প্রথম দেখায় কখনো কখনো প্রেম হয়। প্রেম না হলেও প্রথম দেখার অনুভূতি সব সময় অন্য রকম।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের (১৯২০-২০১২) বয়স তখন ১৮ বছর। নাম তাঁর রবীন্দ্রশঙ্কর, আর পণ্ডিতও হয়ে ওঠেননি তখন। রওশন আরা বেগমের (১৯২৭-২০১৮) বয়স তখন ১২ চলছে। একজন চপলা কিশোরী।
রওশন আরাকে প্রথম দেখার কথা এভাবে প্রকাশ করেছেন রবিশঙ্কর, ‘উজ্জ্বল আর বেশ নজরকাড়া। চোখ দুটো ভারি মিষ্টি, আর গায়ের রং আলুভাইয়ের (ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ) চেয়ে ফর্সা।’
আত্মজীবনী ‘রাগ মালা’তে রবিশঙ্কর বলেছেন, রওশন আরার সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল না, রোমান্স বা লুকোচুরিও না। যদিও ওই সময় অনেকে এ রকম ভাবত। এমনকি বিয়ের বিষয়ে রওশন আরা কী ভাবছেন, তা–ও জানা ছিল না। শুধু জানতেন তাঁর মত আছে।
এক সন্ধ্যাবেলা বিয়ে হয়ে গেল রবিশঙ্কর ও রওশন আরার। উভয়ের বয়স তখন যথাক্রমে ২১ ও ১৪। তারিখটা ১৯৪১ সালের ১৫ মে।
ভাই নামী নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে বেড়ানো রবিশঙ্কর মধ্যপ্রদেশের মাইহারের মতো অজপাড়াগাঁয়ে এসেছিলেন সংগীত শিক্ষার আকর্ষণে। মাইহারের মহারাজা তখন ব্রজেন্দ্রনারায়ণ রায়। আর ওই রাজ্যের প্রধান সংগীতগুরু হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গ সংগীতের এই কিংবদন্তির কাছে তালিম নিতে ১৯৩৮ সালে সেখানে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ইউরোপ সফরে গিয়ে রবিকে (রবিশঙ্কর) প্রথম দেখেন আলাউদ্দিন খাঁ। তত দিনে নাচে ভালোই তালিম হয়েছে ছেলেটির। রবির মায়ের অনুরোধে তাঁকে সেতার শেখাতে সম্মত হন আলাউদ্দিন খাঁ। শর্ত দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে থাকতে হবে এবং শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হবে।
আর রওশন আরা হলেন আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা। বিয়ের পর নাম হলো অন্নপূর্ণা দেবী। নামটি রেখেছিলেন মাইহারের মহারাজাই।
এই দম্পতির বিবাহিত জীবনের গল্প বলার আগে আমরা রওশন আরার কাছে ফিরে যাই কিছুটা সময়।
বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা যায়, মেয়েকে সংগীত শিক্ষা দিতে আগ্রহী ছিলেন না আলাউদ্দিন খাঁ। চেয়েছিলেন মেয়ে ঘরকন্নায় মন দিক। কিন্তু তাঁর মন বদলে যায় একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।
একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে ভাই আলী আকবর খাঁর তালিম নেওয়া দেখছিলেন রওশন আরা। এ কাজটি তিনি নিয়মিত করতেন। আর শুনে শুনে নিজে গোপনে তা রপ্ত করে ফেলতেন। সেদিন আলী আকবরের বাজনা শুনে তাঁর মনে খটকা লাগে। ভাইয়ের বাজনা থামিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাইজান, এভাবে না, বাবা ওইভাবে শিখিয়েছিলেন।’ এ কথা বলেই তিনি বাজাতে শুরু করেন। এমন সময় ঘরে প্রবেশ করেন আলাউদ্দিন খাঁ। বাবা রাগ করেন কি না, ভেবে রওশন আরা ভয় পেয়ে যান। তখন রওশনকে নিজের ঘরে ডেকে নেন বাবা। সংগীতের প্রতি মেয়ের আগ্রহ তাঁকে মুগ্ধ করে। আলাউদ্দিন খাঁ বলেন, ‘আমি তোমাকে আমার গুরুর বিদ্যা শেখাব। কারণ, তোমার মধ্যে কোনো লোভ নেই।’ তখন থেকে শুরু হয় তাঁর সুরবাহার প্রশিক্ষণ। এর আগে তিনি শিখে নেন ধ্রুপদি কণ্ঠসংগীত ও সেতার।
দিনে দিনে অসামান্য প্রতিভাধর সংগীতসাধক হয়ে ওঠেন রওশন আরা ওরফে অন্নপূর্ণা দেবী।
তাঁকে নিয়ে ওস্তাদ আমির খাঁ একবার বলেছিলেন, ‘অন্নপূর্ণা দেবী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৮০ ভাগ পেয়েছেন, যেখানে আলী আকবর পেয়েছেন ৭০ ভাগ আর রবিশঙ্কর পেয়েছেন ৪০ ভাগ।’ আলী আকবরও এ কথাটির সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ‘অন্নপূর্ণাকে দাঁড়িপাল্লায় একপাশে রেখে অপর পাশে রবিশঙ্কর, পান্নালাল (বিশিষ্ট বংশীবাদক ও সুরকার পান্নালাল ঘোষ (১৯১১-১৯৬০) আর আমাকে রাখলেও অন্নপূর্ণার পাল্লাই ভারী হবে।’
