২০১৯ সালের কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হঠাৎ ভাইরাল—‘অভিনেতা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় আর নেই’! ফেসবুক ভরে গেল ‘আর.আই.পি’ কামনায়। এ খবরে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন ভিক্টর। মারা যাননি সে খবর নিজেকেই দিতে হয়েছিল সেদিন। নিজেই ফেসবুকে বলেন, ‘আই অ্যাম অ্যালাইভ। বিলিভ ইট অর নট।’
তিনি আমাদের মধ্যে আজও আছেন। বড় পাওয়া, গুণী এই শিল্পী অভিনয় করেন বাংলা চলচ্চিত্রে। সত্যজিৎ রায় থেকে মৃণাল সেন, রোমান পোলান্স্কি, জেমস আইভরি, শ্যাম বেনেগাল, ডেভিড লিন, রোনাল্ড নিয়েম, নীতিশ রায়, রামগোপাল ভার্মার পরিচালনায় সমৃদ্ধ করেছেন চলচ্চিত্র ভুবনকে। তিনি অবশ্য বলতেন, ‘আমি একজন ভিতু লোক। বাংলা, ইংরেজি, অসমিয়া, হিন্দি বলতে পারি সাবলীলভাবে। আমার প্রথম সিনেমা উর্দু ভাষায়, অথচ আজ পর্যন্ত আমি উর্দু বলতে পারি না।’ আজ ছিল ভিক্টরের ৭৮তম জন্মদিন। তাঁর আসল নাম পার্থসারথি বন্দ্যোপাধ্যায়।
ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতে তিনি ভিক্টর ব্যানার্জি বা ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার পাশাপাশি অসমিয়া, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার ছবিতে নায়ক বা ভিলেন চরিত্রে তাঁকে পাওয়া গেছে। ক্ল্যাসিক বা বাণিজ্যিক, সব ধরনের ছবিতে অভিনয় করেই তিনি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন।
১৯৪৬ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহের চাঁচলের এক জমিদারবাড়িতে তাঁর জন্ম। জীবনের বড় একটা সময় তিনি কাটিয়েছেন পাহাড়ে। শিলংয়ের সেন্ট অ্যাডমান্ড স্কুল শেষে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে স্কলারশিপ পান।
ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শৈশব কাটে বোর্ডিং স্কুলে। নিজের শিক্ষাজীবন আর কর্মজীবনের স্মৃতিচারণা করে ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘স্কুলে টাই আর ব্লেজার পরাই ছিল রীতি। চাকরি করতাম এমন এক বিলেতি সংস্থায়, যেখানে সন্ধ্যাবেলা থিয়েটার বা সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়ও স্যুট পরতে হতো। কিন্তু ওই দমবন্ধ বছরগুলোতেও আমি মনে মনে ছিলাম হিপি আন্দোলনের অনুসারী। সেই পাঁচ বছর বয়সে শুরু করে, চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার দিন পর্যন্ত কোনো বিরতি ছাড়াই মঞ্চে অভিনয় করে গেছি। অবশেষে ১৯৭৬ সালে, ৩০ বছর বয়সে, নিউইয়র্কের চাকরি ছেড়ে মানিকদার (সত্যজিৎ রায়) দরজায় কড়া নাড়ি।’
ভারত ও ভারতের বাইরের অনেক পরিচালকের সঙ্গে কাজ করলেও সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ তাঁর ক্যারিয়ারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘পিকু’তেও অভিনয় করেছেন তিনি। বাংলা ‘আগুন’, ‘দেবতা’, ‘লাঠি’ ছবিগুলোতে ছিল তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। গত শতকের আশির দশকে তিনি কলকাতার বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছেন।
‘ভূত’, ‘জগার্স পার্ক’, ‘হোম ডেলিভারি’, ‘আপনে’, ‘সরকার রাজ’, ‘গুণ্ডে’, ‘ফেভার’র মতো ব্যবসাসফল বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। শ্যাম বেনেগালের ‘কলিযুগ’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আলোচিত হয়।
ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের শুরুটা মসৃণ ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায়, ডেভিড লিন, মৃণাল সেন এবং শ্যাম বেনেগালের মতো বিশ্বমানের নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। তবে আমি এমন এক বাঙালি পরিবারে জন্মেছিলাম, যেখানে সিনেমা দেখাকে নিরুৎসাহিত করা হতো, আর তাতে অভিনয় করা! ভাবতেই পারতাম না। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ যেহেতু সত্যজিৎ রায়ের ফিল্ম, তাই তাতে কাজ করতে পেরেছিলাম। ১৯৭৭ সালের এই ক্ল্যাসিকের জন্য অনুমতি পেয়েছিলাম আর আমার পরিবার তখন উপলব্ধি করে যে অভিনয় একটি সম্মানজনক পেশা।’
ভিক্টরকে বলা হয় অ্যাংরি ইয়ং ম্যান অব টলিউড। খ্যাতির কেন্দ্রবিন্দু হয়েও নিজেকে কখনো ইন্ডাস্ট্রির অংশ মনে করতেন না তিনি। বরাবরই ছিলেন প্রচারবিমুখ। কোনো প্রকাশ্য আয়োজন, রাজনীতি বা উৎসবে দেখা যায় না তাঁকে। খুব বেশি সাক্ষাৎকারও পাওয়া যায় না তাঁর। একটা সময় নিজেকে টলিউড থেকে গুটিয়ে নেন। কলকাতা ছেড়ে চলে যান ত্রিপুরায়। এখন থাকেন ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের মুসৌরিতে। তার আগে কিছুদিন ছিলেন কেদারনাথে। তাঁর অন্যতম সেরা বাণিজ্যিক ছবি ‘লাঠি’র পরিচালক প্রভাত রায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভিক্টর নিজের ভেতর থাকেন। ইচ্ছা না হলে যোগাযোগ রাখেন না।’
কয়েক বছর আগে ‘থিঙ্কিং অব হিম’ ছবিটি দিয়ে আবার আলোচনায় এসেছিলেন ভিক্টর। এই ছবিতে তাঁকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা গেছে। ছবিতে তাঁর মেকআপ, সাজসজ্জায় অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!