছিলেন সুচিত্রা।
পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে, দোকানে, ক্লাবে দেখা গেছে সেই চিরচেনা ভুবন ভোলানো হাসির সুচিত্রার সাদা-কালো প্রতিকৃতি। সেখানে নানা রঙের ফুল। নিজের বাড়িতেও ফিরেছিলেন, সাদা বেনারসি শাড়িতে তিনি ছিলেন নীরব, নিথর।
২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে পৃথিবীর বাতাসে শেষবারের মতো নিশ্বাস নেন সুচিত্রা সেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলা চলচ্চিত্রের অনুরাগীরা আবার উপলব্ধি করেছিলেন, কিংবদন্তির মৃত্যু নেই।
আজ ১৭ জানুয়ারি তাঁর চলে যাওয়ার দিনে সেদিনের কথা মনে পড়ে যায়। এর আগের দিনগুলোও কেমন যেন নাটকীয় ছিল। জীবনের শেষ ২৬টি দিন হাসপাতালেই ছিলেন তিনি।
শহরের আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের পাশে মিন্টোর পার্ক এলাকা। পার্কের ঠিক পাশেই প্রতিষ্ঠানটি। বেল ভিউ নার্সিং হোম। পরিসরে খুব একটা বড় না হলেও নাম–ডাক আছে এই হাসপাতালের। এখানেই ছিলেন বাঙালির চিরকালের মহানায়িকা সুচিত্রা সেন।
পাড়া-মহল্লায়, অলিগলিতে, দোকানে, ক্লাবে দেখা গেছে সেই চিরচেনা ভুবন ভোলানো হাসির সুচিত্রার সাদা-কালো প্রতিকৃতি। সেখানে নানা রঙের ফুল। নিজের বাড়িতেও ফিরেছিলেন, সাদা বেনারসি শাড়িতে তিনি ছিলেন নীরব, নিথর।
সেদিন ছিল শুক্রবার
এমনিতে অন্য দিনগুলোতে শীতে কাবু মানুষ রাস্তায় কম বের হতেন। কিন্তু নগরীর গোর্কি সদনের পাশের রাস্তায়, মিন্টো পার্কের সামনে, বেসরকারি হাসপাতাল বেল ভিউয়ের সামনের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। সেখানে অগণিত মানুষের ভিড়।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আগের দিনের খবর ছিল মন ভালো করে দেওয়া। শোনা গিয়েছিল মহানায়িকার শরীর একটু ভালো। এমনকি বাড়ি ফেরার প্রস্তুতিও চলছিল। কিন্তু শুক্রবার ভোর থেকে আবারও সংকটে পড়েন তিনি।
দ্রুত সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। নানা রকম খবর আসছিল হাসপাতালের ভেতর থেকে। শোনা গিয়েছিল, মহানায়িকার পালস রেট একদম কমে গেছে। তার মানে ২৬ দিনের লড়াই শেষ হতে চলেছে? আটটায় বন্ধ হলো হৃৎস্পন্দন। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সেদিন সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে চলে গেলেন সুচিত্রা। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দিলেন তখনকার (বর্তমানও) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেদিনই শহরের কেওড়াতলা শ্মশানে সুচিত্রার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে, হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে সেটিও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। খবরটা শুনে যেন কৈশোর, তারুণ্যের আবেগের মৃত্যু ঘটল অনেকের। কনকনে শীতের সকালে হাসপাতালের অনতিদূরে দেখেছিলাম, এক তরুণ গেয়ে উঠলেন, ‘আরও কিছুটা সময় না রহিতে...।’ চোখ ছিল তাঁর ছলছল। বেলা ১১টার মধ্যেই হাসপাতালের সামনে পৌঁছায় শববাহী গাড়ি। ততক্ষণে মহানায়িকাকে শেষযাত্রার পোশাক পরানো হয়, কেবিনেই। সাদা বেনারসি। তার ওপরে সোনালি গরদের চাদর জড়ানো। মাথায় ঘোমটা, কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত দেখা গেছে। হ্যাঁ, সেদিন সুচিত্রাকে দেখেছে কলকাতা।
কফিনে বন্ধ মরদেহ ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে তোলা হলো দুপুর সাড়ে ১২টায়। শেষযাত্রায় বাড়ির মাটি ছোঁয়ার নিয়ম, তাই হাসপাতাল থেকে নিয়মরক্ষায় বালিগঞ্জের বাড়িতে মিনিট পাঁচেকের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর মরদেহ। সেখান থেকে কেওড়াতলা শ্মশানে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে মুখাগ্নি হয় মেয়ে মুনমুনের হাতে।
দ্রুত সে খবর ছড়িয়ে পড়ে। নানা রকম খবর আসছিল হাসপাতালের ভেতর থেকে। শোনা গিয়েছিল, মহানায়িকার পালস রেট একদম কমে গেছে। তার মানে ২৬ দিনের লড়াই শেষ হতে চলেছে? আটটায় বন্ধ হলো হৃৎস্পন্দন। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সেদিন সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে চলে গেলেন সুচিত্রা। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দিলেন তখনকার (বর্তমানও) পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিনই শহরের কেওড়াতলা শ্মশানে সুচিত্রার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে, হাসপাতাল চত্বরে দাঁড়িয়ে সেটিও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। খবরটা শুনে যেন কৈশোর, তারুণ্যের আবেগের মৃত্যু ঘটল অনেকের। কনকনে শীতের সকালে হাসপাতালের অনতিদূরে দেখেছিলাম, এক তরুণ গেয়ে উঠলেন, ‘আরও কিছুটা সময় না রহিতে...।’
