উত্তম বা সৌমিত্রদের পাশে অভিনেতা রবি ছিলেন নিজের আলোয় অনন্য। সাদাকালো যুগের চলচ্চিত্রের ভুবনে তিনি নিয়ে এসেছিলেন এক অন্য রকম হাওয়া। বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল এ নক্ষত্র পর্দায় কখনো হয়েছেন ‘ধনঞ্জয়’, কখনো ‘শেখর’, কখনোবা ‘বাঘা’। আজ সেই রবি ঘোষের জন্মদিন।
‘এ আপনি কী বলছেন রাজামশাই? গুপীনাথের মাথায় তো রাজকন্যার চিন্তাই আসেনি। এ চিন্তা তো আমার, এ আমার অনেক দিনের সাধ, ছেলেবেলার সাধ।’
সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার শেষ দিকে বাঘার সংলাপগুলো মনে পড়ছে? বাঘার কথা শুনে রাজা বলেছিলেন, মেয়ে তাঁর একটাই। সে দীর্ঘাঙ্গী। ‘আমি কম কিসে?’ বাঘার পাল্টা অনুযোগ। সঙ্গে সঙ্গে গুপী উচ্চতা তুলনা করে বলে, ‘এই যে এতটুক!’
চেহারায় কোনো আভিজাত্য বা নায়কোচিত ছাপ না থাকলেও তাঁর সময়ের সব চলচ্চিত্র পরিচালকের পছন্দের, আস্থার মানুষ ছিলেন ‘বাঘা’ রবি ঘোষ। উত্তম বা সৌমিত্রদের পাশেও নিজের আলোয় অনন্য ছিলেন রবি। সাদাকালো যুগের চলচ্চিত্রে তিনি নিয়ে এসেছিলেন এক অন্য রকম হাওয়া। বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল এ নক্ষত্র পর্দায় কখনো হয়েছেন ‘ধনঞ্জয়’, কখনো ‘শেখর’, কখনোবা ‘বাঘা’। চলচ্চিত্র ছাড়া বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশনেও অভিনয় করেছেন। আজ সেই রবি ঘোষের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে তাঁর ৯২ বছর পূর্ণ হতো আজ। ১৯৩১ সালের ২৪ নভেম্বর রবির জন্ম, কোচবিহারে মামাবাড়িতে।
পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। পূর্বপুরুষেরা ছিলেন বরিশালের মানুষ। সমকালীন অনেক চিত্রসমালোচক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বরিশালের রবি’।
১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে রবি ঘোষের অভিনয় চলচ্চিত্রজগতের একটি মাইলফলক। সত্যজিৎ রায় পছন্দ করতেন রবি ঘোষের অভিনয়। বলতেন, ‘রবির চোখ দুটোই কথা বলে।’
লেখাটা শুরু করেছি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির সংলাপ দিয়ে। আসলে তাঁকে নিয়ে বলতে গেলে সবার আগে এ ছবির কথাই আসে। ১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে রবি ঘোষের অভিনয় চলচ্চিত্রজগতের একটি মাইলফলক। সত্যজিৎ রায় পছন্দ করতেন রবি ঘোষের অভিনয়। সত্যজিৎ বলতেন, ‘রবির চোখ দুটোই কথা বলে।’ ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবির সহশিল্পী অভিনেতা মনোজ মিত্রের ভাষায়, তাঁর একটা বিশেষত্ব ছিল, একটা অনন্যতা ছিল। তাঁর অভিনয়ের জায়গা ছিল ওঁর চোখ। তিনি নিজেই ছিলেন একটা ‘রকম’। উত্তমকুমারকে যেমন দেখা যায়নি কোনো খারাপ চরিত্রে অভিনয় করতে, ঠিক তেমনই রবিদাকে দেখা যায়নি এমন কোনো ছবিতে অভিনয় করতে, যেটা দর্শক নিতে পারেনি।
সমকালীন অনেক অভিনেতার স্মৃতিচারণা, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকারে রবির নামটা এসেছে নানা সময়ে।
রবির পাশে অভিনয় করতে সব সময় ভয় লাগে। আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্য টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে।উত্তমকুমার
স্বয়ং উত্তমকুমার বলেছিলেন, ‘রবির পাশে অভিনয় করতে সব সময় ভয় লাগে। আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্য টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে।’
চেহারাটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো ছিল। ব্যায়ামে মজবুত ওর চমৎকার শরীরে একটা লাবণ্য ছিল। মুখটা ছিল অত্যন্ত অভিব্যক্তিময়। আর চোখ দুটো এত উজ্জ্বল, যে তা লোককে আকর্ষণ করবেই। ওর গলার আওয়াজটাও আমার প্রথম দিন থেকেই খুবই ভালো লেগেছিল।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
