কনসার্টে গেলে নাকি বয়স বাড়ে না। বছর আঠারো আগে বামবার কনসার্টের আগে যে ভদ্রলোক কথাটা বলেছিলেন, তিনি আজ কোথায় কে জানে। তখনই বয়স তাঁর ৫০ পেরিয়েছে। ফেব্রুয়ারির হালকা শীতে একটা উইন্ডচিটার গায়ে জড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। নেমেছিলেন না বলে বরং নামানো হয়েছিল বলা ভালো। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। এ অবস্থায় কনসার্টে এসেছেন—চায়ের দোকানে আড্ডারত উৎসাহী তরুণদের মনের প্রশ্ন বুঝেই কি না, তিনি বলেছিলেন, ‘কনসার্টে গেলে বয়স বাড়ে না।’
গত শুক্রবার আইসিসিবি এক্সপো জোনে বছরের প্রথম ওপেন এয়ার কনসার্ট দেখতে গিয়ে ওই ভদ্রলোককে মনে পড়ল ভিন্ন কারণে। কনসার্টে আসা বেশির ভাগ তরুণ। যাঁরা রক গান শুনতে এসে বয়স কমিয়ে নিতে চান, তাঁরা কি আজকাল আর আসছেন না?
গত সেপ্টেম্বরেই ইটিসি আয়োজন করেছিল ‘দ্য স্কুল অব রক’ কনসার্ট। তারই দ্বিতীয় কিস্তি ছিল এদিন। প্রথমবারের কনসার্ট যেমন সাড়া ফেলেছিল, তেমনই ছিল কিছু অব্যবস্থাপনার অভিযোগও। দ্বিতীয়বার কি সব ঠিকঠাক হলো?
শুরুটা হয়েছিল বিকেল সাড়ে চারটায়। মাথার ওপরে তখন ফাল্গুনের চড়া রোদ। দর্শকও খুব বেশি নেই। যাঁরা হাজির হয়েছেন, তাঁরা কতটা গান শোনায় মনোযোগী আর কতটা রোদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে, বলা মুশকিল। মঞ্চে তখন ব্লু জিনস; ‘পুরোনো’, ‘কদম’সহ নিজেদের শ্রোতৃপ্রিয় বেশ কয়েকটি গান শোনাল তারা। ব্যান্ডটির পারফরম্যান্স যখন শেষ, তখন বেলা পড়তির দিকে। ছাইরঙা আকাশের আক্ষরিক প্রতিচ্ছবি নিয়ে মঞ্চে হাজির হলো অ্যাসেজ। হালে তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ব্যান্ডটি মঞ্চে উঠতেই অনেক দর্শকের সমস্বর চিৎকার। ‘আমরা আছি’—যার অর্থ বুঝে নিতে কষ্ট হয় না মোটেও। অ্যাসেজ শুরুটা করল অবশ্য কাভার গান দিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর ‘ভিনদেশি তারা’ গাইল। তুমুল আলোচিত গান হওয়ায় অনেকে গলা মেলাল বটে, তবে চন্দ্রবিন্দুর পাঁড় ভক্তরা গানটি শুনে কতটা খুশি হলেন, বলা মুশকিল। এরপর ‘কেমন আছ’, ‘ধুলাবালি’সহ জনপ্রিয় গানগুলো গাইল ব্যান্ডটি।
সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে মঞ্চে উঠল আর্ক। সঙ্গে খুলে গেল নব্বইয়ের স্মৃতির দুয়ারও।
মাঝে অনেক দিন দৃশ্যপটে ছিলেন না ব্যান্ডের প্রধান ভোকাল হাসান। এখন আবারও নিয়মিত হচ্ছেন। হাসান যখন তুমুল জনপ্রিয়, কনসার্ট দেখতে আসা এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকেরই তখন জন্মই হয়নি। তাঁদের সামনে হাসান কেমন করেন, সেটাও ছিল দেখার। তবে হতাশ করলেন না গায়ক, তিনি উঠতেই বরং মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল—এই না হলো কনসার্ট! ‘প্রশ্ন’, ‘এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়’, ‘সুইটি’, ‘যারে যা উড়ে যা’ অনায়াসে গেয়ে গেলেন, কানায়–কানায় পূর্ণ মাঠে উপস্থিত দর্শকেরা তাতে যোগ্য সংগত দিলেন। মঞ্চ থেকে হাসান নামার সময় মনে হলো, এই যে তাঁর পারফরম্যান্স, দর্শকদের সঙ্গে কথা বলা; পারস্পরিক এই মিথস্ক্রিয়া থেকে নতুন ব্যান্ডগুলো কি কিছু শিখতে পারে?
