১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করা ব্যান্ড সোলস ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। যার শুরুটা হয়েছে লোগো উন্মোচনের মাধ্যমে। গতকাল দুপুরে ঢাকার গুলশান ক্লাবে লোগো উন্মোচন করা হয়। এতে ব্যান্ডের বর্তমান সদস্যরা ছাড়াও শুরুর দিকের কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রামের ব্যান্ড সোলস নিজেদের দরিয়ার কূলের মানুষ হিসেবে মনে করছে। তাই ব্যান্ডের লোগোতেও সাগরের নীল জলরাশিকে প্রাধান্য দিয়েছে। তেমনি তেজোদীপ্ত ব্যাপারটি বোঝাতে রক্তাক্ত লাল রং ব্যবহারও করেছে তারা। এসব লোগো থেকে একটি চূড়ান্ত হবে। তা হবে দর্শক রায়ে। এরই মধ্যে সোলস তাদের ফেসবুক পেজে লোগো আপলোড করেছে। ভক্ত-অনুসারীদের রায়ে যে লোগো এগিয়ে থাকবে, সেটি ব্যান্ডের সদস্যরাও চূড়ান্ত করবেন বলে জানালেন।
সেপ্টেম্বর থেকে কনসার্ট ও নতুন গান
৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫০টি নতুন গান প্রকাশ করবে ব্যান্ড সোলস। দেশ ও দেশের বাইরে দলবল নিয়ে এক টানা কনসার্টেও গাইবে তারা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কনসার্ট চূড়ান্ত হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে এই যাত্রা শুরু হবে। এমনটাই জানিয়েছেন ব্যান্ডের সদস্যরা। নতুন গান প্রকাশের শুরুটাও হবে এই সময়ে। তবে গান তৈরি চলছে কয়েক বছর ধরে বলে, জানালেন পার্থ বড়ুয়া। তিনি বললেন, ‘৫০ বছর খুবই উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা। তাই আমরা এটা উদ্যাপন করতে চাই। সেভাবেই সব পরিকল্পনা। তারই অংশ হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে গান রেকর্ড করেছি। সেপ্টেম্বর থেকে একটা নির্দিষ্ট দিন–তারিখ দেখে এসব গান প্রকাশ শুরু হবে। কোনো গান ১০ দিন, আবার কোনো গান ১৫ দিন অন্তর প্রকাশ পাবে। সব কটি গান ভিডিও আকারে থাকবে।’
রেনেসাঁ ও অন্য ব্যান্ডের সঙ্গে গান
একটা সময় সোলসের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন শিল্পী নকীব খান। প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৭৪ সালে সোলসে যোগ দেন তিনি। এর আগে বালার্ক ও সৈকতচারী নামে দুটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সোলসের প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’-এর অধিকাংশ গানের সুর দিয়েছেন নকীব খান। ১৯৮৩ সালে পারিবারিক কারণে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এলে তাঁকে সোলস ছাড়তে হয়। সেই নকিব খানকে সোলসের ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনে পাওয়া যাবে।
তিনি ব্যান্ডের জন্য নতুন গান তৈরি করবেন বলে জানালেন পার্থ বড়ুয়া, ‘নকিব ভাই আমাদের জন্য গান তৈরি করবেন। রেনেসাঁর সঙ্গে অ্যালবামের পরিকল্পনা করছি। সে রকম অন্য ব্যান্ডের সঙ্গেও কাজের চেষ্টা করব। আমরা চেয়েছি, আমাদের উদ্যাপনে তারাও অংশ হয়ে থাকুক। ব্যান্ডে–ব্যান্ডে সৌহার্দ্য–ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বার্তা দিতে চাই। এতটা বছর মিউজিক করছি, তারাও তো আমার ফ্যামিলি—এত বছরে তাদের সঙ্গে একটা গানও হয়নি, সেটাও ভাবিয়েছে আমাদের। তাদের সঙ্গে পাশাপাশি এক মঞ্চে দাঁড়াই না, কেমন লাগে দেখি। ভালোও লাগতে পারে, খারাপও লাগতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতাটা নিতে চাই। তাদেরও অভিজ্ঞতাটা দিতে চাই।’
গীতিকারদের জন্য সুযোগ
