গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরের জন্য বিশেষ দিন। সেই দিনের কথা মনে করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হচ্ছেন এই সংগীতশিল্পী। এখনো যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছেন। ক্যারিয়ারের পথচলার বিশেষ এক প্রস্তাব পেয়েছিলেন এই দিনে। তার পরের দিন, আজ ৭ জুলাই তিনি গানে প্রথম কণ্ঠ দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে সংগীত অঙ্গনে ২৫ বছর কাটিয়ে দিলেন। খুশি ও আবেগের দিনটি কেমন ছিল?
সেই সময়ের কথা মনে করে আসিফ আজ শুক্রবার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন আমি শ্রদ্ধেয় সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন ভাইয়ের সহকারী হিসেবে কাজ করি। স্টুডিওতে কে গান করবে, কার কবে শিডিউল, কে কখন আসবে, চুক্তি—এসব কাজ নিয়েই থাকতে হতো। গানের মধ্যে থাকতাম। এভাবে আট মাস কাজ করি। নতুনদের তখন স্ট্রাগল করতে হতো। যে কারণে স্টুডিওতেই বেশি সময় কাটত। কাজের ফাঁকে সিনিয়র সংগীতশিল্পীদের গানগুলোর ডামি ভয়েস দিয়ে নিজেকে শাণিয়ে নিচ্ছি। সন্ধ্যায় সেসব শিল্পী এসে ভোকাল দিয়ে যান। তখন আমারটা মুছে যায়। ইমন ভাই চাইছেন আমার সঙ্গে মাইক্রোফোনের বন্ধুত্ব হয়ে যাক। আমিও নিবিষ্টচিত্তে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাচ্ছি, তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়েই যাচ্ছেন।’
এর মধ্যেই একদিন আসিফের জন্য বিশাল এক সুযোগ এল। সেদিন যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দিনটি ছিল ১৯৯৮ সালের ৬ জুলাই। সেই প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, ‘ঠিক ১৯৯৮ সালের ৬ জুলাই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ইমন ভাই তখন সিদ্ধেশ্বরী থাকতেন। সকালে ওনার মিউজিক রুমে ঢুকতেই স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বললেন, ‘‘আসিফ, কাল তোমার প্রথম প্লে ব্যাক, রেকর্ডিংয়ে সঙ্গে কাকে দেখতে চাও?’’’
সেদিন আসিফ পছন্দের শিল্পীর নাম সঙ্গে সঙ্গেই বলতে ভোলেননি। আসিফ বলেছিলেন আলম আরা মিনুর নাম। কেন এই শিল্পীর সঙ্গে গাইতে চেয়েছিলেন আসিফ? এ প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, ‘মিনু আপা শুরু থেকেই আমাকে গান মহা উৎসাহ দিয়ে আসছিলেন। এমনকি তাঁর অনেক শোতে ওয়ার্ম-আপ গায়ক ছিলাম আমি। আবার আমার সাউন্ড সিস্টেমও তিনি ভাড়া নিতেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা তখন থেকেই ভালো ছিল।’
সেদিনই শওকত আলী ইমন সংগীতশিল্পী আলম আরা মিনুকে ফোন দিয়ে বলে দেন। আসিফের নাম শুনে তিনিও খুশি হয়েছিলেন। তাঁরা ঠোঁট মেলাবেন ‘আমারই ভাগ্যে তোমারই নাম ছিল যে লেখা’। গানটি ‘রাজা নাম্বার ওয়ান’ সিনেমায় ব্যবহার করা হয়। গানটির গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির। আসিফ আগেই জানতেন চিত্রনায়ক মান্নার লিপে যাবে গানটি। সিনেমায় মান্নার বিপরীতে ছিলেন শাহনাজ।
সব মিলিয়ে বড় আয়োজন। এরপরে রাতে যেন আর ঘুম নেই আসিফের। সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। নিজে কণ্ঠ দেবেন, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আসিফ জানান, ২৫ বছর আগের আজকের দিনে বাসা থেকে বেরিয়ে স্টুডিওতে আসেন। তারপর গানে কণ্ঠ দেন। সেই দিনের কথা জানতে চাইলে আসিফ বলেন, ‘কয়দিন ধরেই ভাবছি, কীভাবে ২৫ বছর কেটে গেল। আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার এখনো পরিষ্কার মনে আছে। তোমার সঙ্গে কথা বলছি ঠিক এমন সময় (বিকেল ৩টা) আমি স্টুডিওতে যাচ্ছিলাম...’, বলতে গিয়ে থেমে যান আসিফ। কিছুটা সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ‘কয়দিন ধরেই ভাবছি, ২৫ বছর কীভাবে চলে গেল। কারণ, তখনো জানতাম না ভবিষ্যৎ আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছিল।’
আবেগাক্রান্ত হয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের হাত ধরে গানের রাজ্যে প্রবেশ করি। এর মধ্যে সিকি শতাব্দী কেটে গেছে। কেমন যেন ঘোর লাগা অনুভূতি হচ্ছে। এখনো গেয়ে যাচ্ছি গান, পঁচিশটা বছরকে মনে হচ্ছে এই তো সেদিন! দেশের মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার বিরল সৌভাগ্য হয়েছে, সেই ভালোবাসার রেশ এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। নিজের অতীতের সঙ্গে বর্তমান মেলাতে গিয়ে শুধুই আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছি।’
গানে প্রথম কণ্ঠ দিয়েই বাহবা পেয়েছিলেন আসিফ। গান শুনে সেই ‘রাজা নাম্বার ওয়ান’ সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালক প্রয়াত শরীফউদ্দীন খান দীপু আসিফকে বলেছিলেন, ‘লেগে থাকো, তোমার ভবিষ্যৎ ভালো।’ প্রশংসা করেছিলেন মান্না, শাবনাজেরাও। সবশেষে আসিফ বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের কাছে আমার অনেক ঋণ। এখনই সেলিব্রেশন নয়, আমৃত্যু দেশের গান গেয়ে যাব, মানুষের মনে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই।’