ওস্তাদ রশিদ খান
ওস্তাদ রশিদ খান

‘সংগীত না থাকলে ক্যারিয়ার হিসেবে আমি ক্রিকেটকেই বেছে নিতাম’

৯ জানুয়ারি প্রয়াত হন ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ওস্তাদ রশিদ খান। খুব বেশি বয়স হয়েছিল এমন নয়, মাত্র ৫৬ বছর। দীর্ঘদিন ধরে প্রস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তর প্রদেশের বদায়ুঁতে তাঁর জন্ম। মূলত শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি ফিউশন, হিন্দি ও বাংলা ছবিতে জনপ্রিয় গানও গেয়েছেন এ শিল্পী। বাংলাদেশেও একাধিকবার সংগীত পরিবেশন করেছেন তিনি। পাঁচ বছর আগে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেন ভারতীয় সাংবাদিক আলশার খান। সাক্ষাৎকারে প্রাধান্য পেয়েছে রশিদ খানের জীবনদর্শন। ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত হয় আজিবস সংগীত একাডেমির আয়োজনে ১৭তম বসন্ত উৎসব। সংগীত বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা ভারতের স্বনামধন্য সংগীতজ্ঞ আচার্য জিয়ালাল বসন্ত স্মরণে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। সে বছর ছিল জিয়ালাল বসন্তের জন্মশতবর্ষপূর্তি। সেই উৎসবে ছিল ওস্তাদ রশিদ খানের পরিবেশনা। পরিবেশনার আগে তাঁর সঙ্গে এ আলাপচারিতা হয়। ১৭ এপ্রিল ভারতের লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ম্যানস ওয়ার্ল্ডের অনলাইনে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি প্রথম আলোর জন্য অনুবাদ করেছেন রাফসান গালিব

আপনার কাছে সাফল্যের মানে কী?

ওস্তাদ রশিদ খান: আমি যখন মঞ্চে উঠি এবং নতুন কিছু করি, আমি মনে করি এটিই আমার জন্য সাফল্য। এটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টার বিষয় এবং আমি কতটা অর্জন করতে পেরেছি, এটি তার প্যারামিটারও।

আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া সবচেয়ে অবিস্মরণীয় মানুষটি কে এবং কেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। আমাদের প্রেমের গল্পটা অন্য রকম। আমরা দুজন ভিন্ন ধর্মের। কিন্তু এতে আমার বাবার কোনো সমস্যা ছিল না। আমি যখন তাঁকে (স্ত্রী) বিয়ে করার কথা ভাবছিলাম, আমার বাবা সেটিকে সমর্থন করেন। আমার স্ত্রী আমার জীবন বদলে দিয়েছেন এবং এর জন্য সত্যিই আমি তাঁর কাছে ঋণী।

আপনার কোনো রোল মডেল আছে বা কাদের আপনি অনুসরণ করেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে আমি সব সময় পণ্ডিত ভীমসেন যোশি, ওস্তাদ মেহেদী হাসান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, বিলায়েত খান এবং গুলাম আলী খানকে অনুসরণ করি। আর বেড়ে ওঠার সময় আমার আদর্শ ছিলেন কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, লতাদি এবং আশাদি।

আপনি ব্যর্থতাকে কীভাবে মোকাবিলা করেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: ব্যর্থতা মোকাবিলা করার জন্য আমার মন্ত্র হলো ধৈর্য ধরে থাকা। এমন পরিস্থিতিতে নিজের শান্তি বজায় রাখা। বিচলিত হওয়ার কোনো মানে নেই। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখুন এবং চালিয়ে যান।

ওস্তাদ রশিদ খান

একজন সংগীতকার না হলে আপনি কী হতে চাইতেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: আমি ক্রিকেটের চরম একজন ফ্যান। গান না থাকলে আমি খেলাধুলায় ক্যারিয়ার গড়তে পারতাম। শচীন টেন্ডুলকার আমার প্রিয় খেলোয়াড়। আমি এখনো অধীর আগ্রহ নিয়ে ক্রিকেট ফলো করি। ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য বাড়িতে আমার নিজের টিভিসেট আছে। বর্তমান ক্রিকেট দলে, আমি মনে করি বিরাট কোহলি দুর্দান্ত খেলছে।

যদি ঘড়ির কাঁটাকে পেছনে ঘুরিয়ে দিতে পারতেন, তাহলে কোন জিনিসটা আপনি পাল্টে দিতেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: আমি কোনো অনুশোচনা ধরে রাখি না। সময়ের সঙ্গে, জীবনের চাহিদাগুলো পরিবর্তন হতে থাকে। সেখানে হয়তো অনেক সময় কিছু করার থাকে না। তবে মনে করতে হবে, যা কিছু হয় ভালোর জন্যই হয়।

অর্থকে কি আপনার কখনো সমস্যা মনে হয়েছে?

ওস্তাদ রশিদ খান: আজকাল মানুষের কাছে অর্থ মানে বিশাল কিছু। কিন্তু আপনি এসবের কিছুই কবরে নিয়ে যেতে পারবেন না। তাই আমি যা পেয়েছি, তার জন্য সব সময় কৃতজ্ঞ এবং তা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি।

আপনি কি মৃত্যু নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা করেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: না। আমি বিশ্বাস করি, আপনি যত বেশি মৃত্যু নিয়ে ভাববেন, আপনি জীবন নিয়ে তত বেশি হতাশ হয়ে পড়বেন। আর যাঁরা মনে করেন, শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থনাই বেহেশতে নিয়ে যেতে পারে, তাঁদের জানা দরকার যে ভালো কাজ করাই হচ্ছে ইবাদতের সবচেয়ে বড় ধরন।

ঢাকায় শাস্ত্রীয়সংগীত উৎসবে খেয়াল পরিবেশন করছেন ওস্তাদ রশিদ খান

আপনি কি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি। আমার জীবনে যা কিছুর অর্জন তার কৃতিত্ব আমি খোদাকেই দিই। খোদার সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করার উপায় হিসেবে আমি অনেক ধর্মীয় স্থানেও ঘুরি।

তরুণ প্রজন্মের প্রতি আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

ওস্তাদ রশিদ খান: আজকাল তর্ক–বিতর্কের বড় একটি বিষয় হচ্ছে ধর্ম। তাই আমি পরবর্তী প্রজন্মকে পরামর্শ দেব যে কোনো ধর্ম খারাপ এই চিন্তা থেকে যেন তারা বিরত থাকে। সবাইকে সমান মনে করতে হবে এবং সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে ভালোবাসার বার্তা।

ব্যক্তিগতভাবে এবং পেশাগতভাবে আপনার সবচেয়ে বড় অর্জন কী?

ওস্তাদ রশিদ খান: আমি মনে করি, আমার মাতৃভূমি আমাকে যে ভালোবাসা এবং সম্মান দিয়েছে, তা আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে আমার পরিবার। পরিবারের সবার সঙ্গে খাবার টেবিলে বসলে আমি একাত্মতা অনুভব করি।

আপনার কাজের ক্ষেত্র জীবন সম্পর্কে আপনাকে কী শিখিয়েছে?

ওস্তাদ রশিদ খান: সংগীত আপনাকে সবকিছু শেখায়। একবার সংগীতের মধ্যে ঢুকে গেলে বাইরের জগতের সব বিশৃঙ্খলা থেকে আপনি একেবারে নিজের আলাদা একটি জগতে চলে যাবেন। আপনি প্রশান্তি ও স্বস্তির একটি অনুভূতি পাবেন। সব ধর্মকেও আপনি সেখানে পাবেন। এটা জীবনকে পাওয়ার একটা উপায়।