‘বৃষ্টি’ দিয়ে শুরু, ‘বাজি’ দিয়ে শেষ

পেশাদার সংগীতজীবনে বাপ্পা মজুমদার এর তিন দশক পূর্তি উপলক্ষে ঢাকার বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারের ৩ নম্বর মিলনায়তনে একক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে ক্যারট কম। ‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গান পরিবেশন করেন বাপ্পা। বিশেষ কনসার্টের মাধ্যমে মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শকের সামনে তিন দশকে বাপ্পা মজুমদারের বহুমাত্রিক সংগীতজীবনের নানা দিকও তুলে ধরা হয়। বাপ্পার সঙ্গে বিশেষ এ আয়োজনে গান গেয়েছেন তাঁর অনুজ চার শিল্পী কনা, কোনাল, শুভ ও জয়ীতা। ‘বৃষ্টি’ শিরোনামের গান দিয়ে শুরু হয়ে ‘বাজি’ দিয়ে যখন শেষ হয়, তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টা, মিলনায়তন ছিল শ্রোতায় পরিপূর্ণ।
তিন দশক পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুটা বাপ্পা মজুমদার করেছিলেন ‘বৃষ্টি’ শিরোনামের গানটি দিয়ে। এর আগেই ঢাকা শহরের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা গানপ্রেমীতে মিলনায়তন কানায়–কানায় পূর্ণ হয়ে যায়
ছবি : সংগৃহীত
একে একে সাতটি গান গাওয়া শেষে উপস্থিত ভক্ত-শ্রোতাদের সামনে সাড়ে তিন মিনিটের একটি অডিও ভিজ্যুয়াল প্রদর্শন করা হয়, যেখানে বাপ্পা মজুমদারের ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হয়
বাপ্পার গান শুনে মিলনায়তনে উপস্থিত হয়েছিলেন সংগীতাঙ্গনে তাঁর কাছের অনেকে। তাঁরা অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মগ্ন হয়ে গান শোনেন। সবারই অভিমত ছিল, দীর্ঘদিন পর তাঁরা এমন একটা চমৎকার আয়োজনের অংশ হতে পেরেছেন। বাপ্পাকে নিয়ে এমন একটি চমৎকার আয়োজনের জন্য আয়োজক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান সংগীতাঙ্গনের অনেকে।
বাপ্পার মা-বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে যেন চাকরির পাশাপাশি সংগীতচর্চা করেন। তাই মা-বাবার কথামতো চাকরি আর সংগীতচর্চা দুটো একসঙ্গে চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু যাঁর মা-বাবা আপাদমস্তক শিল্পী, তাঁদের সন্তানও গান আঁকড়ে ধরে এগোবেন, এটাই স্বাভাবিক। একটা সময় চাকরি ছেড়ে ঠিকই সংগীত তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। পেশা, নেশা সবই সংগীত ঘিরে। বেঁচে আছেন সংগীত আঁকড়ে ধরে। অসাধারণ সব গান দিয়ে দর্শকমন জয় করে চলছেন তিনি। পার করেছেন পেশাদার সংগীতজীবনের ৩০ বছর। তিন দশক পূর্তি উপলক্ষে এমন আয়োজন বেশ চমকপ্রদ বলে জানালেন বাপ্পা মজুমদার
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী শুভাশীষ মজুমদার একসময় বাপ্পা নামে পরিচিতি পান। ওই সময় শুধু গিটার বাজাতেন। ১৯৮৮ সালে বাপ্পা যখন এসএসসির শিক্ষার্থী, তখন বন্ধু আনন্দ রহমানের উদ্যোগে গড়ে ওঠে অরনী শিল্পীগোষ্ঠী। বাপ্পা বললেন, ‘আমরা এই সংগঠনের হয়ে গান গাইতাম, গণসংগীত করতাম, আবৃত্তি আর অভিনয়চর্চাও করতাম। একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গিটার বাজাতে গিয়ে পরিচয় জুয়েল ভাইয়ের (হাসান আবিদুর রেজা) সঙ্গে। তিনি আমার গিটার প্লেয়িং পছন্দ করেন। এরপর তাঁর সঙ্গে নিয়মিত বাজাতাম
বাপ্পা মজমুদার জীবনের প্রথম স্টেজ শো করেন শহীদ মিনার পাদদেশে। স্মৃতি হাতড়ে বাপ্পা মজুমদার জানালেন, ‘স্কুল–কলেজের গণ্ডি পার করেছি। গানে ব্যস্ততা বাড়ছে। এর মধ্যে ১৯৯২ অথবা ’৯৩ সালের দিকে একদিন শাহবাগ আজিজ মার্কেটের সিঁড়িতে পরিচয় সঞ্জীবদার (সঞ্জীব চৌধুরী) সঙ্গে। মাধ্যম হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল।’ বাপ্পা বললেন, ‘পরিচয়ের পর দুজন একসঙ্গে বেশ কিছু কাজ করি। কাজ করতে গিয়েই দেখলাম, আমাদের দুজনের চিন্তাভাবনা প্রায় একই। পছন্দও কাছাকাছি। ভাবলাম, একসঙ্গে কিছু করা যায় কি না। আমাদের সঙ্গে মিঠু ভাইও ছিলেন। দলবদ্ধ হলাম। গড়ে ওঠে দলছুট, সেটা ১৯৯৬ সালের নভেম্বরের কথা। প্রথম অ্যালবাম “আহ” প্রকাশিত হয় ১৯৯৭-এ
