তাঁকে বলা হতো মহানায়ক। বাংলা চলচ্চিত্র ভুবনে তিনি ‘চিরকালের মহানায়ক’। আজ ২৪ জুলাই তাঁর মৃত্যুদিন। ১৯৮০ সালে এমনই এক শ্রাবণে মারা যান তিনি। তিনি উত্তমকুমার, যাঁর অভিনয় ও ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য আলাদা করেছে অন্য সবার থেকে।
চলায়-বলায় দারুণ সাবলীল, স্বাচ্ছন্দ্য, নায়কোচিত গ্ল্যামার উত্তমকুমারের মধ্যে মিশে ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। চেহারা ও হাবভাবে অন্য রকম, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল তাঁর দৈহিক সৌষ্ঠব এবং অনাবিল হাসি।। আর এ বিষয়ই আলাদা করেছিল উত্তমকুমারকে। মন হরণ করেছিলেন অগণিত নারীর, পুরুষ ভক্তও অগণিত। সাদা-কালো যুগ থেকে শুরু করে রঙিন, অভিনয়ের সময় ক্যামেরা নামক যন্ত্রটিকে তিনি মোটেও পাত্তা দেননি। উত্তমকুমার তাঁর অভিনয়, নায়কোচিত সৌষ্ঠব ও তারকাদ্যুতিতে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে আছেন।
১৯২৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় এই মহান অভিনেতার জন্ম। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ ছবির শুটিংয়ের সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষবার নিশ্বাস ছাড়েন পৃথিবীর বাতাসে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নায়কের নাম গোনা শুরু হয় দুই নম্বর থেকে। এখনো তিনিই উত্তম। আজও কলকাতায় কিংবা ঢাকা বা চট্টগ্রামে কোনো পাড়ামহল্লায় কোনো চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করলেও উত্তমকুমারের ছবির নামের তালিকা শুরুতেই উচ্চারিত হয়। পর্দায় তাঁর ছবি চললে এখনো তাকিয়ে দেখতে হয় তাঁর অভিনয়।
ফ্লপ মাস্টার থেকে সুপারহিট
আজও উত্তমকুমারের নামের আগে ‘মহানায়ক’ শব্দটি উচ্চারিত হয়। অথচ এই মহানায়কের ভ্রমণটা মোটেও মসৃণ ছিল না। সমকালীন আরেক নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে উত্তমকুমার চলচ্চিত্রে আসেননি। শুরুতে সত্যজিৎ রায়ের ছায়া পাননি, বরং শুরুটা করুণ। উত্তম প্রথম সুযোগ পান ‘মায়াডোর’ নামে একটি ছবিতে। অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে এই ছবিতে তিনি পাঁচ দিন কাজ করেছিলেন। তবে ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। তখন অবশ্য তিনি উত্তমকুমার ছিলেন না, তাঁর নাম তখন অরুণকুমার।
উত্তমকুমারের ভাই তরুণকুমার এক স্মৃতিচারণায় উত্তমকুমারের স্টুডিওর প্রথম দিকের অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বলেছিলেন। এক ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয়। খুব দুরুদুরু বুকে উত্তমকুমার পা রাখলেন স্টুডিও ফ্লোরে। পরিচালক শট বুঝিয়ে দিলেন। চারপাশ থেকে আলো জ্বলে উঠল। এই প্রথম নবাগত অভিনেতা দেখলেন তাঁর সামনের অভিনেত্রীর মুখ। সেই সময়কার বিখ্যাত প্রভা দেবী। পাশের ভিড় থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘এ কলির ভীমকে কোত্থেকে আনলেন? পায়ে শিকল বেঁধে রাখুন। নইলে যে ঝড় উঠলে উড়ে যাবে।’ তখন উত্তমকুমার সত্যিই রোগা ছিলেন। প্রচণ্ড অপমানিত হলেন ফ্লোরের মধ্যে শুটিং দেখতে আসা লোকজনের সামনে। তবু গায়ে মাখলেন না কিছু। পরিচালক স্টার্ট ক্যামেরা বলার সঙ্গে সঙ্গেই এক কদম এগিয়ে গেলেন অভিনেত্রীর দিকে। কিন্তু পরিচালকের ‘অ্যাকশন’ বলার আগেই প্রভা দেবী নায়কের হাতটা আচমকা ধরে ফেললেন। ‘আরে, এই ছেলে আমার ডাক্তারি পরীক্ষা করবে কী? ওর নিজেরই তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।’ চারপাশ থেকে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পরিচালক সেদিন আর দৃশ্যটি ধারণ করেননি।