সোলসের আগেও তরুণ গীতিকবিদের কাছ থেকে গীতিকবিতা আহ্বান করেছে। তার প্রতিফলন পাওয়া যায় ‘জ্যাম’ অ্যালবামে ‘ছায়া’ গানে। ৫০ বছরে আরও বড় পরিসরে সেই সুযোগটা আসছে। সংবাদ সম্মেলনে পার্থ বড়ুয়ার আহ্বানে দলটির সঙ্গে শুরু থেকে সংযুক্ত থাকা গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী জানালেন, আগামী এক বছর নতুন গান প্রকাশ করবে সোলস। সেই লক্ষ্যে খোঁজা হচ্ছে মানসম্পন্ন গীতিকবিতা। সোলসের অংশীদার হতে পারবেন গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা যেকোনো বাংলাদেশি, যাঁরা গান লিখতে আগ্রহী। জঙ্গী বলেন, ‘সোলসের শুরুর দিকে যখন আমরা ব্লুনাইল হোটেলে গানবাজনা করতাম, তখনো অনেক গীতিকবি এসে অপেক্ষা করতেন তাঁদের লেখা গান দেখানোর জন্য। ৫০ বছরে সোলস কখনো গীতিকবিতা নিয়ে আপস করেনি। সমৃদ্ধ কথা-সুরের গানই করেছে। সেই সোলস ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার গীতিকবিদের আহ্বান করছে তাদের জন্য গান লেখার। আমি মনে করি, এটা দারুণ একটা সুযোগ।’
আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে soulsfifty@gmail.com ঠিকানায় যে কেউ গীতিকবিতা পাঠাতে পারবেন। সেখান থেকে ১০টি গীতকবিতা বাছাই করে তৈরি হবে গান ও ভিডিও। যা ধারাবাহিকভাবে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।
তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে গান
সংবাদ সম্মেলন শেষে প্রথম আলোর সঙ্গে একান্ত আলাপে পার্থ বড়ুয়া জানালেন, এই প্রজন্মের কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে সোলসের কাজ করার পরিকল্পনা আছে, যা সোলস ফিচারিং হবে। তিনি বললেন, ‘আমি একটা কয়্যার গ্রুপ করেছি, নাম ঢাকা কয়্যার। গত ঈদে এই টিম নিয়ে “মন শুধু মন ছুঁয়েছে” পারফর্ম করেছি। ভেবেছি, সোলসের বাইরে যারা আছে, ৫০ বছরে ৫০ গানের প্রকল্পে তাদের নিয়েও কাজ করব, যেখানে আমরা শুধুই বাজাব। ৫০ বছরের এটা আমাদের অন্যতম একটা পরিকল্পনা।’
পার্থ বড়ুয়া জানালেন, মুহিন, সাব্বির, নিশিতা, কিশোর, কোনাল, কনা, অপু আমান ও প্রিয়াংকার মতো শিল্পীদের কথা আপাতত চূড়ান্ত ভেবেছি। তাঁরা একটা নতুন গান, সোলসের একটা কাভারও করতে পারে।
কেন এই উদ্যোগ, জানতে চাইলে পার্থ বড়ুয়া বললেন, ‘এই প্রজন্মের শিল্পীদের কণ্ঠে সোলসের গান শুনতে কেমন লাগে, সেটাও জানার বিষয়। পেশাদার ব্যান্ডের সঙ্গে এই প্রজন্মের পেশাদার শিল্পীদের কেমন লাগে, সেই স্বাদ আর অভিজ্ঞতা নিতে চাই। “ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ” প্রতিযোগিতার সময় আমাদের যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা, তা বেশ ভালো হয়েছে। যাদের কথা বলছি, তারা আমার অত্যন্ত কাছের, আপন ও স্নেহভাজন। ওদের সঙ্গে কাজ করতে পারলে আমাদেরও ভালো লাগবে। এটা একটা টেলিভিশন প্রোডাকশন হবে এবং উচ্চমানসম্পন্ন।’
শিক্ষক-ছাত্র এক ব্যান্ডে
পার্থ বড়ুয়া তখন চট্টগ্রামের সেন্ট প্ল্যাসিডস স্কুলের শিক্ষার্থী। এই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন রেলি পিনেরোকে, যিনি সোলস ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন। ব্যান্ডে গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট হিসেবে ছিলেন। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সোলস ব্যান্ডে ভোকালিস্ট ও গিটারিস্ট হিসেবে আছেন তাঁর ছাত্র পার্থ বড়ুয়া। ৫০ বছরের সংবাদ সম্মেলনে সেই কথাটিও উঠে এল।
রেলি পিনোরো বলেন, ‘এই ছেলেটাকে (পার্থ বড়ুয়া) আমি সত্তর দশকে স্কুলে পড়িয়েছি। কোনো দিন জানতাম না সে আমার ব্যান্ডের সদস্য হবে। আমি ওর জন্য এখন গর্বিত, সে আমাদের ব্যান্ডটাকে ধরে রেখেছে, আমাদের চলে যাওয়ার পরও। সোলস ইজ আ কন্টিনিউটি, এটা কোনো দিন মরে না। আমরা জানি, আমাদের শরীর মরে যায়, কিন্তু সোলস না। ৫০ বছর খুব বেশি সময় না, আমরা ১০০ বছরের প্রত্যাশা করছি। আশা করি, শ্রোতারা আমাদের সঙ্গে সঙ্গ দেবেন। পার্থ, নাসিম, মাসুম, আশেক, রিয়েল—সবাই ব্যান্ডটাকে ধরে রাখছে, মেনটেইন করছে। কন্টিনিউ করবে। বাচ্চু, রনি অনেকে নেই—কেউ যাবে কেউ আসবে, বাট সোলস নেভার ডাইজ।’
সোলস নামের নেপথ্যে
