আজিমপুরের ১০ নম্বর কলোনিতে জন্মেছিলেন আজম খান। শৈশব কেটেছে আজিমপুর ও কমলাপুরে। একটু বড় হতেই পেয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের আঁচ। আজম খানের গানে আসার ক্ষেত্রে ওই সময়ের প্রভাব আছে। জানালার বাইরে তিনি দেখতেন মাতৃভাষার জন্য মানুষের গণজমায়েত। জানালার বাইরে শুনতেন ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, ‘কইমু না ভাই কইমু না অন্য কথা কইমু না’ গানগুলো। স্কুলে পড়ার সময় পিটিতে সবার সঙ্গে গান গাইতেন। এসব গান মনে রাখতে পারতেন আজম খান। যে গান ভালো লাগত সেটাই শুনতেন, পরে হুবহু সেটা গাওয়ার চেষ্টা করতেন। আজম খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি গান শুনে হুবহু গাইতে পারতাম। অনেকের কাছে এটা বিস্ময়কর ছিল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, আবদুল আলিম, শ্যামলের গান তাঁদের মতো করেই গাইতাম। পরে মহল্লার বন্ধু-সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডায় বানিয়ে গান গাইতাম। এভাবেই একদিন গানের দিকে ঝুঁকে পড়ি। গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আমার ছিল না।’
আজম খানকে বাংলা পপ গানের সম্রাট বলা হয়। একাধারে তিনি পপ গানকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে দিয়েছেন নতুন ধারার এই গান। আজম খান স্বপ্ন দেখিয়েছেন দেশের তরুণদের। পপ গানকে লালন করেছেন, শ্রোতা তৈরি করেছেন, বাংলা এই পপ গানের ধারা যেন সময়ের সঙ্গে প্রবহমান থাকে, সেই পথও তৈরি করে গেছেন। প্রয়াত গুণী এই শিল্পীর আজ জন্মদিন।
পপ গানকে লালন করেছেন, শ্রোতা তৈরি করেছেন, বাংলা এই পপ গানের ধারা যেন সময়ের সঙ্গে প্রবহমান থাকে, সেই পথও তৈরি করে গেছেন। প্রয়াত গুণী এই শিল্পীর আজ জন্মদিন।
নবম শ্রেণিতে পড়াকালে আজম খান বুঝতে পারেন, পাকিস্তানি শাসকেরা নানাভাবে দেশের মানুষকে ঠকাচ্ছে। সেই চেতনা থেকে আজম খানের মধ্যে ভর করে বিপ্লবী চিন্তা। তখনই জানতে পারেন ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠীর কথা, যারা গণসংগীতের চর্চা করত।
বন্ধুদের নিয়ে সেখানে গান করতে থাকেন আজম খান। গান নিয়ে ঢাকার বাইরে যাওয়া শুরু করেন তাঁরা। তাঁদের গানে উঠে আসে সাধারণ মানুষের কথা। প্রতিবাদী গানের জন্য পুলিশের লাঠির বাড়িও খেয়েছেন। গণ–আন্দোলনের সময়গুলোতেও গান করে গেছেন আজম খান। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখতে দেখতে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়ি দেখে দেয়াল টপকে একবার আজিমপুর আবার কমলাপুর, এভাবে চলছিল। দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে পাকিস্তানিরা। তখন মনে হলো মরছিই যখন, মেরেই মরব।’
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখতে দেখতে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পাকিস্তানি আর্মিদের গাড়ি দেখে দেয়াল টপকে একবার আজিমপুর আবার কমলাপুর, এভাবে চলছিল। দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে পাকিস্তানিরা। তখন মনে হলো মরছিই যখন, মেরেই মরব।’
বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আজম খান। যেভাবেই হোক, দেশ স্বাধীন করতে হবে। একদিন সকালে মাকে বললেন, ‘আমি যুদ্ধে যেতে চাই।’ মা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘তোর বাবাকে বল।’ তাঁর বাবা ছিলেন কিছুটা রাশভারী মানুষ। কথা কম বলতেন। আজম খান ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। বাবাকে জানান যুদ্ধে যাওয়ার কথা। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আজম খানের পা, বুক কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা বুকে একদৃষ্টে মাটির দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। মনে মনে সেদিন ভেবেছিলেন, বাবা হয়তো থাপ্পড় মারবেন নয়তো লাথি মারবেন। কিছু সময় চুপ করে থাকার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন করেই তবে ঘরে ফিরবি।’ আব্বাকে সালাম করে সকাল সাড়ে ১০টায় দুই বন্ধুকে নিয়ে ভারতে ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তিনি।
আজম খান ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। বাবাকে জানান যুদ্ধে যাওয়ার কথা। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আজম খানের পা, বুক কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা বুকে একদৃষ্টে মাটির দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। মনে মনে সেদিন ভেবেছিলেন, বাবা হয়তো থাপ্পড় মারবেন নয়তো লাথি মারবেন। কিছু সময় চুপ করে থাকার পর তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে যাবি যা, কিন্তু দেশ স্বাধীন করেই তবে ঘরে ফিরবি।’
আজম খানরা দেশ স্বাধীন করার জন্য ছুটেছিলেন। ট্রেনিং নিয়ে শুরু করেছিলেন যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পেও চলত তাঁর গানের চর্চা। নতুন নতুন গান বাঁধতেন সেখানে। থালাবাসন ছিল বাদ্যযন্ত্র। তখন আজম খানের গান শোনার জন্য ভিড় জমাতেন মুক্তিযোদ্ধারা। সবার কাছে আজম খান পরিচিতি পেলেন গায়ক হিসেবে। পরে দেশ স্বাধীন করেই ফিরেছিলেন আজম খান। তারপর শুরু হলো সংগীতচর্চা। শুনতেন বিটলস, দ্য শ্যাডোজ, রোলিং স্টোনের গানগুলো। একসময় বন্ধুদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করেন। সেই অনুষ্ঠানগুলোতে পপ গান গাইতেন তাঁরা। আজম খানের গানের ভক্ত জুটে যায় পাড়া-মহল্লায়। তারপর সারা দেশে।
বঞ্চিত মানুষের গান করতে শুরু করেন আজম খান। তাঁর গানে আসতে থাকে সচেতনতা, দেশপ্রেম, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়, তরুণদের উদ্বুদ্ধকরণ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চলতে থাকে তাঁর গান। সে সময় তিনি গেয়েছিলেন ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায়’, ‘অভিমানী’, ‘অনামিকা’, ‘পাপড়ি’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আমি যারে চাইরে’, ‘জ্বালা জ্বালা’, ‘ও চাঁদ সুন্দর’, ‘ও রে সালেকা ও রে মালেকা’, ‘জীবনে কিছু পাব না রে’, ‘বাধা দিয়ো না’সহ অনেক জনপ্রিয় গান।
১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আজম খানের জন্ম। মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন। ২০১১ সালের ৫ জুন তিনি দেশবাসীকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে যান। সশরীর না থাকলেও তাঁর গানগুলো আজও সমসাময়িক। এই গানগুলোই তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখবে।