ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে উন্মাদনা ছড়িয়েছে বাংলা র্যাপ গান। পাশাপাশি নজরুলগীতি, ব্যান্ডসংগীতও সঙ্গ দিয়েছে।
তখন রাজপথে লড়ছিলেন শিক্ষার্থীরা। ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় অনেকে চুপ ছিলেন। তত দিনে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের বুক ঝাঁঝরা হয়েছে। সেই অবরুদ্ধ সময়কে গানে ধরেছিলেন নারায়ণগঞ্জের তরুণ র্যাপার সেজান।
গত ১৬ জুলাই প্রকাশিত ‘কথা ক’ গানটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বহুদিন পর এমন জোরালো কথার গান পেলেন শ্রোতারা। সাধারণ মানুষের গিলে ফেলা কথাকে বাংলা র্যাপ গানে প্রাণ দিয়েছেন সেজান। গানে সেজান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমার ভাই–বইন মরে রাস্তায়, তর চেষ্টা কইরে? কথা ক।’
গানটি প্রকাশের দায়ে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল সেজানকে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা ছড়িয়েছে বাংলা র্যাপ গান। অভ্যুত্থানে বাংলা র্যাপ গানের একধরনের উত্থান ঘটেছে। র্যাপ গানের শ্রোতাদের গন্ডি পেরিয়ে সাধারণ শ্রোতাদের ভেতরও ছড়িয়েছে।
আরেক র্যাপ গান ‘আওয়াজ উডা’ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে; গানটি রীতিমতো স্লোগানে পরিণত হয়েছিল। আলোচিত গানটি লিখেছেন ও গেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আরেক তরুণ র্যাপার হান্নান হোসাইন; যিনি র্যাপার সেজানের ভাই।
১৭ জুলাই ‘আওয়াজ উডা’ লিখেছেন হান্নান; সেদিন রেকর্ড করে ১৮ জুলাই ইউটিউবে প্রকাশ করেছেন। এর আগে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হান্নান বলেছেন, ‘গানটা যখন লিখেছি, তখন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ছিলেন। পরে অল্প কিছু অভিভাবকও নেমেছেন। তবে অনেকেই চুপ ছিলেন। কোনো কথা বলছিলেন না, নামছিলেনও না। আওয়াজও তুলতে পারছিলেন না। সেটা দেখেই গানটা লিখেছি।’
গান প্রকাশের পর ছাত্রলীগের নেতারা হান্নানকে হুমকি দিয়েছেন। তাঁকে ধরতে বাড়িতে পুলিশও গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে হান্নানকে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছিল। পরে এক আত্মীয়ের জানাজা থেকে ফেরার পথে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১২ দিন কারাগারে ছিলেন এই র্যাপার।
আন্দোলনের মধ্যে অন্তত ৪০টি বাংলা র্যাপ গান প্রকাশিত হয়েছে। অন্য কোনো ঘরানা থেকে এত গান আসেনি। প্রতিটি বাংলা র্যাপই আন্দোলনে উদ্দীপনা জুগিয়েছে। হান্নানের ভাষ্যে, এই আন্দোলনে বেশির ভাগ র্যাপ গানই ভালো লেগেছে। এর মধ্যে ‘কথা ক’, ‘বাংলা মা’, ‘বায়ান্ন’র মতো গান শুনলে রক্ত গরম হয়ে যায়।
আন্দোলনের মধ্যে প্রকাশিত বাংলা র্যাপ গানের মধ্যে আরও রয়েছে ‘দেশ সংস্কার’, ‘স্বাধীনতার গন্ধ’, ‘ছাত্র’, ‘স্লোগান’, ‘অধিকার’, ‘দেশ কার’, ‘আবু সাঈদ’, ‘রক্ত’, ‘দেশ কারও বাপের না’, ‘জবাব দে’, ‘জয় বাংলা’, ‘কত খাবি’, ‘শকুনের চোখ’।
ফিরে ফিরে আসা গান
তত দিনে জুজুর ভয় ভেঙে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জনতাও রাজপথে নেমে আসে। কারফিউর মধ্যে দেশজুড়ে পুলিশের গুলিতে ছাত্র–জনতার হতাহত হওয়ার খবর আসতে থাকে। এর প্রতিবাদে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ কণ্ঠে তুলে রাজপথে নেমে আসে ঢাকার কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গের গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর লেখা কালজয়ী এই গান ঢাকার আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে।
আন্দোলনে গানটি নিয়ে চর্চার মধ্যে নুর হাসান নামের এক শ্রোতা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যতবারই এই গানটি শুনেছি, ততবারই চোখ দিয়ে পানি পড়েছে, ততবারই আরও সাহসী হয়েছি, ততবারই হাল না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করেছি।’
আন্দোলনজুড়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ ছাত্র–জনতাকে সাহস জুগিয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ নিয়ে চর্চা হয়েছে।
প্রিন্স মাহমুদের কথায় জেমসের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’, ওয়ারফেজের ‘জনস্রোত’, শিল্পী হায়দার হোসেনের ‘স্বাধীনতা’, মাকসুদের ‘আবার যুদ্ধে যেতে হবে’, শূন্য ব্যান্ডের ‘শোনো মহাজন’সহ আরও কয়েকটি পুরোনো গান আন্দোলনের মধ্যে চর্চায় এসেছে।
এর বাইরে সোহেল আরমানের লেখা, হাবীব ওয়াহিদ, আরফিন রুমি ও প্রদীপ কুমারের গাওয়া ‘হৃদয় আমার বাংলাদেশ’, ইথুন বাবুর লেখা ও মৌসুমীর গাওয়া ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ও নিয়মিত বেজেছে।
নতুন গানও আছে
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরব ছিলেন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। আন্দোলনের মধ্যে ‘ভয় বাংলায়’ শিরোনামে একটি গানও এনেছেন তিনি।
আন্দোলনের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের ‘এই শিকল পরা ছল’ গেয়েছেন শেখ ইশতিয়াক, শাকিব চৌধুরী, রায়েফ আল হাসান রাফা, প্রবর রিপন ও জামশেদ চৌধুরী। গানের মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্যও জানিয়েছেন তাঁরা। গানের ভিডিও চিত্রে শেখ ইসতিয়াক বলেছেন, ‘আমি ধিক্কার জানাই এই সমাজকে, যে সমাজে কোনো বাক্স্বাধীনতা নাই। কথা বলতে গেলে গুলিবর্ষণ হয় ছাত্রদের ওপর। ধিক্বার জানাই।’
আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীদের উৎসর্গ করে অনি হাসান প্রকাশ করেছেন ‘আমরা বীর’। শহরতলী ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সোহাগ গেয়েছেন ‘ও প্রধান’। তরুণ গায়িকা পারশা মাহজাবীনের ‘চলো ভুলে যাই’ ভাইরাল হয়েছিল।