মমতাজুল হক দুলু ছিলেন সংগীতপাগল এক কিশোর। ১৯৭২ সালে সেন্ট মেরীস স্কুলে এক কনসার্টে সাজেদ উল আলম নামের আরেক গানপাগলের সঙ্গে পরিচয়। দারুণ গিটার বাজাতেন সাজেদ। প্রথম দিনই তাঁকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন দুলু। গিটার আর বেনজু বাজিয়ে শোনালেন। এরপর কাজীর দেউড়ি বাসায় দুলুকে অ্যাকোর্ডিয়ান ও গিটার বাজিয়ে শোনালেন সাজেদ। পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়ে সংগীতের প্রতি আগ্রহ বাড়ল দ্বিগুণ। ঠিক হলো, একটা অর্কেস্ট্রা গড়ে তুলবেন। সাজেদের বাবা সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম দলের নাম ঠিক করে দিলেন ‘সুরেলা’। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শুরু করে সুরেলা। একপর্যায়ে তারা বুঝতে পারে, ধ্যানধারণা পাল্টাতে হবে, হতে হবে বৈশ্বিক। এ ভাবনা থেকেই ১৯৭২ সালের শেষ দিকে সুরেলা হয়ে গেল ‘সোলস’। এই নামটা দিয়েছিলেন সাজেদের বাবা।
সেই গল্প শোনালেন প্রথম দিকের সদস্য আহমেদ নেওয়াজ। তিনি বললেন, ‘বৈশ্বিক হওয়ার ভাবনায় আমরা যখন নাম নিয়ে চিন্তিত, তখন সাজেদের বাবা বললেন, নাম সোলস করো, সোল মানে আত্মা। সোলস মানে অনেকগুলো আত্মা। অনেকগুলো আত্মার সম্মিলন যেখানে ঘটে, সেখানে অনেক নতুন কিছুরই সৃষ্টি হয়। এখনো আমরা সেটাই বিশ্বাস করি। অনেক আত্মা থাকলে ভাঙনের প্রশ্ন আসে না। চলে যাচ্ছে একজন, আরেকজন ঢুকে যাচ্ছে। এভাবেই সোলসে এত আত্মা যাচ্ছে, আরেক আত্মা আসছে। ৫০ বছর পার করছে, একদিন শতবর্ষও পার করবে।’
সোলসের অনুপ্রেরণা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রথম ব্যাচের তিন শিক্ষার্থী সাজেদ, সুব্রত বড়ুয়া রনি ও আহমেদ নেওয়াজ। এর বাইরে ছিলেন দুলু ও তপন চৌধুরী—এই পাঁচজন মিলে শুরুর দিকের ব্যান্ড সোলস। সেই সময়ের কথা মনে করে আহমেদ নেওয়াজ বললেন, ‘শুরুতে সোলস ভেঙে যায়। এরপর আমরা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ি নিজেদের মতো। সোলসের কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট নিজেই কিনে ফেললাম। আমরা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তি হলাম। রনি, আমি, সাজিদ। তখন আবার শুরু করি। এটা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরের ঘটনা। এই বছরে ৩ আগস্ট চারুকলা অনুষদের যাত্রা শুরু। তপন, দুলু আর রনির বাসা ছিল একই জায়গায়।
আমাদের সোলস করার অনুপ্রেরণা হচ্ছে লাইটেনিংস। সংগীতভবনের ওপরতলায় লাইন্টিংস নামে একটা দল ছিল, যারা বিটলসকে অনুসরণ করত। বিটলস যা যা ইনস্ট্রুমেন্টস ব্যবহার করত, সবই ওরা করত। আমরা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতাম এত বিউটিফুল সাউন্ড কোথা থেকে আসছে। ওখান গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এরপর আস্তে আস্তে আমরা জাগ্রত হতে থাকি। ছোট ছোট বিয়ের অনুষ্ঠান ও হোটেলের অনুষ্ঠানে গাই। হোটেল আগ্রাবাদে জয়েন করলাম। এভাবেই শুরু হলো।’
৫০ বছর অতিক্রম করা দলটির ৩২ বছর হাল ধরে আছেন পার্থ বড়ুয়া। সঙ্গে আছেন আরেক জ্যেষ্ঠ সদস্য নাসিম আলী খান। বর্তমান লাইনআপে আরও আছেন আহসানুর রহমান আশিক (ড্রামস), মীর শাহরিয়ার মাসুম (কি–বোর্ড) ও মারুফ হাসান রিয়েল (বেজ গিটার)।
ব্যান্ডের ৫০ বছর পূর্তিতে লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সাবেক সদস্য ও রেনেসাঁর বর্তমান সদস্য পিলু খান। তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘যেকোনো ব্যান্ড টিকিয়ে রাখার জন্য দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। দলনেতাকে হতে হবে পুরোদস্তুর মিউজিশিয়ান এবং দক্ষ লিডার। আমি খুবই আনন্দিত, আমরা বের হওয়ার পর সোলস একইভাবে টিকে আছে তেমনই একজন কমপ্লিট মিউজিশিয়ান ও লিডার পার্থ বড়ুয়ার নেতৃত্বে।’