চিকিৎসকেরা বলেছিলেন অলৌকিক কিছুই বাঁচাতে পারে তাঁকে। সেই আশাতেই বুক বেঁধেছিল দুই বাংলার ভক্তকুল। সৌমিত্র ফিরবেন, আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন। মাতাবেন মঞ্চ। কিন্তু সত্য যে কঠিন। ঠিক এক বছর আগের এই দিনে, ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর চোখের জলে বিদায় নেন অপু। দীর্ঘ ৪১ দিন লড়াইয়ের পর অবশেষে হার মানেন বাঙালির ফেলুদা। কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
পরিণত বয়সেই চলে গেছেন সৌমিত্র। তবু যেন মেনে নিতে পারছেন না অনুরাগীরা। ভুলতে পারছেন না সহশিল্পীরা। মঞ্চে, ক্যামেরার সামনে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে তাঁদের কত স্মৃতি। আজ সোমবার বারবার তাই ফিরে আসছেন সৌমিত্র। কারও কাছে তিনি অপু, কারও কাছে শুধুই সৌমিত্র। আবার কারও কাছে কাকু কিংবা জেঠু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করছেন অনুজেরা।
‘তোমায় নতুন করে কী বলব কাকু? তুমি পথপ্রদর্শক, ভরসার জায়গা, ভালোবাসার জায়গা। তোমার অভিনয় দক্ষতা নিয়ে আমি কি বা বলতে পারি? সেটা তো গোটা দুনিয়া জানে। ভালো থেকো সৌমিত্র কাকু,’ লিখেছেন চিত্রনায়ক প্রসেনজিৎ। সঙ্গে দুজনের একটি ছবি। অগ্রজকে জড়িয়ে ধরেন অনুজ। এক সাক্ষাৎকারে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ক্যারিয়ারের শুরুর দিক থেকে তিনি পাশে পেয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। ঠিক যেমন ছেলের পাশে দাঁড়ান বাবা। শুধু সিনেমার জগতেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও সব সময় সঙ্গে থেকেছেন একে অপরের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার শোক তাই তাঁর কাছে পিতৃহারার শোকের মতোই। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, গোটা ইন্ডাস্ট্রি যাঁকে অভিভাবক মানেন, হারিয়েছেন তাঁর অন্যতম অভিভাবক।
অভিনেতা কৌশিক সেন বেশ বড় একটা স্মৃতিচারণা করেছেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায়। মঞ্চে দুজনের ‘টিকটিকি’ নাটকের স্মৃতিচারণা করে কৌশিক সেন লিখেছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রচুর নাটকের আমি ভক্ত। ওঁর সঙ্গে এক সঙ্গে মঞ্চে বেশ কিছু নাটকও করেছি। কিন্তু ‘টিকটিকি’র আলাদা জায়গা আমার কাছে। আমার সৌভাগ্য, আমি সৌমিত্র জেঠুর সঙ্গে এতে অভিনয় করেছিলাম। নাটকে চরিত্র বলতে আমরা দুজন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীর উত্তরসূরি সত্যসিন্ধু। আমি বিমল। এই নাটকে তিনি অভিনেতা এবং পরিচালক। ফলে প্রথম তিন-চারটি শোতে অভিনয়ের সময়ে দেখতাম জেঠুর অভিনেতাসত্তাকে ছাপিয়ে যেত পরিচালকসত্তা। আমার অভিনয়ের পাশাপাশি ওঁকে দেখতে হতো মঞ্চ, আলো, শব্দের প্রক্ষেপণ, রূপটান—সমস্তটাই। চারটি শোর পরে সবাই মোটামুটি ধাতস্থ। তাই দেখে মঞ্চের সত্যসিন্ধুও যেন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। এবার বেরিয়ে এলেন অভিনেতা সৌমিত্র। কী দাপট মঞ্চে! আমার প্রতিটি সংলাপ বলার পটভূমিকা তৈরি করে দিত ওঁর অভিনয়!
পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘দাদু-নাতির ভালোবাসার গল্প নিয়ে “পোস্ত” বানিয়েছিলাম। ঘটনাচক্রে সেই ছবি মুক্তির আগেই দুর্ঘটনায় সৌমিত্রবাবুর নাতির প্রাণসংশয়ের পরিস্থিতি। এক প্রকার ধরেই নেওয়া হয়েছিল, প্রচারে সৌমিত্রবাবুকে পাওয়া যাবে না। সেভাবেই সবকিছু পরিকল্পনা করছিলাম আমরা। কিন্তু আচমকাই একদিন ফোন করলেন তিনি। ছবির প্রচার কবে, কীভাবে হচ্ছে, জানতে চাইলেন সব। বললেন, কথামতোই উপস্থিত থাকবেন। কাজের প্রতি কোন পর্যায়ের ভালোবাসা থাকলে এমন হওয়া যায়! নতুন করে ভেবেছিলাম সেদিন।’
অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় তাঁর সৌমিত্রজেঠুকে নিয়ে বানিয়েছেন ‘অভিযান’। পরমব্রতর মতে এটি গতানুগতিক বায়োপিক নয়।
স্মরণ করে লিখেছেন, ‘এই শহর, যা আপাদমস্তক শিল্প-সংস্কৃতিতে মোড়া, সেখানে শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই। সবাইকেই একটা দিন কালের নিয়মে চলে যেতে হয়। ওঁকেও হতো। কিন্তু ওঁর মতো একজন ব্যক্তিত্বকে ছাড়া এই কলকাতা শহরকে ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালির কাছে একটা আবেগ, একটা নস্টালজিয়া। কিন্তু সেই বিষয়টাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছে। ওঁর অভাব তো চলচ্চিত্রজগতে থেকে যাবেই। তার চেয়েও আমার ব্যক্তিগত জীবনে একটা আফসোস থেকে যাবে।’
কন্যা ও নাট্যব্যক্তিত্ব পৌলোমী বসুকে নাকি প্রায় বলতেন ‘কাজ করে যাও।’ বাবার সে কথাটি মানার চেষ্টা করছেন পৌলোমী। কাজের মাধ্যমে বাবাকে স্মরণ করেছেন তিনি। তাঁর নাটকের দল ‘মুখোমুখি’ গতকাল কলকাতায় মঞ্চস্থ করেছে ‘টাইপিস্ট’। ম্যুরে সিসগালের মূল ভাবনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাটকটি লিখেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের এই নাটকে দুটি মাত্র চরিত্র: অনিরুদ্ধ হালদার ও ইন্দ্রাণী দাশগুপ্ত। যে চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন দেবশংকর হালদার ও পৌলোমী বসু। ‘টাইপিস্ট’-এর নির্দেশনাও দিয়েছেন পৌলোমী।
পৌলোমী লিখেছেন, ‘গতকাল বাবার লেখা দুটো নাটকে অভিনয় করলাম, এটাই তো তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো। বাবা দীর্ঘ জীবন বেঁচে ছিলেন, কিন্তু প্রায় আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
বলতেন, “কোনো বাধার কাছে মাথা নিচু করবে না। লড়াই করে এগিয়ে যাবে। জীবনে হারজিত থাকবে, তাতে পিছিয়ে আসা নয় কখনো, হারলেও এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় যেন কোনো খামতি না থেকে।” বাবার সেই কথা মনে রেখেই সংসারের সব ঝক্কি সামলেও তাঁর লেগাসিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমার লক্ষ্য। তাঁর নাটক নিয়মিত অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাবও।’ পৌলোমী জানান, বাবার নামে একটা ট্রাস্ট তৈরি করার চেষ্টা করছেন তিনি। যেখানে সৌমিত্রের সব কাজ—লেখা, আঁকা ছবি, নাটক, ভালো সিনেমাগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা করবেন। তিনি লিখেছেন, ‘এটাও জানি অনেক বাধা আসবে, তবু থামার পাত্রী আমি নই, লড়াই আমার থামবে না। বাবাও আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন, আমিও লড়ব।’১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নানান চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে বারবার ভেঙেছেন ও গড়েছেন। চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও মঞ্চ ছিল তাঁর প্রাণের জায়গা। তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। ২০১২ সালে পেয়েছিলেন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ২০০৪ সালে তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’-এ ভূষিত করা হয়।