এ দেশে পপসংগীতকে তুমুল জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টায় যিনি অগ্রণী, তিনি আজম খান। এ কারণেই তাঁর নামের আগে ব্যবহৃত হয় ‘পপসম্রাট’। তাঁর গাওয়া অসংখ্য গান তরুণ তো বটেই, সব ধরনের শ্রোতার পছন্দের তালিকায় রয়েছে। সেই তালিকা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে পাঁচটি গান। জীবনকালে আজম খান এসব গান সৃষ্টির পেছনের গল্প বলেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া গীতিকার কবির বকুলের কাছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী আজম খানের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করে গানের গল্পগুলো আবার শুনি। প্রথম পর্বে রইল ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’ গানটির গল্প।
পাপড়ি কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়। এটা বাস্তব। ১৯৭৫ সালের কথা। পাপড়িদের পরিবার ভাড়া থাকত ঢাকার কমলাপুরে, ১২ জসীমউদ্দীন রোডে, আমার বড় ভাইয়ের বাড়ির দোতলায়। তখন ওর উঠতি বয়স। পাড়ার ছেলেরা ওকে দেখলেই এটা-সেটা বলত, বিরক্ত করত। মহল্লার ছেলে হিসেবে আমার একটু দাপট ছিল। যখন শুনলাম পাপড়িকে দেখলে পোলাপান ইয়ার্কি-ফাজলামো করে, তখন একটু রাগই হলো। একদিন ওদের ডেকে ধমক দিয়ে বললাম, আর কোনো দিন যেন ওর দিকে চোখ তুলে না তাকায়।
এর পর থেকে পাপড়ির সবকিছু খেয়াল রাখা যেন আমার প্রতিদিনের কাজ হয়ে গেল। এই করতে করতে কখন যে আমি নিজেই ওকে ভালোবেসে ফেলেছি, টের পাইনি। টের পেলাম তখন, যখন পাপড়িও আমাকে ভালোবাসতে শুরু করল। কিন্তু আমাদের দুই পরিবারের কেউ এটা মেনে নিতে পারল না। একদিন পাপড়ি আমাকে বলল, ‘চলো, আমরা পালিয়ে যাই।’
কিন্তু বিষয়টা আমার পছন্দ হলো না। মেয়ের মতিগতি ভালো ঠেকল না ওর মায়ের। তিনি কিছু একটা আঁচ করতে পেরে পাপড়ির ঘরে তালা মেরে দিলেন। ঘরের ভেতরই খাওয়াদাওয়া। বাইরে যাওয়া বন্ধ। একদিন সকালে দেখি ওরা বাসা বদলাচ্ছে। এরপর পাপড়িরা চলে গেল। কই গেল, জানতেও পারলাম না। আমার আর কিছুই ভালো লাগে না। সকাল ভালো লাগে না, বিকেল ভালো লাগে না, রাত ভালো লাগে না।
আমার এক বন্ধু অনু। ওর প্রেমিকা ছিল জলি। অনুরও আমার মতো দশা। আমরা দুজন মিলে দুঃখ ভাগাভাগি করি। ওই সময়ই আমি গানটা বানাই। ‘সারা রাত জেগে কত কথা ভাবি আমি।’ দুঃখমনে সেই গান গাই। আর পাপড়ির কথা মনে করি।
হঠাৎ একদিন মনে হলো, গানটা পাপড়ির মা শুনে যদি বলে, ‘আমার মেয়েরে নিয়া গান করছ কেন?’ এ জন্য মনে মনে উত্তর ঠিক করলাম যে ওনাকে তখন বলব, ‘আমি চোখের পাপড়ির কথা বলছি। পাপড়ি কেন বন্ধ হয় না। এই কারণে ঘুম আসে না।’ গানটার সৃষ্টি ১৯৭৫ সালে। কিন্তু গানটা বিটিভিতে প্রথম গাই ১৯৭৭ সালে। তারপর তো গানটা সুপারহিট।
১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সালে আমি চট্টগ্রামে একটা অনুষ্ঠানে গান গাইতে গেছি। হঠাৎ এক লোক এসে আমাকে বলল, ভাই, একজন ভদ্রলোক আপনাকে খুঁজছে। আমি দেখা করলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি পাপড়ির স্বামী।’ তিনি আমাকে জোর করে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। পাপড়ির সঙ্গে আবার আমার দেখা হলো ১০ বছর পরে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই খুব রসিক। ওদের বাসায় খাওয়াদাওয়া করলাম। এরপর পাপড়ি বলল, ‘চট্টগ্রামে এলে আমার বাসায় ছাড়া অন্য কোথাও উঠতে পারবেন না।’ গানের প্রসঙ্গও এল।
‘পাপড়ি’ গানটা নিয়ে নাকি ওকে সবাই খেপায়। যা-ই হোক, সেই থেকে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত। পাপড়িরা ঢাকায় এলে আমার বাসায় আসে। আমার মেয়েরা ওর বাড়িতে যায়। পাপড়ি এখন দাদি হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। (আমার ‘বাধা দিয়ো না’ গানটিও পাপড়িকে নিয়েই লেখা।)
পুরো গানটি এখানে রইল
সারা রাত জেগে জেগে
কত কথা আমি ভাবি
পাপড়ি কেন বোঝে না
তাই ঘুম আসে না
পাপড়ি কেন বোঝে না
তাই ঘুম আসে না
তুমি আমি কেন দূরে দূরে
খুঁজে বেড়াই ঘুরে ঘুরে
মন কি যে চায়
কাঁদে শুধু বেদনায়
এই মায়াভরা পৃথিবী ছেড়ে
চলে যাব চিরতরে
সবাই চলে যায়,
কতটুকুই–বা পায়।
(দ্রষ্টব্য: ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে লেখাটির বড় অংশ ছাপা হয়েছিল)