বাংলা চলচ্চিত্রে কিছু কালজয়ী রোমান্টিক গান রয়েছে। রোমান্টিক গানের কথা এলে মুহূর্তেই সামনে চলে আসে গানগুলো। অজান্তেই তা গুনগুন করে ওঠে মন। নিজেকে নিয়ে যায় পুরোনো দিনগুলোতে। কিংবা তা নতুন করে শোনাতে ইচ্ছা হয় ভালোবাসার মানুষটিকে। গানের স্রষ্টারা বাংলা চলচ্চিত্রে খুব জনপ্রিয় হওয়া তেমনই কিছু গানের গল্প শুনিয়েছিলেন গীতিকবি কবির বকুলের কাছে। আজ ভালোবাসা দিবসে পাঠকদের জন্য সেই গল্প আবার প্রকাশ করা হলো।
‘ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি’
রাজ্জাক পরিচালিত প্রথম ছবি ‘অনন্ত প্রেম’-এর গান। খুরশীদ আলম ও সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া এ গানের কথা লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুর করেছেন আজাদ রহমান। তাঁর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের বাড়িতে এ গানের সৃষ্টি। রাজ্জাক বলেন, ‘ছবিতে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফেরারি আসামি নায়ক (রাজ্জাক) নায়িকাকে (ববিতা) নিয়ে পালিয়ে যায়। তারা একটি পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেই একটি কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকে। নায়িকা প্রথম থেকেই নায়কের প্রেমে পড়লেও নায়ক তখনো প্রেমে পড়েনি। একটা সময় সে প্রেমে পড়ে। দুজনার ভালোবাসার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে এই গান। কাপ্তাইয়ের একটি উঁচু ফরেস্ট হিলে, কর্ণফুলীর একটি হ্রদে গানটির দৃশ্যায়ন হয়েছিল।’
‘তুমি যে আমার কবিতা’
নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘দর্পচূর্ণ’ ছবির গান। গানের কথা লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সুর করেছেন সুবল দাস। রাজ্জাক ও কবরীর ঠোঁট মেলানো গানটি গেয়েছেন মাহমুদুন নবী ও সাবিনা ইয়াসমীন। গানটি সৈয়দ আব্দুল হাদীর মগবাজারের বাড়িতে বসে তৈরি হয়। সুবল দাসের সহকারী ছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। প্রথমে গানটির সুর হয়, এরপর সেই সুরের ওপর কথা লিখে দেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। গানটি তৈরি হওয়ার পর সুবল দাস সৈয়দ আব্দুল হাদীকে বললেন, ‘তুমিই গাও।’ কিন্তু সৈয়দ আব্দুল হাদী বললেন, ‘আমার চেয়ে ভালো গাইবেন মাহমুদুন নবী।’ তখন মাহমুদুন নবী আর সাবিনা ইয়াসমীনকে চূড়ান্ত করা হয়।
‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’
সৈয়দ হারুন পরিচালিত ‘চরম আঘাত’ ছবির গান। লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, সুর করেছেন আলাউদ্দিন আলী। পর্দায় ইলিয়াস কাঞ্চন আর দিতির ঠোঁট মেলানো গানটি গেয়েছেন কুমার শানু ও মিতালি মুখার্জি। এই ছবির সব কটি গান আর আবহ সংগীত মুম্বাইয়ের একটি স্টুডিওতে ধারণ করা হয়।
এই গানের সংগীত তৈরিতে ছিলেন ২৬ জন বেহালাবাদক আর ২৪ জন রিদমিস্ট। আরও ছিলেন চেলো, পিয়ানো, বাঁশি, কি-বোর্ডসহ ৬৫ জন যন্ত্রী। সুরকার আলাউদ্দিন আলী বলেন, ‘ছবির যে দৃশ্যের জন্য গানটি করা, প্রথমে সেই দৃশ্যের জন্য অন্য গান তৈরি করা হয়েছিল।’
‘কী জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা’
জহিরুল হক পরিচালিত ‘প্রাণ সজনী’ ছবির এ গানে পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ। গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমীন। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুর করেছেন আলম খান। তিনি বলেন, ‘পরিচালক জহিরুল হক রোমান্টিক গানে সংলাপের চেয়ে গানের কথায় বেশি জোর দিতেন। যেন কথাটাই সংলাপ মনে হয়। এ গানের বেলায়ও তা-ই হয়েছে। আর তাঁর ছবির গানগুলো হতো ফোক ধাঁচের। কমলাপুরে জসীমউদ্দীন রোডে যেদিন বসি, সেদিন কোনোভাবেই আমরা গান বের করতে পারছিলাম না। রাতে ঠিক যখন সবাই চলে যাচ্ছেন, তখন আমি কাছাকাছি নোটে একটা সুর করি। জহুর ভাই শুনে বললেন, ঠিক আছে। এরপর মনিরুজ্জামান মনির ওই সুরে লেখেন “কী জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা”।
’‘আমার বুকের মধ্যিখানে, মন যেখানে হৃদয় যেখানে’
বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নয়নের আলো’ ছবির গান। গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর ও সামিনা চৌধুরী। পর্দায় গানটিতে ঠোঁট মেলান জাফর ইকবাল ও সুবর্ণা মুস্তাফা। গানটির গীতিকার ও সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বলেন, ‘নয়নের আলো ছবির সবগুলো গান আমার লেখা। এটি ছিল আমার প্রথম ছবি। তাই আমাকে অনেক পরীক্ষা দিতে হয় ওই সময়। আমি এ ছবির জন্য ১৬টি গান করি। তিন মাস একনাগাড়ে বিভিন্ন পরীক্ষা দেওয়ার পর পাঁচটি গান সবার ভালো লাগে। এর একটি “আমার বুকের মধ্যিখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে”। অনেক দিন খেটেছি বলেই প্রযোজক আমাকে একটা সুযোগ দিতে চাইলেন। গানটির রেকর্ডিংয়ের দিন ছবির প্রযোজক ফরিদ ভাইয়ের স্ত্রী গানটি শুনে কেঁদে দিলেন। ফরিদ ভাই তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কাঁদছ কেন?” তিনি বললেন, “এই গানটি শুনে মনে হলো, এটি আমার জন্য করা।” তখন ফরিদ ভাই বললেন, তোমার গান তুমি যেভাবে খুশি করো। বাজেট কোনো বিষয় না।’