পেশাদার সংগীতে তিন দশক পার করা নন্দিত গায়ক ও সংগীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদারের জন্ম বিখ্যাত সংগীত পরিবারে। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে সারাক্ষণই সংগীতচর্চা চলত। সারাক্ষণ রেওয়াজ করতেন কেউ না কেউ। ঢাকার ১৭ সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িটায় থাকতেন সংগীতসাধক পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও তাঁর স্ত্রী ইলা মজুমদার, জনপ্রিয় শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের মা-বাবা। তিন দশকে বাপ্পা একক গানের পাশাপাশি ব্যান্ড, চলচ্চিত্র, নাটক আর মঞ্চে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এবারই শ্রোতাদের সামনে হাজির হচ্ছেন ভিন্ন আঙ্গিকে
সংগীত পরিবারে জন্ম নেওয়া বাপ্পা মজুমদার ছোটবেলা থেকে দেশ–বিদেশের বিভিন্ন শিল্পীর গান শুনে বেড়ে উঠেছেন। এ তালিকায় বনি এম, অ্যাবা, ডোনা সামার যেমন ছিলেন, তেমনি সলিল চৌধুরী, মান্না দে, কিশোর কুমারও ছিলেন। বাপ্পা বললেন, ‘সেমিক্ল্যাসিক্যাল শুনেছি, আবার পিওর ক্ল্যাসিক্যালও শুনেছি। একই সঙ্গে ফোক, হেভি মেটালও শুনতাম। আরেকটা নেশা ছিল, রাত জেগে রেডিও শোনা। ফ্লাস্কভর্তি চা নিয়ে বারান্দায় বসে টিউন করে করে বিভিন্ন দেশের রেডিও শুনতাম। বিশেষ করে রুশ, স্কটিশ, জার্মান মিউজিক শোনা হতো বেশি। তাই বলতে পারি, আমার গানের মধ্যে যে ইস্টার্ন ক্ল্যাসিক্যালের ছায়া, সেটা পরিবার থেকে তো বটেই, একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের শাস্ত্রীয় সংগীত শোনার ব্যাপারটাও রয়েছে। আমার মেজদা পার্থপ্রতীম মজুমদার বাসায় নানা ধরনের রেকর্ড নিয়ে আসতেন। তাঁর কারণেও অনেক কিছু শোনা হয়েছে
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে গেয়েছেন তাঁর ফিচারিং চারজন শিল্পী। তাঁরা হলেন কনা, কোনাল, শুভ ও জয়ীতা। বাপ্পা মজুমদারের ভাষায়, এটি এই অনুষ্ঠানের বিশেষ একটা ব্যাপার। কারণ হিসেবে বাপ্পা বলেন, ‘আমার নিজের কিছু সৃষ্টি আছে, যা অন্য শিল্পীরা গেয়েছেন। তিন দশকে এমন অনেকে গেয়েছেন, কিন্তু সবাইকে তো আর একত্র করা সম্ভব নয়। আমার খুব কাছের চারজনকে যুক্ত করেছি, এ রকম একটা ভাবনায়
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে গেয়েছেন তাঁর ফিচারিং সংগীতশিল্পী শিল্পী কনা (বামে)
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে গেয়েছেন তাঁর ফিচারিং সংগীতশিল্পী শিল্পী কোনাল (বামে)
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে বাপ্পা মজুমদারের সঙ্গে গেয়েছেন তাঁর ফিচারিং সংগীতশিল্পী শিল্পী জয়ীতা (বামে)
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে বাপ্পা মজুমদারকে নিয়ে কথা বলছেন তাঁর সংগীতশিল্পী ভাই পার্থ মজুমদার
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে বাপ্পা মজুমদারকে নিয়ে কথা বলছেন মাইলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য মানাম আহমেদ
‘অ্যালাইভ এক্সপেরিয়েন্স চ্যাপ্টার ওয়ান বাপ্পা মজুমদার’ শিরোনামের এ কনসার্টে অভিনয়শিল্পী ও উপস্থাপক স্ত্রী তানিয়া হোসাইনকে নিয়ে কথা বলছিলেন বাপ্পা মজুমদার, তালি দিচ্ছিলেন তাঁদের কন্যা সন্তান পিয়েতা
১৯৯২ সালে পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হলেও ১৯৯৫ সালে বাপ্পার প্রথম একক অ্যালবাম ‘তখন ভোরবেলা’ প্রকাশিত হয়। এরপর একক, দ্বৈত, মিশ্র, ফিচারিংসহ তাঁর প্রকাশিত অ্যালবামের সংখ্যা ৬০ ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে একজন পেশাদার সংগীতশিল্পী হলেও ছোটবেলায় তাঁর ইচ্ছা ছিল স্থপতি হওয়ার। সংগীতের বাইরে তাঁর বেশ কিছু ভালো লাগা আছে। কাছের মানুষেরা এগুলো জানেন। বাপ্পার ইলেকট্রনিক পণ্যের প্রতি দুর্বলতা আছে। ড্রোন ওড়াতে ভালোবাসেন। ভিডিও গেমস খেলতেও পছন্দ করেন, যদিও অনেক দিন হলো খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না। অ্যাস্ট্রোফিজিকসের প্রতিও রয়েছে তাঁর আকর্ষণ