‘চুপকে চুপকে’, ‘গুড্ডি’, ‘গোলমাল’, ‘আশীর্বাদ’, ‘বাবুর্চি’, ‘নেমকহারাম’ ছবির পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জি বলেছিলেন, ‘সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে এক শয় এক শ পায় না। রবি পেয়েছিল।’ এক সাক্ষাৎকারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘রবি ঘোষ অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড অভিনেতা, অনায়াসে চরিত্রের মধ্যে ঢুকে সেই মানুষটি হয়ে যান।...প্রথম দর্শনেই ওকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। চেহারাটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো ছিল। ব্যায়ামে মজবুত ওর চমৎকার শরীরে একটা লাবণ্য ছিল। মুখটা ছিল অত্যন্ত অভিব্যক্তিময়। আর চোখ দুটো এত উজ্জ্বল, যে তা লোককে আকর্ষণ করবেই। ওর গলার আওয়াজটাও আমার প্রথম দিন থেকেই খুবই ভালো লেগেছিল। সব মিলিয়ে একটা জ্যান্ত মানুষ।’
আর ‘গল্প হলেও সত্যি’র পরিচালক তপন সিনহা বলেছিলেন, ‘সারা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চলচ্চিত্রাভিনেতা বাস্তবিকই খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনো কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।’ রবি ঘোষও কমেডিয়ান বললে মন খারাপ করতেন। বলতেন, ‘কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনো সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি একজন চরিত্রাভিনেতা।’ তিনি মনে করতেন, যেকোনো চরিত্র ফুটিয়ে তোলাই একজন চরিত্রাভিনেতার কাজ।
কমেডিয়ান বললে মন খারাপ করতেন। বলতেন, ‘কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনো সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি একজন চরিত্রাভিনেতা।’ তিনি মনে করতেন, যেকোনো চরিত্র ফুটিয়ে তোলাই একজন চরিত্রাভিনেতার কাজ।
পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় ছিলেন রবি। বাবার চাকরির সুবাদে সপরিবার থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অভিনয়ের হাতেখড়ি, নেহাত শখের বশে। ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
কলেজে ভর্তি হয়ে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘বন্ধুমন’ নামের একটি নাটকের দল। মহড়া করতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। এসব একেবারেই পছন্দ করতেন না বাবা জীতেন্দ্রনাথ। প্রায়ই রবির মা জ্যোৎস্না রানীকে বলতেন, ‘অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কয়া দিও, ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিল দুর্গাদাস বাড়ুজ্যে, হিরোর মতো চেহারা।’ শেষ পর্যন্ত রবি প্রমাণ করেছিলেন, ওই চেহারায়ও অভিনয় হয়। তবে মায়ের সমর্থন ছিল, তাই বাড়ি থেকে একাধিকবার বের করে দেওয়ার পরও চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন নাট্যচর্চা।
পঞ্চাশের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে উৎপল দত্তের দল লিটল থিয়েটার গ্রুপে কাজের সুযোগ হলো। নাটকে রবি ঘোষ একজন হকার। মঞ্চের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর কাজ। তবে সাড়া ফেলেছিলেন ‘অঙ্গার’ নাটকে।
১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে ছিল ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শো। নাটকে সনাতনের ভূমিকায় ছোটখাটো মানুষটা খনি থেকে উঠে উচ্চ স্বরে বলে উঠেছিলেন, ‘আমি একজন ভূতপূর্ব লোক।’ দর্শকের মন কেড়েছিল সেই সংলাপ। এই নাটকের জন্য ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পান রবি। বাবা এর কিছুই দেখে যেতে পারেননি। ২৫ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। ‘অঙ্গার’ নাটকের অভিনয় দেখে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিনহা ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র জন্য ডাকেন রবিকে। তারপর এগিয়ে যাওয়ার পালা। ১৯৫৩ সালে কলকাতা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সেই অধ্যায় চুকিয়ে পাকাপাকি অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন রবি ঘোষ।