যদিও প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল। এখন সে গল্পই করা যাক। তাঁরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে বাজাতে যেতেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে দর্শকেরা ছেঁকে ধরত অন্নপূর্ণাকে। পণ্ডিতজির দিকে নজর একটু কম পড়ত। এটা পণ্ডিতজি মানতে পারতেন না। হাজার হোক তাঁর নামডাক বেশি। রবিশঙ্করের ছাত্র ও ‘দ্য নবভারত টাইমস’-এর সংগীত সমালোচক মদন লাল ব্যাসই এমন তথ্য দিয়েছেন।
বিয়ের ঠিক ১০ মাসের মাথায় ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ জন্ম হয় এই দম্পতির প্রথম সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্করের, যাকে ডাকা হতো শুভ নামে। ছোটবেলা থেকে একধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয় শুভ। একসময় সেরেও যায়। কিন্তু সারা রাত জেগে থাকা এবং কান্নাকাটি করার অভ্যাস রপ্ত করে ফেলে শিশুটি। এদিকে তারা জামাই-বউ দুজনই থাকতেন পরিশ্রান্ত। দিনে রেওয়াজ, সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শেষ করে অনেক রাতেই বাড়ি ফিরতেন তাঁরা। সন্তানের কান্নাকাটিতে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারতেন না দুজনই। এ নিয়ে রবিশঙ্কর-অন্নপূর্ণার মধ্যেই রাগারাগি-ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত।
রবিশঙ্কর রাগমালাতে লিখেছেন, ‘খেয়াল করলাম, অন্নপূর্ণার ব্যক্তিত্ব দিন দিন বদলে যাচ্ছে। আমাদের দুজনেরই শক্তি ক্ষয় হচ্ছিল খুব। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিল আমাদের দুজনেরই। ওই সময়টাতে তুচ্ছ কারণে আমার মেজাজ বিগড়ে যেত। দুজনে একসঙ্গে রেগে উঠতাম। আমি আগে বুঝতে পারিনি, কিন্তু এবার খেয়াল করলাম, ও ঠিক ওর বাবার মেজাজ পেয়েছে। ও আমাকে প্রায়ই বলত, “তুমি শুধু সংগীতের জন্য আমাকে বিয়ে করেছ! আমাকে তুমি ভালোবাসো না! তোমার জন্য তো অন্য রূপসীরা আছে!” কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বললে খুব হিংসা হতো তার। যখনই আমি অন্য শহর থেকে অনুষ্ঠান করে ফিরতাম, সেখানে আমার কোনো প্রেম আছে বলে আমাকে দুষত সে।’
এ সময় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাইরে অনুষ্ঠান করা ছেড়ে দেন অন্নপূর্ণা। ছেড়ে দেন মানে একদম ছেড়ে দেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পণ্ডিতজির উত্তর ছিল এ রকম, ‘কে যে এমন করছে ঠিক বুঝতে পারছি না।’ অথচ অধিকাংশ ভক্তের মত হলো, পণ্ডিতজির প্রতি অভিমান করেই বাইরে বাজানো ছেড়ে দিয়েছেন আলাউদ্দিন-কন্যা।
একদিন অন্নপূর্ণার কানে আসে অন্য রকম একটি খবর। তিনি শুনতে পান, পণ্ডিতজির সঙ্গে নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর প্রেম চলছে। পুত্রকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ মাইহারে বাপের বাড়ি চলে যান তিনি। এ সময় প্রায় দুই বছর তিনি মাইহারে ছিলেন। এরপরে পরিচালক অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কমলা শাস্ত্রীর বিয়ে হয়ে গেলে তিনি পণ্ডিতজির সংসারে ফিরেছিলেন। কিন্তু হৃদয়ের তার একবার ছিঁড়ে গেলে তা যেন জোড়া লাগে না। পাকাপোক্তভাবে তাঁদের সংসারজীবনের ইতি ঘটে ১৯৬৭ সালে।
‘মেনজ ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংবাদমাধ্যমকে একবারই কিছু লিখিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী, ২০০০ সালে। সেখানে তিনি কেবল তাঁদের সন্তান শুভকে নিয়ে কথা বলেন। তাঁর মতে, সুকৌশলে তাঁর কাছ থেকে শুভকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তিনি পণ্ডিতজিকে একজন ‘প্যাথলজিক্যাল লায়ার’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