আর্ক নেমে যেতেই পাশের সিটের এক ভদ্রলোক তৃতীয়বারের মতো বললেন, ‘এইবার হবে।’ কী? প্রশ্ন করতেই তিনি জানালেন, সব ক্যাটাগরির সিটের ‘ব্যবধান’ এবার ঘুচে যাবে। হুড়োহুড়ি করে সবাই মঞ্চের সামনে চলে আসবেন। সোনার বাংলা সার্কাস উঠতে না উঠতেই ভদ্রলোকের কথা ফলে গেল। কে কোথায় ছিলেন আর কোথায় গিয়ে দাঁড়ালেন, তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না। বড় কনসার্টে এ আর নতুন কথা কী। তবে ব্যান্ড পারফর্ম করা অবস্থায় দর্শকের মঞ্চে উঠে যাওয়া, অল্প সময়ের জন্য হলেও বিশৃঙ্খলা আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। পরে সব ঠিকঠাক চললেও ‘পরিস্থিতি ঠান্ডা’ করতে যে সময় নষ্ট হলো, তার মাশুল দিতে হলো পরে গিয়ে।
আর্টসেল আর নগরবাউলের গান নিয়ে অনেক শ্রোতার আগ্রহ ছিল। দুই ব্যান্ডের পরিবেশনা ছিল একেবারে শেষে। কিন্তু ‘সময় সংক্ষিপ্ত’—এই দোহাই দিয়ে দুই দলই নিজেদের পারফরম্যান্স সংক্ষিপ্ত করল। ‘অনিকেত প্রান্তর’, ‘পথচলা’র মতো জনপ্রিয় গানের সঙ্গে এদিন আর্টসেল শুনিয়েছে তার মুক্তি না পাওয়া গান ‘প্যালেস্টাইন ২০২৩’।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে মঞ্চে ওঠে নগরবাউল, মঞ্চে জেমসকে দেখতে পেতেই দর্শকের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়, তা জেমসের কনসার্টের দর্শকমাত্রই জানেন। ‘গুরু’র পারফরম্যান্স সংক্ষিপ্ত করার ঘোষণায় অনেকের মন খারাপ হয় বটে, তবে তিনি যখন ‘পাগলা হাওয়া’, ‘মীরাবাঈ’ বা ‘ভিগি ভিগি’ ধরেন, তখন আর ‘পাগল’ না হয়ে উপায় কী।
এর আগে গান শুনিয়ে গেছে নব্বইয়ের আরেক জনপ্রিয় ব্যান্ড ভাইকিংসও। ভোকাল তন্ময় জানান, কনসার্টটি তাঁর জন্য বিশেষ কিছু। কারণ, এই প্রথম গান শুনতে এসেছেন তাঁর বড় মেয়ে। তাঁকে উৎসর্গ করে তিনি যখন ‘ভালোবাসি যারে’ ধরেন, তখন গলা যে মেলাতে হবে, তা আর কাউকে বলে দিতে হয় না।
যেমন সাড়ে ছয় ঘণ্টা কনসার্ট দেখা ফিরতি দর্শককেও বলে দিতে হয় না, কনসার্টে গেলে বয়স বাড়ে না। তা তাঁর বয়স যত কমই হোক।