চোখ ছিল তাঁর ছলছল। বেলা ১১টার মধ্যেই হাসপাতালের সামনে পৌঁছায় শববাহী গাড়ি। ততক্ষণে মহানায়িকাকে শেষযাত্রার পোশাক পরানো হয়, কেবিনেই। সাদা বেনারসি। তার ওপরে সোনালি গরদের চাদর জড়ানো। মাথায় ঘোমটা, কপাল থেকে চিবুক পর্যন্ত দেখা গেছে। হ্যাঁ, সেদিন সুচিত্রাকে দেখেছে কলকাতা। কফিনে বন্ধ মরদেহ ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে তোলা হলো দুপুর সাড়ে ১২টায়। শেষযাত্রায় বাড়ির মাটি ছোঁয়ার নিয়ম, তাই হাসপাতাল থেকে নিয়মরক্ষায় বালিগঞ্জের বাড়িতে মিনিট পাঁচেকের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর মরদেহ। সেখান থেকে কেওড়াতলা শ্মশানে। বেলা ১টা ৪০ মিনিটে মুখাগ্নি হয় মেয়ে মুনমুনের হাতে।
রবীন্দ্র সদন থেকে শুরু করে শহরের নানা জায়গায় দেখা গেল সুচিত্রা সেনের বিশাল বিশাল প্রতিকৃতি। মূল রাস্তা থেকে যেসব ছোট গলি চলে গেছে, সেসব গলির মুখে মূলত ছিল প্রতিকৃতিগুলো।
সুচিত্রার ঠোঁট মেলানো সিনেমার গানগুলো বাজছিল শহরের নানা জায়গায়। এমনকি নিউমার্কেটের পাশে যে পানের দোকানটিতে সব সময় হিন্দি গান শোন যেত, সেখানেও শোনা গেছে সুচিত্রার সিনেমার গানগুলো। ভিডিও-সিডির দোকানে হঠাৎ করে পুরোনো ছবির সিডিগুলোর বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল।
১৮ জানুয়ারি সারাদিন
শহরের সল্টলেক এলাকা থেকে মধ্য কলকাতায় আসার পথে পড়ে বেলেঘাটা। পরদিন অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারি সকালে এ এলাকার ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম বালিগঞ্জের দিকে। ট্যাক্সিতে ১০ মিনিটের পথ। এই ১০ মিনিটের পথে অন্তত ১৫ জায়গায় দেখা গেল সুচিত্রা সেনের বড় বড় প্রতিকৃতি। অনেকে সকালে দৈনন্দিন পূজা শেষে সেখানে এসে ফুল দিয়েছেন। ফুল দিতে দেখা গেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীদেরও।
সুচিত্রার ঠোঁট মেলানো সিনেমার গানগুলো বাজছিল শহরের নানা জায়গায়। এমনকি নিউমার্কেটের পাশে যে পানের দোকানটিতে সব সময় হিন্দি গান শোন যেত, সেখানেও শোনা গেছে সুচিত্রার সিনেমার গানগুলো।
গিয়েছিলাম টালিগঞ্জে। মানুষের আগ্রহ ছিল টালিগঞ্জের চণ্ডী ঘোষ রোডের নিউ থিয়েটার্সের ১ নম্বর সাজঘরের দিকে। যেটি বরাদ্দ থাকত শুধু সুচিত্রা সেনের জন্য। এই সাজঘরে সাজসজ্জা করেই ‘গৃহদাহ’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘কমললতা’, ‘দেবী চৌধুরানী’র মতো একের পর এক বিখ্যাত ছবির ফ্লোরে গিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। এখানেও আবার ফিরেছিলেন সুচিত্রা। তাঁর বিশাল ছবিতে ফুল-মালায় শ্রদ্ধা জানিয়েছে নিউ থিয়েটার্স।
এক জীবনে সুচিত্রা
আজ সুচিত্রা সেনের প্রয়াণ দিবস। তাঁর চলে যাওয়ার দিন, শেষ দিনগুলোর কথা তো মনে করিয়ে দেওয়া গেল। ছোট্ট করে খানিকটা জানানো যাক সুচিত্রাকে, যিনি ছুঁয়ে গেছেন, আছেন দুই বাংলায়। আজকের বাংলাদেশের পাবনা শহরে জন্মেছিলেন করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের পঞ্চম সন্তান। তাঁর নাম রাখা হয় কৃষ্ণা। দুনিয়াতে আসার তারিখ ৬ এপ্রিল ১৯৩১। পাবনার বাড়িতে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে যান তিনি। বড় পর্দায় সুচিত্রার যাত্রা শুরু হয় ১৯৫২ সালে। সব মিলিয়ে ৬০টি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।
রুপালি পর্দায় সুচিত্রা সেনের নায়ক হিসেবে অভিনয় করে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটির ৩০টি বাংলা সিনেমা এখনো খোঁজেন মানুষ। ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার ওপরে’, ‘পাপমোচন’, ‘শিল্পী’, ‘সাগরিকা’, ‘পথে হল দেরি’, ‘হারানো সুর’, ‘গৃহদাহ’, ‘প্রিয় বান্ধবী’ ইউটিউবের ভিউ যথেষ্ট।
অভিনয়ে আসার আগেই সংসারজীবন শুরু হয় সুচিত্রার। ১৯৪৮ সালে কলকাতার শিল্পপতি আদিনাথ সেন তনয় দিবানাথ সেনের সঙ্গে তিনি ঘর বাঁধেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন। দুই নাতনি রাইমা সেন ও রিয়া সেনও অভিনেত্রী। ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান মহানায়িকা। ১৯৭২ সালে পান ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’।