উমা দাশগুপ্তের মৃত্যুর পর আবার কথা হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে। সিনেমায় দুর্গা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উমা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সিনেমার নানা দৃশ্য শেয়ার করে শোক প্রকাশ করেছেন মুগ্ধ দর্শকেরা। সব বিচারেই বাংলা চলচ্চিত্রের বাঁক বদলে দিয়েছিল এই সিনেমা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। উপন্যাসটি থেকে সিনেমা নির্মাণের কথা কেন ভেবেছিলেন সত্যজিৎ?
‘পথের পাঁচালী’ বিভূতির প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি যখন লেখেন, তখন তিনি ছিলেন ভাগলপুরে। স্কুলের চাকরি ছেড়ে নতুন কাজ নিয়ে ভাগলপুরের বাঙালিটোলায় গিয়েছিলেন তিনি। তবে ‘পথের পাঁচালী’ পাঠকের হাতে পৌঁছানো সহজ ছিল না, যদি না উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিভূতিভূষণের দেখা হতো।
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন আইনের ছাত্র। কিন্তু আইনের ছাত্র হলে কী হবে, সাহিত্যের প্রতি ভীষণ ভালো লাগা ছিল তাঁর। কেবল ভালো লাগা ছিল বললে ভুল বলা হবে, তিনি লিখতেনও। ওই সময়ের সব মানসম্পন্ন পত্রিকাতেই তাঁর লেখা বেরিয়েছিল। আর সেই মানুষই কিনা পড়ালেখার পাট চুকতেই ওকালতি করার উদ্দেশ্যে পৈতৃক নিবাস ভাগলপুরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। আর ভাগলপুরে ফিরে কেবল পেশাগত প্র্যাকটিস পর্যন্ত থেমে থাকেননি তিনি। সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের নিয়ে আড্ডার আয়োজনও শুরু করেন। প্রায় তাঁদের বসার ঘরে আড্ডা বসত। একদিন ঘুরতে ঘুরতে বিভূতিভূষণও আড্ডায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। পরে নিয়মিত যেতে শুরু করলেন। কিন্তু কথা বলতেন না, চুপচাপ সবার কথা শুনতেন।
বিভূতিভূষণকে চোখে পড়লেও তাঁর সঙ্গে খোলাখুলিভাবে তখনো আলাপ হয়নি উপেন্দ্রনাথের। বিভূতিভূষণ নিয়মিত আড্ডায় অংশ নেন, এ পর্যন্তই। কিন্তু এক বৃষ্টির দিনে কেউ আড্ডায় উপস্থিত হতে না পারলেও বিভূতিভূষণ গিয়ে উপস্থিত হন। বিভূতির সঙ্গে কথা শুরু করেন উপেন্দ্রনাথ। নানা কথা শেষে একপর্যায়ে জানতে চান, ‘গল্প, কবিতা কিছু লেখেন?’ বিভূতি লজ্জাবনত স্বরে জবাব দেন, ‘সেভাবে তো কিছু লিখি না, একটা উপন্যাস লিখেছি।’ ‘উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিখানা একদিন পড়তে দেন। পড়ে দেখি কেমন লিখেছেন’, বলেন উপেন্দ্রনাথ।
বিভূতিভূষণ তত দিনে উপেন্দ্রনাথের জ্ঞান-গরিমায় মুগ্ধ। তাই তো ভয়ে ভয়ে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা উপেন্দ্রনাথের কাছে জমা দেন। আবারও শুরু হয় অপেক্ষা। বিভূতিভূষণ আশায় বুক বেঁধে আড্ডায় যান। আশা অন্য কিছু নয়, উপেন্দ্রনাথের মুখে নিজের প্রথম উপন্যাস বিষয়ে দুটি কথা শোনা।
কিন্তু এক দিন, এক সপ্তাহ করে মাস কেটে গেলেও উপেন্দ্রনাথ কিছু জানান না। সাহস করে যে জানতে চাইবেন, সে সাহসও বিভূতিভূষণ করে উঠতে পারেন না। অগত্যা মনে মনে ভেবে নেন, উপন্যাসটি মানসম্মত হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ একদিন অন্য রকম ঘটনা ঘটে। আড্ডা শেষে উপেন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণকে ডেকে তাঁর লেখার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সঙ্গে এ-ও জানান যে তিনি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে একটি পত্রিকা বের করবেন। নামও ঠিক হয়েছে ‘বিচিত্রা’। আর ‘বিচিত্রা’তেই ‘পথের পাঁচালী’ ছাপতে চান তিনি। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’তেই কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ‘পথের পাঁচালী’।
১৯৪৫ সাল। প্রকাশনাজগতে সিগনেট প্রকাশনা সংস্থার সুখ্যাতি তখন চারদিকে। সত্যজিৎ রায় বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরির সূত্রে সিগনেট প্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রচ্ছদ আঁকতেন। একদিন প্রেসের প্রধান ডি কে গুপ্ত তাঁকে ডেকে ‘পথের পাঁচালী’র ‘আম আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদসহ প্রাসঙ্গিক কিছু ছবি আঁকার দায়িত্ব দেন। তখনো ‘পথের পাঁচালী’ পড়া হয়নি সত্যজিতের। কিন্তু প্রচ্ছদ করতে হলে পড়তে হবে।
সত্যজিৎ সম্পূর্ণ বই পড়ে ফেললেন। মুগ্ধ হলেন। প্রায়শ কাহিনিটা তাঁর মাথায় ঘুরতে শুরু করল। এবং তিনি ভাবতে শুরু করলেন, এটা নিয়ে সিনেমা বানালে কেমন হয়? পরে বিভূতির ‘পথের পাঁচালী’ থেকেই প্রথম সিনেমা বানাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
‘পথের পাঁচালী’র শুটিং চলেছিল দুই বছরের বেশি সময় ধরে। বিজ্ঞাপন অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই ছবির শুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। টাকাপয়সা নানা সমস্যা সীমাবদ্ধতা, কত কী এসে পথ আটকেছে বিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। সব কষ্ট দুহাতে মাড়িয়ে দর্শকের সামনে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’।