দুঃস্বপ্নের শৈশব পেরিয়ে রক অ্যান্ড রোলের রানি হয়ে ওঠা

টিনা টার্নার
এএফপি ফাইল ছবি
শৈশবে বাবা-মার ছেড়ে যাওয়া, বিয়ের পর স্বামীর নির্যাতন—কিছুই থাকে থামাতে পারেনি তাঁকে। ঠিকই হয়ে ওঠেন রক অ্যান্ড রোলের রানি। তিনি মঞ্চে উঠলে চোখ ফেরানো ছিল প্রায় অসম্ভব। যেমন কণ্ঠ, তেমনি পারফরম্যান্স। নাচ–গানের তালে তাঁর আবেদনময়ী অবতার কে ভুলতে পারে। গত শতকের অন্যতম জনপ্রিয় সেই গায়িকা টিনা টার্নার মারা গেছেন গতকাল। এএফপি অবলম্বনে আলো ফেলা যাক তাঁর ক্যারিয়ারে।
টিনা টার্নার

টেনেসির তুলার খেত থেকে রক অ্যান্ড রোলের রানি
১৯৩৯ সালের ২৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসির নাটবুশে জন্ম। বাবা–মা নাম রেখেছিলেন আনা মাই বুলক। বাবা কাজ করতেন স্থানীয় এক ফার্মে। শৈশবে পরিবারের সঙ্গে টেনেসির তুলার ক্ষেত্রে কাজ করার স্মৃতি পরে মনে করতে পেরেছিলেন টিনা টার্নার। তবে তাঁর শৈশব ঠিক স্বাভাবিক ছিল না।
বাবা–মা দুজনই ছেড়ে গিয়েছিলেন। দাদি ছিলেন, তিনিই মৃত্যু পর্যন্ত দেখভাল করেছেন। আনার বয়স যখন ১৬, মিজৌরিতে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে যান। এখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় গিটারিস্ট ইক টার্নারের সঙ্গে। আট বছরের বড় ইক তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। আনাই ইককে রাজি করান তাঁর সঙ্গে গাইতে। ১৯৬০ সালে হিট গান ‘আ ফুল ইন লাভ’ দিয়ে আনাকে শ্রোতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ইক। ইকই আনার নাম দেন টিনা টার্নার। দুজন মিলে ‘ইক অ্যান্ড টিনা টার্নার’ নামে পারফর্ম করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে দুজন বিয়েও সেরে ফেলেন। পরের গল্পটা তাঁদের দুজনের। ষাটের দশকের শুরু থেকে সত্তরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দুজন একরকম ‘শাসন’ করেন বিশ্বসংগীতের দুনিয়া।

স্বপ্নের মতো সময়  
ষাটের দশকটা ছিল ইক ও টিনাময়। ‘ইটস গনা ওয়ার্ক আউট ফাইন’, ‘আই আইডোলাইজ ইউ’, ‘পুওর ফুল’, ‘ট্রা লা লা লা লা’–এর মতো গান উপহার দেন। তবে এগুলোকে তাঁদের প্রাথমিক সাফল্য বলা যায়। সব হিসাব–নিকাশ বদলে যায় ১৯৬৬ সালে, মুক্তি পায় এই জুটির বিখ্যাত সেই গান ‘রিভার ডিপ-মাউন্টেন হাই’। রক অ্যান্ড রোল সংগীতকে যে ৫০০ গান বদলে দিয়েছে সে তালিকায় আছে গানটি। রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম করে তালিকাটি। ১৯৬৮ সালে এই সংগীত জুটি ব্লু থাম্ব রেকর্ডসের সঙ্গে চুক্তি করেন; ‘আউটা সিজন’ অ্যালবামটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। এরপর একে একে ‘দ্য হান্টার’, ‘কাম টুগেদার’, ‘ওয়াকিং টুগেদার’, ‘ফিল গুড’-এর মতো অ্যালবাম উপহার দিয়েছেন তাঁরা। তবে একসময় ভেঙে যায় তাঁদের জুটি।

টিনা টার্নার

দুঃস্বপ্নের দিনরাত
টিনা ছিলেন আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্ব, যখন যেখানে হাজির হতেন, সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিতেন। মঞ্চে তাঁর পারফর্ম ছিল আকর্ষণীয়, গান আর নাচে জাদুবন্দী করে রাখতেন দর্শককে। তবে স্বামী ইকের সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে, যার প্রভাব পড়ে গানেও। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে ইক কোকেনের নেশায় ডুবে যান। স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন টিনা। পরে ১৯৭৬ সালের জুলাইয়ে একটি ট্যুরে মাঝপথে পকেটে মোটে ৩৬ সেন্ট সম্বল করে স্বামীকে ছেড়ে চলে আসেন টিনা। বেছে নেন স্বাধীন জীবন। ২৭ জুলাই করেন বিচ্ছেদের আবেদন। তাঁদের বিচ্ছেদ হওয়ার পরও ইক ও টিনার দুটি অ্যালবাম মুক্তি পায়।