শুভ তার মায়ের কাছেই থাকত। মায়ের কাছে বাজনা শিখছিল। এ সময় পুত্রের প্রতিভা সম্পর্কে ততটা জানতেন না রবিশঙ্কর। কারণ, তাঁর সময় ছিল না। একদিন রবিশঙ্কর মুম্বাইয়ের একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়েছিলেন। তখন হঠাৎ সেতারের বাজনা শুনতে পান। রবিশঙ্কর অবাক হয়েছিলেন, কারণ যে সুর ভেসে আসছিল, সেটা তার শ্বশুর আলাউদ্দিন খাঁর তৈরি করা এবং নিখিল (পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি) ও তিনি ছাড়া সেটা তেমন কেউ বাজাতে পারত না। রবিশঙ্কর জানতে চাইলেন, কে বাজাচ্ছে? তখন পাশের লোকজন হেসে বলল, ‘পণ্ডিতজি নিশ্চয়ই আপনি মজা করছেন! আপনার নিজের ছেলে বাজাচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছেন না। রবিশঙ্কর তখন ছেলেকে এক হোটেলে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এক মঞ্চে বাজানোর প্রস্তাব দিলেন।
কিন্তু সংগীত শিক্ষা শেষ না করে এভাবে আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে মত ছিল না মায়ের। তিনি আর মাত্র দেড়টি বছর সাধনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তা না হলে ন্যূনতম ছয়টি মাস শেখার কথা বলেন। কিন্তু শুভর মনে তখন মায়ের কঠোর শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ আর আমেরিকায় চোখধাঁধানো জীবনের হাতছানি। পণ্ডিতজির সাগরেদরাও বললেন, ‘শুভ একেবারে তৈয়ার’।
শুভ আমেরিকায় গিয়েছিলেন এবং সেখানকার নামী কারনেগি হলে বাজিয়েও ছিলেন। কিন্তু তদারকির অভাবে এত দিনের সাধনা একটু একটু করে শেষ হয়ে যায়। শুভ সেখানে বিয়ে করেন। তাঁদের দুটি সন্তান হয়। অর্থের জন্য একসময় মদের দোকানে কাজ নেন। জাংক ফুড ও কোকাকোলায় আসক্ত হয়ে পড়েন।
সাক্ষাৎকারে অন্নপূর্ণা বলেন, ‘আজ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি কেন তিনি (রবিশঙ্কর) শুভর তালিম শেষ করতে দিলেন না। সে সময় কথা ছড়িয়ে পড়েছিল যে শুভ ভবিষ্যতে পণ্ডিতজির থেকে ভালো বাজাবে এবং এটা হবে পণ্ডিতজির ওপর আমার প্রতিশোধ। হয়তো এ কারণেই পণ্ডিতজি এমনটা করেছিলেন। আমি জানি না মানুষ কীভাবে এমন চিন্তা করতে পারে।’
পরে অবশ্য শুভ ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। একটা সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রঙ্কিয়াল নিউমোনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
বলা যেতে পারে, পরের ৫০ বছর কারও সামনে যাননি তিনি। তিনি নিজেই রান্না ও ঘরদোর সাফ করেন। কাজের লোক রাখতেন না।
এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম জর্জ হ্যারিসন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি একবার অন্নপূর্ণার দেখা পেয়েছিলেন এবং তাঁর রেওয়াজ শোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে সেটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধে।
বাইরে না গেলেও ঘরে বসে রেওয়াজ করে গেছেন ক্ষণজন্মা এই সংগীত প্রতিভা। তৈরি করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি, ওস্তাদ বাহাদুর খান, ওস্তাদ আশিষ খান, পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, পণ্ডিত নিত্যানন্দ হলদিপুরের মতো প্রতিভাবান সংগীতশিল্পীরা তাঁরই শিষ্য ছিলেন। কথিত আছে, শিষ্যদের সামনেও ততটা যেতেন না তিনি। পাশের ঘর থেকেই নির্দেশনা দিতেন।
অন্নপূর্ণার সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন রবিশঙ্কর। সেই দুই স্ত্রী হলেন স্যু জোন্স ও সুকন্যা কৈতান। দুই ঘরে জন্ম হয় নোরা জোন্স ও অনুশকা শঙ্কর নামে দুই মেয়ের। অপর দিকে অন্নপূর্ণা দেবীও ঋষিকুমার পাণ্ড্য নামে এক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি এসেছিলেন তাঁর কাছে সেতার শিখতে।
২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর ভোরে মুম্বাইয়ে জীবনাবসান ঘটে উপমহাদেশের ক্লাসিক্যাল মিউজিকের জাদুকরি এই শিল্পীর। দুঃখজনক হলো, অন্নপূর্ণা দেবী মৃত্যুর আগের পাঁচ দশকে কিছুই রেকর্ড করেননি। তিনি কেবল হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়েন ধ্রুপদি সংগীত অনুরাগীদের হৃদয়ে।
(সংশ্লিষ্ট বইপত্র এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অবলম্বনে)