‘চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়’—স্লোগানটি ঢাকার অনেক দেয়ালেই দেখা যায়। দেয়াল টপকে মিছিল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এখন আলোচিত এই স্লোগান। স্লোগানটির উৎস খুঁজেছেন মকফুল হোসেন
নারী নিপীড়নবিরোধী মিছিল থেকে ভেসে আসে, ‘চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়/আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশজুড়ে স্লোগানটি শোনা যায়। চলমান নিপীড়ন ও ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মধ্যেও স্লোগানটি মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
গত কয়েক বছরে নিপীড়নের প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি মিছিলে ছিলেন তরুণ সংগীতশিল্পী ইলা লালালালা। স্লোগানটি নিয়ে গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক তরুণ মিছিলে আসেন, তাঁরা স্লোগানটির সঙ্গে সহজেই রিলেট (সম্পৃক্ত) করতে পারেন। স্লোগানটি প্ল্যাকার্ডেও আমরা লিখি।’
প্ল্যাকার্ডের পাশাপাশি ‘চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়’ নিয়ে পোস্টারও আঁকা হয়েছে। গত বছরের আগস্টে শিল্পী দেবাশিস চক্রবর্তীর আঁকা একটি পোস্টার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল।
গান থেকে স্লোগান
ঢাকায় স্লোগান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া কথাগুলো আসলে কলকাতার একটি গানের মুখরা। ‘চিৎকার কর মেয়ে’ শিরোনামে গানটির স্রষ্টা কলকাতার গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী আকাশ চক্রবর্তী।
গানটি লেখার পটভূমি জানতে চাইলে আকাশ চক্রবর্তী গত বুধবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পার্কস্ট্রিটে ধর্ষণের ঘটনায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা ভুলভাল মন্তব্য করেছিলেন। শাসকদলের ঘনিষ্ঠ একজনের হাত ধরে ধর্ষক পার পেয়ে যাচ্ছিলেন। সেটা দেখেই গানটা লিখেছি।’
লেখার পর প্রাণ পেতে গানটির কয়েক মাস লেগেছিল। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লিতে নির্ভয়া ধর্ষণের প্রতিবাদে গানটি নিয়মিত গাইতে শুরু করেন আকাশ।
নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও টেলিভিশনে গাইতেন তিনি। ধীরে ধীরে সেটি শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
২০১৩ সালের শুরুতে সংগীতশিল্পী ডোনা গুপ্তর কণ্ঠে গানটি প্রথমবার রেকর্ড করা হয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতিবাদের গান’ অ্যালবামে গানটি প্রকাশের পর শ্রোতামহলে সাড়া ফেলেছিল।
২০১৩ সালের শুরুতে সংগীতশিল্পী ডোনা গুপ্তর কণ্ঠে গানটি প্রথমবার রেকর্ড করা হয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ‘প্রতিবাদের গান’ অ্যালবামে গানটি প্রকাশের পর শ্রোতামহলে সাড়া ফেলেছিল।
২০২৩ সালের এপ্রিলে কলকাতার সংগীত প্ল্যাটফর্ম ‘হাওয়া বদলের গান’-এ প্রথমবার গানটি আকাশের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়।
নিজে কখনো বাংলাদেশে না গেলেও একটা টান আছে। সেখানকার মানুষকে আমার গানের কোনো কথা প্রতিবাদের শক্তি দিচ্ছে, সেটা বড় পাওয়া।আকাশ চক্রবর্তী, গীতিকার, সুরকার ও সংগীতশিল্পী
আকাশের মা ও বাবার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম ও বরিশাল। তবে কখনো বাংলাদেশে আসা হয়নি। তবে তাঁর গান এসেছে।
তিনি জানান, মাঝে একটি আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্লোগানটা লেখা ছিল। বিষয়টি তাঁকে ছুঁয়ে গেছে। আকাশ বলেন, ‘নিজে কখনো বাংলাদেশে না গেলেও একটা টান আছে। সেখানকার মানুষকে আমার গানের কোনো কথা প্রতিবাদের শক্তি দিচ্ছে, সেটা বড় পাওয়া। গানটা তো আনন্দের নয়, দুঃখের ঘটনা থেকে লেখা। ফলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়।’