রবির জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল মূলত তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’। ছবিতে এক ভৃত্যের ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি, সেটাই ছিল মূল চরিত্র। একে একে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিতে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। ‘অভিযান’ ছবিতে ট্যাক্সি ক্লিনার, ‘জন অরণ্য’ ছবিতে মিস্টার মিত্র, ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে ধনঞ্জয়, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিতে আমিনুদ্দিন, ‘আগন্তুক’ ছবিতে রঞ্জন, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ছবিতে জ্যোতিষীসহ তাঁর বহু চরিত্র মানুষের মনের মনিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছে।
১৯৫৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ২০৬টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হিন্দিতে ‘সত্যকাম’, ‘সবসে বড়া সুখ’, ‘আজ কি রবিন হুড’, ‘পতং’ ছবিতে এবং মঞ্চে ৩৯টি নাটকে অভিনয় করেন। সিরিয়াস চরিত্রে তাঁকে কম দেখা গেছে। চলচ্চিত্রে বা মঞ্চে বেশির ভাগই কৌতুকনির্ভর চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে। ব্যতিক্রম বিজয় বসুর ‘বাঘিনী’।
পর্দার কমিক এই মানুষই কিন্তু বাস্তব জীবনে ছিলেন গুরুগম্ভীর, ধর্মনিষ্ঠ। একসময় হতে চেয়েছিলেন বডিবিল্ডার, হয়েছিলেনও। পরবর্তীকালে আখড়ায় না গেলেও বাড়িতে নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। কাজ–কর্মেও ছিলেন ভীষণ পেশাদার। শোনা যায়, ‘ঠগিনী’ ছবির শুটিংয়ে একদিন অনেক দেরি করে গিয়েছিলেন। তারপর ঠিকঠাক নিজের কাজটুকু শেষ করেছিলেন। প্যাকআপ হয়ে যাওয়ার পর ইউনিটের সবাই জানতে পেরেছিলেন, সেদিন সকালেই মাকে দাহ করে কাজে এসেছিলেন রবি!
শারীরিক গঠন অভিনয়জীবনে কখনো বাধা হয়ে দেখা না দিলেও বাস্তব জীবনে দু-একবার মুশকিলে পড়েছিলেন। একটা গল্প সত্যজিৎ বলেছেন। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হবে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’।
সত্যজিৎ রায়, তপেন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গেছেন রবি ঘোষও। শপিং করতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়লেন তিনি। জার্মানদের জামা রবির গায়ে কিছুতেই আঁটছিল না। শেষে এক জার্মান নারী তাঁকে নিয়ে গেলেন শিশু কর্নারে। ছোটদের জামা গায়ে পরে বেরিয়ে এসেছিলেন রবি ঘোষ, চোখেমুখে মহা আনন্দ। ঠিক এমনটাই বর্ণনা দিয়েছেন সত্যজিৎ।
১৯৯৭ সালের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয় রবি ঘোষের ‘হাসতে যাদের মানা’। সে বছর ৩ ফেব্রুয়ারি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল মেলার অনেক স্টল। পরদিন ৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎই মারা যান রবি ঘোষ। মৃত্যুর পর সহশিল্পী তপেন চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় এক সংবাদপত্রের প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘দেখছি, রবিদা বইমেলায় কাদা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় হাঁটছেন। শনিবার বইমেলায় জুটি ছিলাম, মঙ্গলবার একা হয়ে গেলাম।’ রবি ঘোষকে নিয়ে বিখ্যাত আলোকশিল্পী তাপস সেনের মূল্যায়নটি অন্য রকম। তাপস সেনের ভাষায়, ‘বহু মানুষের নানান সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিলেন, তা তাঁদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নন, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ।’
শুভ জন্মদিন খাঁটি মানুষ।
সূত্র: উইকিপিডিয়া, অভিক চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত গ্রন্থ ‘আপনমনে’, আনন্দবাজার, জিনিউজ, চলোকলকাতা.কম।