এভাবেও ফিরে আসা যায়
বিচ্ছেদের পর একের পর এক টিভি শো করতে থাকেন টিনা টার্নার, মূল উদ্দেশ্য দেনা শোধ। পারফর্ম করেন ক্যাবারেও। ১৯৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম একক কনসার্ট করেন। ১৯৭৮ সালে মুক্তি দেন একক অ্যালবাম ‘রাফ’, পরের বছরই আসে আরেকটি অ্যালবাম ‘লাভ এক্সপ্লোশন’। তবে তখন টিনা টার্নার হয়ে ওঠেননি, তিনি ছিলেন এক নস্টালজিয়ার নাম, যে কিনা নিজের পুরোনো গানগুলোর মধ্যেই বেঁচে আছেন। প্রায় সবাই যখন তাঁর শেষ দেখে নিয়েছেন, তখনই ফিরে আসেন টিনা।

টিনা টার্নার

১৯৮৩ সালে ক্যাপিটল রেকর্ডসের সঙ্গে চুক্তি করেন, একই বছর মুক্তি পায় এল গ্রিনের কাভার ‘লেটস স্টে টুগেদার’। জনপ্রিয়তা পায় গানটি। কাভার গানের বিস্ময়কর সাফল্যের পর ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায় টিনার পঞ্চম অ্যালবাম ‘প্রাইভেট ড্যান্সার’। এটিই তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। বিলবোর্ড ২০০ চার্টে টানা ১০ সপ্তাহ গানটি ৩ নম্বরে ছিল, সেরা দশে ছিল ৩৯ সপ্তাহ। বিশ্বজুড়ে ১২ মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয় অ্যালবামটির। পরের বছরের গ্র্যামিতে ছয় মনোনয়ন পান টিনা, জেতেন চারটি। এরপর আর টিনাকে থামায় কে! পরে একে একে মুক্তি পায় ‘ব্রেক এভরি রুল’, ‘ফরেন অ্যাফেয়ার’, ‘ওয়াইল্ডেস্ট ড্রিমস’ ইত্যাদি অ্যালবাম। এই ‘ফরেন অ্যাফেয়ার’ অ্যালবামেই ছিল তাঁর তুমুল জনপ্রিয় ‘দ্য বেস্ট’ গানটি।

টিনা টার্নার ঞ্চে উঠলে চোখ ফেরানো ছিল প্রায় অসম্ভব

দ্য বেস্ট
বিশ্বজুড়ে ১০০ মিলিয়নের বেশি বিক্রি হয়েছে তাঁর অ্যালবাম, সর্বকালের সেরা বেস্ট সেলিং শিল্পীদের একজন বলা হয় তাঁকে। ২০০৪ সালে মুক্তি পায় টিনা টার্নারের সেরা গানগুলোর সংকলন ‘অল দ্য বেস্ট’। যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, যুক্তরাজ্যসহ আরও সাতটি দেশে রেকর্ডসংখ্যক বিক্রি হয় অ্যালবামটি। ২০০৮ সালে দীর্ঘদিন পর পারফর্ম করেন টিনা টার্নার, বিয়ন্সের সঙ্গে গ্র্যামির মঞ্চে দেখা যায় তাঁকে। ২০০৯ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন।

তারকাদের শোক
টিনা টার্নারের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান বিনোদন–দুনিয়া। কিংবদন্তি এই গায়িকার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পীরা। শোক জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। রোলিং স্টোনস ব্যান্ডের দল নেতা মিক জ্যাগার বলেছেন, ‘অসম্ভব প্রতিভাবান শিল্পী ও পারফরমার ছিলেন তিনি। তরুণ বয়সে তিনি আমাকে যেভাবে সাহায্য করেছেন, কখনো ভুলতে পারব না।’ আরও শোক জানিয়েছেন অভিনেতা মেল গিবসন, গায়িকা মারায়া ক্যারি, অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলা বাসেট, যিনি ১৯৯৩ সালে গায়িকার বায়োপিক ‘হোয়াটস লাভ গট টু ডু উইথ ইট’-এ তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

টিনা টার্নারের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান ভক্তরা

অন্য টিনা
গানের বাইরে অভিনয়ও করেছেন টিনা টার্নার। তাঁকে দেখা গেছে ‘ম্যাড ম্যাক্স বিয়ন্ড থান্ডারডম’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমায়। ২০২১ সালে তাঁকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘টিনা’ মুক্তি পায় এইচিবিওতে।

সেরা দশ
দীর্ঘ পাঁচ দশকের ক্যারিয়ারে অনেক গানই করেছেন টিনা টার্নার। মৃত্যুর পর শিল্পীর সেরা ১০টি গান বেছে নিয়েছে দ্য গার্ডিয়ান। একনজরে দেখে নেওয়া যাক গানগুলোর তালিকা।

২০০৮ সালে দীর্ঘদিন পর পারফর্ম করেন টিনা টার্নার, বিয়ন্সের সঙ্গে গ্র্যামির মঞ্চে দেখা যায় তাঁকে

আই হ্যাভ বিন লাভিং ইউ টু লং (ইক টার্নারের সঙ্গে দ্বৈত)
হোল লটা লাভ
লেটস স্টে টুগেদার
প্রাইভেট ড্যান্সার
আই ডোন্ট ওয়ানা ফাইট
নাটবুশ সিটি লিমিটস
উই ডোন্ট নিড এনাদার হিরো
প্রাউড মেরি
হোয়াটস লাভ গট টু ডু উইথ ইট
রিভার ডিপ-মাউন্টেন হাই