ঢাকার ‘ভুবন মাঝি’ ও ‘গণ্ডি’ সিনেমায়ও গান লিখেছেন আকাশ চক্রবর্তী। প্রায় এক যুগের ক্যারিয়ারে ‘আইলো উমা বাড়িতে’সহ বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান লিখেছেন তিনি।
কলকাতার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকায় গানের মুখরাটি স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। স্লোগানের পাশাপাশি ঢাকার নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক আয়োজনেও গানটি শোনা যায়।
গানটি কেন ঢাকাকে ছুঁয়ে গেল
কলকাতার গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকায় গানের মুখরাটি স্লোগান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। স্লোগানের পাশাপাশি ঢাকার নিপীড়নবিরোধী সাংস্কৃতিক আয়োজনেও গানটি শোনা যায়।
ঠিক কবে থেকে ঢাকায় স্লোগান ও গানটি নিয়ে চর্চা চলছে, সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত বছর পাঁচেক স্লোগানটি ঢাকায় চর্চিত হয়ে আসছে।
গানের কথা খুবই সহজ, সুর সুন্দর। গাওয়া সহজ। সবকিছু মিলিয়ে গানটার সঙ্গে ঢাকার শ্রোতারা রিলেট (সম্পৃক্ত) করতে পারে।ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান, সংগীতশিল্পী
গানটি নিয়ে সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গানের কথা খুবই সহজ, সুর সুন্দর। গাওয়া সহজ। সবকিছু মিলিয়ে গানটার সঙ্গে ঢাকার শ্রোতারা রিলেট (সম্পৃক্ত) করতে পারে।’ নারী নির্যাতনসহ সব ধরনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার সায়ান।
তাঁর ভাষ্যে, ‘একটা গানের মধ্যে যে কত কিছু আসতে পারে, সেটার উদাহরণ এই গান। দক্ষিণ এশীয় মেয়েদের যে জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে বাঁচতে হয়, তার একটা সারাংশ গানের মধ্যে চলে এসেছে। গানে এই অঞ্চলের মেয়েদের জীবনযাত্রা প্রখরভাবে উঠে এসেছে। গানটা সময়োত্তীর্ণ গান। শুধু ভারতেই নয়, বাংলা ভাষাষাভাষী মানুষ গানটির সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেন।’
চিৎকার কর মেয়ে
কথা ও সুর: আকাশ চক্রবর্তী
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়।
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু ধ্বজা ভাঙা রথে এগিয়ে চলার দায়।
জন্মের আগে মৃত্যু দিয়েছি, জন্মের পরে ভয়;
সকালে-বিকালে শরীর আগলে লুকিয়ে বাঁচতে হয়;
যদি ভুলচুক হয় কোনোভাবে অসাবধানের বশে,
দুই বছরেই ধর্ষিতা তুই, তোরই কিন্তু দোষে
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়।
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু ধ্বজা ভাঙা রথে এগিয়ে চলার দায়।
আরও খানিকটা বড় হলে ওরা ন্যাংটো করবে তোকে;
হোর্ডিংজুড়ে তোর খোলা পিঠ সাপটে গিলবে লোকে;
বিক্কিরি হবে আরও আছে তোর যা কিছু ব্যক্তিগত;
আমরা শুধুই খানিক লোলুপ, খানিকটা বিব্রত
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়।
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু ধ্বজা ভাঙা রথে এগিয়ে চলার দায়।
সম্ভব হলে সূর্যের আলো মাখিসনা চোখেমুখে;
না হলেও খুব চুপিচুপি মাখ, পাছে দেখে ফেলে লোকে;
এরপরও খোলা রাস্তায় ওরা খেয়ে ফেলে গেলে তোকে
প্রশাসন শুধু হাততালি দিয়ে বেশ্যা বলবে তোকেই
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়।
চিৎকার কর মেয়ে, দেখি কত দূর গলা যায়,
আমাদের শুধু ধ্বজা ভাঙা রথে এগিয়ে চলার দায়।