নানান রঙের রুনা লায়লা

পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে গান গাইছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। গান গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি আর উর্দু ছবিতে। ১৮টি ভাষায় ১০ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন তিনি। যুক্ত আছেন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড নিয়েও। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর বরেণ্য এই শিল্পী জন্মগ্রহণ করেন, গতকাল জীবনের আরেকটি নতুন বছর শুরু করলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী রুনা লায়লা। সময়ের হিসাবে গতকাল ছিল তাঁর ৭০তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে প্রখ্যাত এই শিল্পীকে একটি ফটোসেশনের অনুরোধ করা হয়। অনুরোধ উপেক্ষা করেননি। ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ফটোসেশনের জন্য আলাদা করে সময় দিয়েছেন তিনি। ছবিগুলো তুলেছেন আশরাফুল আলম
দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি। অথচ ছোটবেলায় প্রথম নাচ শিখেছিলেন। বাবা এমদাদ আলী ছিলেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। থাকতেন পাকিস্তানের করাচিতে। সেখানে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে মেয়েকে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করেন মা আমিনা লায়লা। এই প্রতিষ্ঠানে চার বছর নাচ শিখেছেন রুনা। শিক্ষক ছিলেন আফরোজা বুলবুল। রুনা তাঁর কাছ থেকে শিখেছেন কত্থক আর ভরতনাট্যম
ছবি : আশরাফুল আলম
মাত্র ১২ বছর বয়সে রুনা লায়লার কাছে লাহোর থেকে একটি ছবিতে গান করার প্রস্তাব আসে। কিন্তু তাঁর বাবা শুনেই না করেন। গান গাওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তখন অনেকেই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। রুনা জানালেন, তাঁর খুব ইচ্ছা হলো। তখন সব বড় বড় শিল্পী রেডিওতে গান করতেন। বললেন, ‘ভাবতাম, একদিন রেডিওতে আমার নামও বলবে। সবাই আমার গান শুনবে। বাবাকে আমার ইচ্ছার কথা জানান মা। অনেক কষ্ট করে তিনি আব্বাকে রাজি করালেন। আমি ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পেলাম। ছবির নাম ‘জুগনু’। উর্দু ছবি। গানটি ছিল ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি’। পর্দায় ১২ বছরের একটি ছেলের ঠোঁটে ছিল গানটি। পুরো এক মাস চর্চা করি। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে দুই ঘণ্টা আর স্কুল থেকে ফেরার পর দুই ঘণ্টা। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন মনজুর হোসেন। তিনিই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।’
রুনা লায়লা প্রথম বাংলা গান রেকর্ডিং করেন পাকিস্তান রেডিওর ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। দেবু ভট্টাচার্যের সুর করা গান দুটি ছিল ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ আর ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’
বড় বোন দিনা লায়লা গান শিখতেন। বাসায় তাঁকে গান শেখাতে আসতেন একজন ওস্তাদ। তখন রুনা লায়লার বয়স চার কি পাঁচ। খেলাধুলা করতেন। দৌড়ঝাঁপ ছিল তাঁর নিত্য কাজ। বোন যখন গান করতেন, তাঁর আশপাশেই থাকতেন। ওস্তাদজি বোনকে যা শেখাচ্ছেন, তা তিনি শুনে শুনেই শিখে নিতেন। পরে গুনগুন করে গাইতেন। রেডিওতে কোনো গান শুনলে সুরটা তাঁর ঠিকই মনে থাকত। মেয়ের প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রুনার মা-বাবা। গানে মেয়ের সম্ভাবনা সেদিন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁরা। পরে মেয়েকে গান শেখানো শুরু করেন। রুনা লায়লা জানালেন, গানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন আবদুল কাদের, হাবিব উদ্দিন আহমেদ। পরে গজলের গায়কি শিখেছেন মেহেদী হাসানের বড় ভাই ওস্তাদ গোলাম কাদিরের কাছে
মঞ্চে রুনা লায়লার গান গাওয়ার শুরুটা একদম হঠাৎ করেই। করাচিতে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ঢাকা ওল্ড বয়েজ অ্যাসোসিয়েশন। এখানে গান করবেন দিনা (রুনার বড় বোন)। কিন্তু অনুষ্ঠানের আগে অসুস্থ হয়ে পড়েন দিনা। বিপদে পড়েন আয়োজকেরা। শেষে বড় বোনের জায়গায় ছোট বোনকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। রুনা বললেন, ‘ওই অনুষ্ঠানে শাস্ত্রীয়সংগীত করেছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ছয়। পরে মায়ের কাছে শুনেছি, আমি নাকি সেদিন ধুমধাম গেয়ে মাত করেছিলাম। তানপুরা নিয়ে গান করেছিলাম। আর ওই তানপুরা ছিল আমার চেয়ে দুই গুণ বড়। সবাই আমার গানে মুগ্ধ হন। খুশি হয়ে সেদিন অনেকেই আমার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন
গত শতকের ষাটের দশকে বাংলা ছবিতে গান করার জন্য আমন্ত্রণ পান রুনা। চিত্রপরিচালক নজরুল ইসলাম আর সংগীত পরিচালক সুবল দাস ‘স্বরলিপি’ ছবির গান রেকর্ডিং করতে যান লাহোরে। তাঁরা ছবির একটি গান রুনাকে দিয়ে গাওয়ানোর পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি দারুণ ব্যস্ত। একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে গান। একই দিনে বিভিন্ন স্টুডিওতে ছয়-সাতটি গান রেকর্ডিং করছেন। কাজ করতেন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। শুনে রাজি হলেন রুনা। লাহোরের বারী স্টুডিওতে রেকর্ডিং করা হয় গানটি। গানটির শিরোনাম, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। একই গানে আরও কণ্ঠ দিয়েছিলেন মাহমুদুননবী। রুনা বললেন, ‘বাংলাদেশে আসার আগে আর কোনো বাংলা ছবিতে গান গাওয়া হয়নি।’ বাংলাদেশে আসার পর প্রথম গান করেন সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ ছবিতে
বাবা-মায়ের সঙ্গে রুনা লায়লা বাংলাদেশে আসেন ১৯৭৪ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। রুনা লায়লা বললেন, ‘সংগীতের জগতের অনেকেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সবাই আমাকে স্বাগত জানালেন। আর বাংলাদেশে ফিরে আসতে পেরেছি, সেটাই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের। আব্বা যখন বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন, তখন অনেকেই আমাকে পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। শুনিনি। তত দিনে উর্দু ছবিতে আমি অনেকগুলো গান করে ফেলেছি।’ একই বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনসের (আইসিসিআর) আমন্ত্রণে প্রথম ভারত সফর করেন রুনা। ভারতে প্রথম গান করেন দিল্লি বিজ্ঞান ভবনে, এরপর মুম্বাইয়ে শান মুখআনন্দ মিলনায়তনে। বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে তাঁকে বলা হলো ‘দামাদাম গার্ল’। তাঁর প্লেব্যাক করা প্রথম হিন্দি ছবি ‘এক সে বড়কার এক’। কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে তিনি ছবির টাইটেল গানে কণ্ঠ দেন। পর্দায় এই গানের সঙ্গে অভিনয় করেন হেলেন
পাকিস্তানে নিসার বাজমির সুর করা অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা। রুনাকে দিয়ে নানা ধরনের গান করিয়েছেন এই সুরকার ও সংগীত পরিচালক। পরে মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান রুনাকে দিয়ে নিসার বাজমির সুর করা গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে। প্রতিদিন একই সুরকারের ১০টি করে ৩ দিনে মোট ৩০টি গান রেকর্ড করেন রুনা। পরে তা বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্থান পায় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে
বাংলা ভাষা ছাড়া আরও ১৭টি ভাষায় গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। তিনি বললেন, ‘বাংলা ছাড়া আমি উর্দু, হিন্দি আর ইংরেজি ভাষা জানি। তবে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, গুজরাটি, পশতু, বেলুচি, আরবি, পারসিয়ান, মালয়, নেপালি, জাপানি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি ভাষায় গান করেছি
১৯৮২ সালের ১ ডিসেম্বর, এদিন রুনার গাওয়া বাপ্পী লাহিড়ীর সুর করা গান নিয়ে ইএমআই মিউজিক কোম্পানি প্রকাশ করে ‘সুপার রুনা’ অ্যালবাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, প্রথম দিনেই অ্যালবামটির এক লাখ কপি বিক্রি হয়। উপহার হিসেবে রুনাকে দেওয়া হয় গোল্ড ডিস্ক। রুনা বললেন, ‘অ্যালবামটির কাজ করেছিলাম লন্ডনে। লন্ডনের এবি রোডেস, যেখানে বিটলস গান রেকর্ডিং করত
চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন রুনা লায়লা। ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে পাকিস্তান থেকে তো বটেই, ভারত থেকেও অসংখ্য প্রস্তাব পান রুনা লায়লা। কিন্তু তখন তিনি গানকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। শেষে একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ছবির নাম ‘শিল্পী’। রুনা বলেন, ‘ছবিটি আমার জীবনের কিছু গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাই রাজি হয়েছিলাম
গান গাওয়ার পাশাপাশি আর্তের সেবায়ও নিজেকে নিয়োজিত করেছেন রুনা লায়লা। বাড়িয়েছেন সহযোগিতার হাত। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সহায়তার জন্য সুইড বাংলাদেশের হয়ে কাজ করছেন। সার্কের শুভেচ্ছাদূতও তিনি। ইউএনএইডসের শুভেচ্ছাদূত হয়ে এইচআইভি/এইডসের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করছেন। বড় বোন দিনার মৃত্যুর পর ঢাকায় শিশু হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের জন্য একটি ওয়ার্ড গড়েছেন। এখন স্বপ্ন দেখেন ক্যানসার হাসপাতাল গড়ার