পরে ১৯৪৮ সালে ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে প্রথম দেখা দিলেন উত্তমকুমার। সেই ছবিতে উত্তমকুমারের ‘উত্তমকুমার’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা প্রকাশিত হয়েছিল, তা বলা কঠিন। ১৯৪৮ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতার চিত্রা সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল সে ছবি। অন্য আলোয় ম্লান ছিলেন উত্তম; তাঁর প্রতিভা চাপা পড়ে গিয়েছিল। অসিতবরণ, ছবি বিশ্বাস, কেতকী দত্তের পাশে নতুন মুখ অরুণের (উত্তমকুমার) চোখে পড়ার কারণ ছিল না।
এখানেই ব্যর্থতার শেষ নয়; এরপর ‘কার পাপে’সহ কয়েকটি ছবিতে ছোট ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি। এর পরের বছর খানিকটা পূর্ণাঙ্গ চরিত্রে উত্তমকুমার অভিনয় করলেন ‘কামনা’ ছবিতে। পরিচালক ছিলেন নব্যেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছবিতে নায়িকা হিসেবে ছিলেন সে যুগের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছবি রায়। তবে কোনো চলচ্চিত্রই ব্যবসাসফল হয়নি, আলোচনায় আসতে পারেননি উত্তমকুমার বা অরুণকুমার। পরের বছরের ছবি দিগম্বর চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘মর্যাদা’। ছবি দেবী ছিলেন এ ছবির নায়িকা। এ ছবিও দর্শক নেয়নি; বরং হয়ে যায় বদনাম। নামই হয়ে যায় ‘ফ্লপ মাস্টার’। এমনও শোনা যায়, ওই সময় তিনি সেটে ঢুকলেই লোকজন ঠাট্টা-তামাশা করতেন তাঁকে নিয়ে। এ সময় অরুণ চ্যাটার্জি, অরুণকুমার, উত্তম চ্যাটার্জিসহ বিভিন্ন নামে অভিনয় করেন।
অবশ্য এসব আশীর্বাদই হয়েছে উত্তমকুমারের জন্য। একের পর এক ফ্লপ ছবি, হতাশা, সংকট, পারিবারিক চাপ বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা তাঁর অভিনেতা সত্তাকে ভেঙেচুরে একটা শীর্ষবিন্দুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
১৯৫১ সালে উত্তমকুমার তিনটি ছবিতে অভিনয় করলেন। প্রথমটি রাজেন চৌধুরীর পরিচালনায় ‘ওরে যাত্রী’। এই ছবির নায়িকা ছিলেন করবী গুপ্তা। এরপরই ‘সহযাত্রী’ ছবিটিই অভিনেতা উত্তমকুমারের অভিনয়ের স্বকীয়তার প্রথম স্বাক্ষর। ‘সহযাত্রী’ দর্শকের মনে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিল। অভিনেতা হিসেবে এই ছবি থেকেই দর্শক উত্তমকুমারকে আপনার করে নিতে শুরু করল।
পরের পাঁচ বছর সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিল। পাল্টে দিল বাংলা চলচ্চিত্রের রূপ–গুণ। একে একে উত্তম অভিনয় করলেন ‘মর্যাদা’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সঞ্জীবনী’, ‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘লাখ টাকা’, ‘নবীন যাত্রা’, ‘বউঠাকুরাণীর হাট’, ‘মনের ময়ূর’, ‘ওরা থাকে ওধারে’, ‘চাঁপাডাঙ্গার বৌ’, ‘কল্যাণী’, ‘মরণের পরে’, ‘সদানন্দের মেলা’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’সহ বেশ কিছু ছবিতে। নিজেকে প্রতিবারই বদলিয়েছেন উত্তম, বদলে যায় তাঁর অভিনয়।
