সেবার কলকাতায় কনকনে শীত। ডিসেম্বরে বড়দিন উপলক্ষে কলকাতা উৎসবমুখর। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কলকাতার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নন্দনের সামনে। প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর বেশভূষা দেখে। একেবারে যেন ছবিতে দেখা সান্তা ক্লজ। স্থানীয় কয়েকজন শিল্পী বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের দুজনের দিকে দুটো লজেন্স এগিয়ে দিলেন। শুনলাম তিনি যেমন সবার প্রিয় কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী; কাছের মানুষেরা তাঁকে ‘লজেন্স কবি’ বলেও ডাকে। অনেকে আবার ‘লাল পাহাড়ি’ বলেও ডাকেন। তিনি দুই বাংলার বহুল চর্চিত গান ‘লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা’ গানের গীতিকার।
ডিসেম্বরের শেষ দিকটায় তিনি কলকাতায় থাকেন। পুরোনো কলকাতায় ঘুরে বেড়ান। আড্ডা দেন নন্দনে, পার্ক সার্কাসে, চার্চে। ধর্মতলায়ও দেখা যায়। বেশি দেখা যায় নন্দন চত্বরে।
পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তবে একসময় সরকারি চাকুরে অরুণ কুমার চক্রবর্তী পুরোদস্তুর কবি। লিখতে, পড়তে ও বলতে ভালোবাসেন তিনি। আড্ডাবাজ। বেশ খানিকটা সময় আড্ডা দিয়েছিলাম শীতের সন্ধ্যায়।
জানালাম, তাঁর লেখা লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা’ গানটি আমাদের দেশেও খুব জনপ্রিয়। হেসে নিজেই জানালেন গানের ইতিহাস, ‘জানেন তো এই এটা মূলত কবিতা। একটা গাছের চারা নিয়ে লেখা। কবিতাখানার জন্ম হয়েছিল শ্রীরামপুরে।’ ৫০ বছর আগে লেখা কবিতা, ১৯৭২ সালে। অরুণ কুমার বলেন যান, ‘স্টেশনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই মহুয়া ফুলের গন্ধ। দেখলাম ফুলভর্তি একটা মহুয়াগাছ। দৃশ্যটা আমাকে কেন জানি অবাক করেছে। মনে হলো, আচ্ছা এ গাছটি এখানে কেন? এত জঙ্গলে থাকার কথা। এটা হবে জঙ্গলের রানি। এখানে, এ রেলস্টেশনে তো একে মানাচ্ছে না। জঙ্গলমহলেই তাকে মানায়। আর সেখানে বসেই লিখে ফেললাম এ কবিতা। ‘হাই দ্যাখ গো/তুই ইখানে কেনে/ও তুই লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা/রাঙামাটির দ্যাশে যা হেথাকে তুকে মানাইছে নাইরে/ইক্কেবারে মানাইছে নাইরে...।
১৯৭২ সালে জন্ম নেওয়া এই কবিতাটিতে সুরারোপ করেন সেই সময়ের তরুণ গায়ক বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের সুভাষ চক্রবর্তী, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে। সুভাষ চক্রবর্তী এই গানটি মঞ্চে মঞ্চে গান। মুখে মুখে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৬ সালে তখনকার নাম করা সুরকার ভি বালসারার সংগীতায়োজনে এই গানটির রেকর্ড বের হয়।
এরপর বাউলেরা এই গানটিকে তাঁদের নিজের করে নেন ভালোবাসা দিয়ে। তখন পর্যন্ত এই গানটির নাম ছিল ‘শ্রীরামপুর ইস্টিশনে মহুয়াগাছটা’। বাউলেরা অরুণ কুমার চক্রবর্তীকে গানটি বড় করার অনুরোধ জানালে তিনি ‘লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা’ নামে আবার লেখেন এবং নতুন করে সুর করেন।
কলকাতার স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অরুণ কুমার চক্রবর্তী সারা জীবনই কবি বা বাউলের মতো চলাফেরা করেছেন। মাঝেমধ্যে হুটহাট হারিয়ে যান। তখন মোবাইলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ইচ্ছা হলে ফোন রিসিভ করেন, ইচ্ছা না হলে করেন না। কর্মজীবনে প্রকৌশল বিভাগের উচ্চপদে ছিলেন। তবে তাঁর চলাফেরা মূলত চিত্রশিল্পী, হকার, ফুলবিক্রেতা, মাছবিক্রেতা, বইয়ের দোকানদার, ফুচকাওয়ালাদের সঙ্গে। এমনটি নিজেই বলেছেন এই প্রতিবেদককে। বললেন, জানেন তো, আমি সারা জীবন তো বাইরে বাইরে কাটিয়েছি। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা, সোমনাথ থেকে কোহিমা। বাউলের মতো ঘুরে বেড়ানোতেই আমার আনন্দ।’ তবে মাঝেমধ্যে একদম নির্জনতা বেছে নেন। মেডিটেশন করেন নিয়মিত। এ কারণে নির্জনতাকেই কিছুদিনের জন্য নির্ধারণ করে ফেলেন। ওই সময়টা কারও সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। তবে শীতে কলকাতায় আসা তাঁর চাই।
বয়সে তুলনামূলক নবীনদের সঙ্গেই তাঁর বন্ধুত্ব, আড্ডা। নিজেকে তরুণ করা এই কবির চলাফেরা একবারেই সাদামাটা। পকেটে সব সময় লজেন্স রাখেন। কারও সঙ্গে দেখা হলে হ্যান্ডশেক করে একটি চকলেট উপহার দিয়ে স্বাগত জানান। নানা বিষয়ে লেখালেখি করেন। রাজনীতি, শিক্ষা থেকে শুরু করে লোকসংগীত, সাধারণ মানুষের কথা। সবচেয়ে বেশি লেখেন প্রান্তিক মানুষ নিয়ে।
ভারতের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। কলকাতায় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, কবি মাইকেল মধুসূদন, কবি ভারতচন্দ্র, কবি জীবনানন্দ, লালন কবি শিরোমণি পুরস্কার। পাশাপাশি ইন্দো-বাংলাদেশ সাহিত্যে পুরস্কার, বাংলাদেশ, সহজিয়া ফাউন্ডেশন সম্মান।
স্ত্রী, দুই ছেলে, ছেলেদের স্ত্রী, দুই নাতিসহ তাঁর যৌথ পরিবার। সবাই মিলে একসঙ্গে থাকেন। তাঁর ভাষায়, এ আমার পরম পাওয়া। না কোনো ছেলে বিদেশে যায়নি, অন্য শহরে যায়নি। আমৃত্যু আমি পড়ে থাকব এই বাংলায়।’