‘জলের গান’-এর সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দের বাড়িতে গত সোমবার হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। বাধ্য হয়ে স্ত্রী ঊর্মিলা শুক্লা ও ১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হতে হয়েছে তাঁকে। দুর্বৃত্তের অগ্নিসংযোগে রাহুলের বাড়িতে থাকা তিন হাজারের মতো বাদ্যযন্ত্র ভস্মীভূত হয়েছে।
ধানমন্ডির এই বাড়িতে রাহুল আনন্দ ও চিত্রশিল্পী ঊর্মিলা শুক্লা দম্পতি ভাড়া থাকেন, সঙ্গে ছেলে তোতা। পুরোনো বাড়িটির কোনো নাম নেই, ভালোবেসে ‘ভাঙাবাড়ি’ নাম দিয়েছেন রাহুল।
গত বছর ‘ভাঙাবাড়ি’ ঘুরে গিয়েছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। ফলে বাড়িটি অনেকের চেনা; বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছিল বাড়িটি।
এ বাড়িতেই ‘জলের গান’-এর বহু গান রচনা ও সুর করেছেন রাহুল আনন্দ। বসবাসের পাশাপাশি বাড়িটিকে স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহার করতেন। এই স্টুডিওতে রেকর্ডিং, মিক্সিং থেকে এডিটিং—সব কাজই করেছে জলের গান।
সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। গতকাল বুধবার সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়িটা যেন কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। পোড়া গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন, শিল্প, সংসার পুড়ে ছাই হয়েছে। দুর্বৃত্তের ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আগুনে বাড়িটির আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
কঠিন সময় পার করছেন রাহুল-শুক্লা দম্পতি। যোগাযোগ করা হলে মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান রাহুল আনন্দ। তিনি লিখেছেন, ‘তবু শান্তি আসুক আমার সোনার দেশে, যেকোনো মূল্যে। সে মূল্য যদি হয় আমার সোনার সংসারের পোড়া ছাই অথবা বাদ্যযন্ত্র পোড়া কয়লার বিনিময়ে, তাতেও দুঃখ নেই। ভালোবাসি বাংলা আর বাংলার মানুষকে, আমি বাংলায় গান গাই।’
জলের গানের এই সংগীতশিল্পীর চাওয়া, ‘সবার ভালো হোক। ভালো থাকুক আমার বাংলাদেশ।’
রাহুল আনন্দের ভাষ্যে, ‘কথা বলার মতো স্বাভাবিক নই আমি। প্রায় তিন হাজার বাদ্যযন্ত্র পুড়ে ছাই। ওরা আমার সন্তানের মতো। আমি একটা মানুষ বাচ্চাকে জীবিত নিয়ে বের হতে পেরেছি। বাকিরা পুড়েছে বা লুট হয়েছে।’
১৪০ বছরের পুরোনো বাড়িটি নিয়ে ২০২৩ সালে হাল ফ্যাশনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘পুরোনো বাড়ির গা ঘেঁষে নানান গাছপালা ঘিরে আছে, সেখানে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। লম্বা বারান্দায় ঝুলছে সলতে দেওয়া কুপিবাতি, হারিকেন, পুরোনো চিঠির বাক্স, গাছ কিংবা নানা চিত্রকর্ম। একতলা বাড়ির বারান্দার আরেক কোণে সাজানো পিতল আর কাঠের তৈরি নানা শৈল্পিক সামগ্রী। ঝুলছে দোতারাও। একটা ভিনটেজ আমেজ আছে এ বাড়িটায়।’
বাড়ির আনাচকানাচে ছড়িয়ে ছিল নানা শিল্পকর্ম। রাহুল আনন্দ ও তাঁর স্ত্রী—দুজনই চারুকলায় পড়েছেন। একমাত্র ছেলে তোতাও মা-বাবার মতোই শিল্পমনা।
এই বাড়িতে রেকর্ড করা শেষ গানটি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন জলের গান। ব্যান্ডটি লিখেছে, ‘এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসতবাড়ি ছিল না; ছিল পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সুর আর দাদার ভাবনাপ্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র।’
জলের গান লিখেছে, ‘যাঁরা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তাঁরা জানেন, রাহুল আনন্দ ও ঊর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সব সময় খোলাই থাকত। তাতে তালা দেওয়া হতো না।’
‘তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ?’ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন ছুড়েছে জলের গান।
রাহুল আনন্দ ও জলের গানকে বরাবরই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সরব দেখা গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে ঢাকার রবীন্দ্রসরোবরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
শিল্পীদের নিন্দা
রাহুল আনন্দের বাড়িতে হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন শিল্পীরা। শিরোনামহীনের দলনেতা জিয়াউর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এই লজ্জা কোথায় রাখি! একজন আর্টিস্টের বাসায় এই আক্রমণ, লুটপাট। দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি করা, যত্ন করা ইনস্ট্রুমেন্টগুলো সব লুটপাট করে নিয়ে গেল। অনেক ইনস্ট্রমেন্ট আমার চোখের সামনে তৈরি হওয়া। আপাদমস্তক আর্টিস্ট এই মানুষটাকে কী ভয়াবহ ঘটনা পাড়ি দিতে হলো। শিরোনামহীনের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানাই। যারা এই পাশবিক কাজ করেছে, তাদের প্রতি ঘৃণা। আমার বন্ধু এবং তার পরিবারকে এক কাপড়ে বের হয়ে যেতে হয়েছে। ভুলব না এই অন্যায়।’
এক ফেসবুক পোস্টে সংগীতশিল্পী অর্ণব লিখেছেন, ‘এটা বড় একটা ক্ষতি, মেনেই নিতে পারছি না! মারাত্মক ভুল। আমরা সত্যিই দুঃখিত। রাহুল আপনার সঙ্গে আছি। তারা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে রাহুলের দুর্দান্ত সব বাদ্যযন্ত্র ছিল।’ গীতিকার লতিফুল ইসলাম শিবলী ফেসবুক লিখেছেন, ‘শিল্পী রাহুল আনন্দের ব্যাপারটা (হামলা ও লুটপাট) খুবই দুঃখজনক। এটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারি না। নিন্দা জানাই।’