‘বসু পরিবার’ সিনেমায় এক যৌথ পরিবারের আদর্শবাদী বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে উত্তমকুমার দর্শকদের দৃষ্টি কাড়েন। এ সিনেমায় সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন তাঁর ছোট বোনের ভূমিকায়। এটিই উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত প্রথম ছবি। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে উত্তম প্রথম জুটি বাঁধেন সে সময়ের নবাগত সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। ছবিটিতে তাঁরা রোমান্টিক জুটির ভূমিকায় থাকলেও এর মূল অভিনেতা ছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী, মলিনা দেবী। হাস্যকৌতুকনির্ভর ছবিটি ব্যবসাসফল হওয়ায় উত্তমকুমারের ভাগ্য খুলে যায়। ১৯৫৪ সালে আশাপূর্ণা দেবীর গল্প অবলম্বনে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমায় উত্তম-সুচিত্রা জুটির পর্দা-রোমান্স দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। আর এ সিনেমার সঙ্গেই শুরু হয় উত্তম-সুচিত্রা যুগের। ছবিটি দারুণ ব্যবসাসফল হওয়ায় নায়ক উত্তমকুমারের আসন স্থায়ী হয়ে যায়।
উত্তম নিশ্চিন্তে চলেন সবার সাথে
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে উত্তমের জুটি বাংলা ছবির ইতিহাসে সবচেয়ে রোমান্টিক জুটি। উত্তমকুমার বলতেই আজও অনেকের মনে ভেসে ওঠে উত্তম-সুচিত্রা জুটির কথা। তাই বলে শুধু যে সুচিত্রায় সীমিত ছিলেন উত্তম, সেটাও বলা যাবে না। সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, মাধবী মুখোপাধ্যায়সহ বিভিন্ন জনপ্রিয় নায়িকার বিপরীতে অসংখ্য সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছিলেন তিনি। ছবিতে রোমান্টিক; বাস্তবেও। কত গল্প উত্তমকুমারকে নিয়ে। তবে শুধু রোমান্টিক নায়ক নয়, অনেক ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয় করেছেন উত্তম, যা তাঁকে অভিনেতা হিসেবে সার্থক প্রমাণিত করেছে।
সফলতম অভিনেতা হিসেবে উত্তরণের কালে বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের যে অদলবদলের যুগ, সেটাকেও উত্তমকুমার নিজের মতো করে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সিনেমার ব্যস্ততার পাশাপাশি মঞ্চেও অভিনয় করতেন। ‘শ্যামলী’ নাটকে দীর্ঘদিন অভিনয় করেছেন। উত্তমকুমার সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে পরিচালিত বিভিন্ন কর্মোদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
যেমনটা ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিটার কথাই বলি। বাংলাদেশেও অনেক দর্শকের দেখা আছে নিশ্চয়। নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার। এখানে তাঁর বিপরীতে ছিলেন তনুজা। একজন কবির আবেগ, হতাশা, যন্ত্রণা, কবির লড়াইয়ে উত্তেজনা—সবই সার্থকভাবে তুলে ধরেছিলেন উত্তম। আবার ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ছবিটিও হয়তো কারও কারও দেখা আছে। উন্মত্ত এক যুবক থিরুমল। উত্তমের বিপরীতে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় গৃহভৃত্য রাইচরণের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেন উত্তম। বিমল মিত্রের উপন্যাস নিয়ে ‘স্ত্রী’ ছবিতে লম্পট অথচ সরলমনা জমিদারের চরিত্রেও তিনি অনন্য। তিনি এখানে খলনায়ক হয়েও প্রধান ভূমিকায়। নায়কের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চ্যাটার্জি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘বিচারক’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় নাম ভূমিকায় ছিলেন উত্তমকুমার। বিচারকের মনোজগতের দ্বন্দ্ব সার্থকভাবে পর্দায় তুলে ধরেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায়ও ছিলেন অসাধারণ।
প্রতিভা, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা
অনেকেরই হয়তো জানা নেই, প্রথম জীবনে গানের টিউশনিও করেছেন উত্তমকুমার। ‘বউঠাকুরাণীর হাট’ ছবিটি তৈরি হওয়ার আগে যে উদ্যমে নিজের চেষ্টায় এমপি স্টুডিওর ভেতরে ঘোড়ায় চড়া শিখে পরিচালক নরেশ মিত্রকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন উত্তমকুমার, তা থেকেই বোঝা যায়, একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা হয়ে ওঠার জন্য তিনি কতখানি আন্তরিক ছিলেন। ঘোড়ায় চড়ার মতোই চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে তিনি পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। অসাধারণ হারমোনিয়াম বাজাতে পারতেন। গায়কের ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয়ের স্বাক্ষর রয়েছে সুবীর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘শাপমোচন’ ‘সুরের পরশে’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘সোনার খাঁচা’সহ আরও বেশ কিছু ছবিতে।
অভিনেতা উত্তমকুমার যখন সাহিত্যনির্ভর ছবিতে অভিনয় করতেন, তখন দর্শক একই সঙ্গে অভিনয় এবং সাহিত্যের রসাস্বাদনের স্বাদ পেতেন। এর হয়তো একটা বড় কারণ, সাহিত্যনির্ভর ছবি করার আগে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যটির সঙ্গে উত্তমকুমার একাত্ম হয়ে যেতেন। সুপ্রিয়া দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এত সিনসিয়ার মানুষ আমি দেখিনি। যা করত, গভীরে ঢুকে করত। গানের মাস্টার আসত ওর। দেখতাম যতক্ষণ না গলার ভেতর গানটাকে নিতে পারছে, ততক্ষণ ছাড়ছে না। দেড় ঘণ্টা-দুঘণ্টা হয়ে গেছে, তবু ছাড়ছে না। “ছোটি সি মুলাকাত”-এর সময় নাচ শিখত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। টায়ার্ড হয়ে যাচ্ছে, ঘেমে যাচ্ছে, তবু থামছে না। আমি বললাম, এটা কী হচ্ছে। এবার থামো। বলল, “না, বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে নাচতে হবে। আমায় পারফেক্ট হতেই হবে”।’
সুপ্রিয়া দেবীরই স্মৃতিচারণায় জানা যায়, পড়ার প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল উত্তমকুমারের। শেক্সপিয়ার পড়তেন। প্রতি রোববার ইংলিশ পড়তে যেতেন। ১৯৬৫-৮০—এ কয় বছর নিয়মিত ইংরেজি রপ্ত করার চেষ্টা করে গেছেন। ভীষণ আক্ষেপ ছিল ইংরেজি মিডিয়ামে না পড়ায় ইংরেজি বলাটা রপ্ত হয়নি বলে। তাড়াতাড়ি জীবন–জীবিকায় ঢুকতে হয়েছিল বলে যথেষ্ট পড়তে পারেননি। এটা নিয়ে খুব মন খারাপ করতেন উত্তমকুমার। আবৃত্তি করতেন নিজের মতো করে। সংস্কৃত ছিল উত্তমকুমারের প্রিয় বিষয়। প্রতিদিন পূজার সময় সংস্কৃত পড়তেন। পূজার মন্ত্র পড়ে পড়ে মুখের জড়তা কাটাতেন।
উত্তমকুমারের মৃত্যুর দুই দিন পর, ১৯৮০ সালের ২৬ জুলাই পশ্চিম বাংলার দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত সত্যজিত্ রায়ের ‘অস্তমিত নক্ষত্র’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘এটা বলতে পারি যে উত্তমের সঙ্গে কাজ করে যে তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তেমন তৃপ্তি আমার এই পঁচিশ বছরের ফিল্ম জীবনে খুব বেশি পাইনি। উত্তম ছিল যাকে বলে খাঁটি প্রোফেশনাল, রোজকার সংলাপ সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করে কাজে নামত। তার অভিনয় ক্ষমতা ছিল সহজাত।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর দখল ছিল ষোলো আনা। ফলে স্বভাবতই তার অভিনয়ে একটা লালিত্য এসে পড়ত। রোজই দিনের শুরুতে সেদিনকার বিশেষ কাজগুলো সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আলোচনার পর আমাকে নির্দেশ দিতে হতো সামান্যই। সবচেয়ে বড় কথা এই যে নিছক নির্দেশের বাইরেও সে মাঝে মাঝে কিছু সূক্ষ্ম ডিটেল তার অভিনয়ে যোগ করত, যেগুলো সম্পূর্ণ তার নিজস্ব অবদান। এই অলংকরণ কখনোই বাড়াবাড়ির পর্যায় পড়ত না; এটা সব সময়ই হতো আমার পক্ষে একটা অপ্রত্যাশিত উপরি প্রাপ্তি। বড় অভিনেতার একটা বড় পরিচয় এখানেই। “নায়ক”-এর পর “চিড়িয়াখানা” ছবিতে উত্তমের সঙ্গে কাজ করেও একই তৃপ্তি পেয়েছি। “চিড়িয়াখানা” ছিল নায়িকাবর্জিত ছবি, ফলে বলা যেতে পারে, উত্তমের পক্ষে আরও বড় ব্যতিক্রম।’
সে যুগের হিসাব সংখ্যাটা বিশাল, উত্তমকুমার অভিনীত ছবির সংখ্যা ২০২! এর মধ্যে ৩৯টি ছবি ব্লকব্লাস্টার হিট, ৫৭টি সুপারহিট ও ৫৭টি ছবি ব্যবসাসফল হয়েছে। শক্তি সামন্ত পরিচালিত উত্তম অভিনীত হিন্দি ছবি ‘অমানুষ’ ও ‘আনন্দ আশ্রম’ সুপারহিট হয়। এ দুটি ছবিতে তাঁর বিপরীতে ছিলেন সত্যজিতের নায়িকা শর্মিলা ঠাকুর। ‘চিড়িয়াখানা’ ও ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সে বছর (১৯৬৭) তিনি সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৬১ সালে ‘দোসর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যও সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান। ‘হারানো সুর’, ‘হ্রদ’, ‘সপ্তপদী’, ‘নায়ক’, ‘গৃহদাহ’, ‘এখানে পিঞ্জর’, ‘অমানুষ’, ‘বহ্নিশিখা’ ছবির জন্য আটবার বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। এ ছাড়া তিনি অনেক সামাজিক–সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার লাভ করেছেন। উত্তমকুমার চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও সাফল্য পান। ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘বনপলাশীর পদাবলী’, ‘শুধু একটি বছর’সহ বেশ কয়েকটি ছবি তিনি পরিচালনা করেন। ‘উত্তর ফাল্গুনী’সহ বিভিন্ন সফল ছবির প্রযোজকও ছিলেন তিনি। ‘কাল তুমি আলেয়া’ সিনেমার সংগীত পরিচালনাও করেন তিনি।
সূত্র: সুপ্রিয়া দেবীর সাক্ষাৎকার, সত্যজিৎ রায়ের নিবন্ধ, তরুণ কুমারের স্মৃতিচারণায় লেখা।